গতকাল ১৩ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হয়েছেন লোকসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীন
গতকাল ১৩ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হয়েছেন লোকসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীন

নজরুলসংগীত গাইতে গাইতে যেভাবে লালনের গানের ভুবনে এসেছিলেন ফরিদা পারভীন

গতকাল ১৩ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হয়েছেন লোকসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীন। লালনগীতির কথা বললে যে শিল্পীর মুখটি অনিবার্যভাবে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে, সেই ফরিদা পারভীন কিন্তু নজরুলসংগীতশিল্পী হিসেবেই তৈরি হয়েছিলেন শৈশবে। কী করে ঘটল এই পালাবদল? ফরিদা পারভীনের সঙ্গে কথা বলে আরও অনেক অজানা তথ্য জেনেছিলেন সাইমন জাকারিয়া। সেসব ছাপা হয়েছিল ২০০৩ সালের ৯ আগস্ট প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে। শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটির নির্বাচিত অংশ পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

বাংলাদেশের আপামর-সাধারণের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই লালনগীতি ও ফরিদা পারভীন পরস্পর পরিপূরক এবং অবিচ্ছিন্ন দুটি নাম। লালন সাঁইজির গানের প্রসঙ্গ উঠলেই বাঙালির মন-কানে প্রথমেই যাঁর কণ্ঠস্বর ও সুর বেজে ওঠে, তা নিশ্চিতভাবেই ফরিদা পারভীনের। দীর্ঘদিন তিনি দূর কুষ্টিয়া শহরে বসে লালনগীতির চর্চা করেছেন এবং সেখান থেকেই তাঁর প্রতিষ্ঠা। দূর মফস্‌সল শহরে বাস করে লালনগীতির মতো একটি বিশেষ সংগীতের ক্ষেত্রে একক গুরুত্ব প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে ফরিদা পারভীন ব্যতীত আর কারও নেই। কুষ্টিয়ায় অবস্থানকালেই ১৯৮৭ সালে তিনি লালনগীতিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক এবং ‘অনন্ত প্রেম’ ছবিতে ‘নিন্দার কাঁটা’ গানটি গেয়ে ১৯৯৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। বর্তমান এই শিল্পী সংগীতকে আঁকড়ে ধরে ঢাকায় অবস্থান করছেন।

ফরিদা পারভীনের জন্ম ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোর জেলার সিংড়া থানার কলম গ্রামসংলগ্ন শাঔঁলে। ফরিদা পারভীন বলেন, কলম গ্রামের মতো এত সুন্দর এবং বড় গ্রাম নাকি তামাম উত্তরবঙ্গে নেই। ‘বিল দেখতে চলন। গ্রাম দেখতে কলম।’ সেই সুন্দর গ্রামাঞ্চলে কেমন কেটেছে তাঁর ছেলেবেলা? ‘ছোটবেলায় আমি একটু চঞ্চল প্রকৃতির ছিলাম। দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা—এসব করে বেড়াতাম। ছোট ছোট ডিঙিতে চড়ে বিলে শাপলা তুলতে যেতাম। পাখির বাসা দেখে বেড়াতাম।’

এক আসরে লালনের গান গাইছেন ফরিদা পারভীন

এই দুরন্তপনার ফাঁকেই মাতৃস্তন্য পান করতে করতে তাঁর অন্তরে আসন গেড়ে বসেছিল সুর। ‘আমি কিন্তু অনেক বড় হয়ে আমার মায়ের দুধ খেয়েছি। এক মেয়ে ছিলাম, ঘুমানোর সময় মায়ের দুধ খেতাম, আর মা গান করত। মায়ের সেই সুরই আমার ভেতর রয়ে গেছে, সেই সুর এখনো আমি ভুলতে পারি না। তখনকার হিন্দি গান, লতাজির অনেক গান মা গাইত। সিনেমা দেখত তো খুব, তখনকার সিনেমার ওই সব গান গাইত। আমার মায়ের কিন্তু খুব ভালো গানের গলা ছিল।’

ছোটবেলাকার গানের স্মৃতি মন্থন করে ফরিদা পারভীন আরও বললেন, ‘আমি মা–বাবার একমাত্র সন্তান। যে কারণে মামা-খালারা আমাকে খুব বেশি ভালবাসত। তারপর আমি আবার একটু একটু গান জানি।...আমার বড় মামা ভীষণ গানের ভক্ত ছিলেন। উনি গান করতেন না, কিন্তু গানের আসর যেখানে, সেখানে উনি যাবেনই। হয়তো নানার বাড়িতে গেছি, সন্ধ্যার পর উঠানে পাটি পেড়ে গান হতো। আমার গান শুনে বড় মামা বলত, “আমার ফরিদার মতো আর গলা দেখি না। দেখিস রৌফা, (আমার মা তো সবার ছোট, মায়ের নাম ধরে বলত) আমার ফরিদা যা হবে না।”’

গানের পাশাপাশি লেখাপড়াও চলেছে সমানতালে। নাটোরের জগৎপুর, শাঁঔলের স্কুলেই। বাবা দেলোয়ার হোসেন মেডিকেলে চাকরি করতেন। বদলির চাকরি। ‘একবার গ্রামে, একবার বাবার চাকরিস্থলে আমার জীবন চলেছে।’ এর মধ্যেই মাগুরায় প্রথম গানের হাতেখড়ি হয়ে গেল।

লালনগীতির জন্য তিনি সংবর্ধিত হয়েছেন বহুবার

গান-সুর, অভিমান-জেদ এবং প্রথম হারমোনিয়াম

ছোটবেলায় কি নির্দিষ্ট কোনো সময় বেঁধে গান করতেন? ‘না, তেমন কিছু নয়’ হেসে বললেন, ‘গানের সুর আমার ভেতরে সব সময়ই ছিল। খেলা করছি, পড়ছি...পড়তে পড়তে একটা গান মনে এল, ব্যস, জোরে জোরে গাইতে শুরু করলাম।’

পড়ালেখার মন বিশেষ না থাকলেও পরীক্ষার ফল কিন্তু ভালো ছিল। ‘মাগুরায় যখন পড়ি, ওয়ান থেকে টুতে উঠছি, তখন ১ মার্কের জন্য আমাকে সেকেন্ড করে দিল। তারপর আমার সে কী কান্নাকাটি। কান্নাকাটি করে বললাম যে আমি পড়বই না।’

গানের ক্ষেত্রে এই জেদটা কীভাবে কাজ করেছে? ফরিদা পারভীন হেসে বলেন, ‘তাহলে আরেকটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা বলি। তখনো মাগুরায় থাকি। বাবার সঙ্গে জেদ করছি আমার হারমোনিয়াম বানিয়ে দাও, আমি হাতেখড়ি দেব, আমি গান শিখব। মাগুরায় আমরা তখন ভাড়া বাসায় থাকি, পাশেই আরও দু-একজন ভাড়াটে আছে। তাদের একজনের বাসায় হারমোনিয়াম আছে, অথচ আমার হারমোনিয়াম নেই, বোঝেন অবস্থা!...

‘আমাদের বাসা থেকে ওই বাসায় যেতে একটা উঠান মতো আছে, সেখানে জাংলা দিয়ে শিমের গাছ আছে, ওর ভেতর দিয়ে যেতে হয়। একদিন রাতের বেলা ওই বাসায় হারমোনিয়ামের বাজনা শুনে আমি ছুটে দৌড় মারছি, তারপর আমি গিয়ে ওদের কিছুই বলছি না, আমি ওই দরজার কোনায় দাঁড়িয়ে দেখছি, হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে। আমার ভেতরে ভেতরে রাগ হচ্ছে।

‘ওই ঘটনার পর আমার আব্বাকে বললাম, “আমি পড়বও না, খাবও না, গোসল করব না, কিছু করব না, আমার হারমোনিয়াম যদি না বানিয়ে দাও।”’

তারপর হারমোনিয়ামের সবকিছু কলকাতা থেকে নিয়ে আসা হলো। নিয়ে এসে বাসায় মিস্ত্রি দিয়ে হারমোনিয়াম তৈরি করা হলো। সেই হারমোনিয়ামটাই এখনো আছে। ‘আমার মা যত্ন করে ন্যাপথলিন দিয়ে রেখে দিয়েছে। আমি গেলে আবার একটু বের করে, মা যদি গান শুনতে চায়, তখন শোনাই।

‘যুদ্ধের বছরে শুধু হারমোনিয়ামটাই নিয়ে গিয়েছিলাম, আর কিছুই নিইনি। হারমোনিয়ামটা মিলিটারি দেখলে আমাকে হয়তো রেডিওতে গান করতে নিয়ে যাবে—এই ভয়ে হারমোনিয়ামটা একসময় মাটির নিচে পুঁতেও রেখেছিলাম, যাতে তারা দেখতে না পায়।’ এ–ই হচ্ছে ফরিদা পারভীনের সংগীতজীবনের শুরুর কথা।

সারগাম ও ক্ল্যাসিক্যাল চর্চা

হারমোনিয়াম তো হলো, এবার বেশ জোরেশোরেই শুরু হবে সংগীত শিক্ষা। কিন্তু তার আগে চাই হাতেখড়ি? ‘মাগুরায় স্কুলে পড়ার সময়ে সারগাম দিয়ে গানের হাতেখড়ি দিয়েছিলেন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তী। এরপর যখন আমি মাগুরা গার্লস স্কুল থেকে কুষ্টিয়া গার্লস স্কুলে আসি, তখন ওস্তাদ ইব্রাহিম গার্লস স্কুলের গানের টিচার। উনি আমার গান শুনে ক্ল্যাসিক্যাল শিখতে বললেন। আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। ওনার কাছে ক্ল্যাসিক্যাল শিখতে শুরু করলাম।

‘পরে আরও বড় হয়ে কুষ্টিয়ার রবীন্দ্রনাথ রায়, মোতালেব বিশ্বাস, ওসমান গণির কাছে ক্ল্যাসিক্যাল শিখছি এবং শুধু তানপুরার সঙ্গে ছয় থেকে সাত বছর ক্ল্যাসিক্যাল চর্চা করেছি।’

বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে গান শিখেছেন ফরিদা পারভীন এবং অনেকে শুনে অবাক হবেন, আজকের এই জনপ্রিয় লালনগীতির শিল্পী প্রথম জীবনে পরিচিত হয়েছিলেন নজরুলসংগীতশিল্পী হিসেবে। ‘আমি প্রথমে নজরুলসংগীত শিখতাম কুষ্টিয়ার ওস্তাদ আবদুল কাদেরের কাছে, তারপর মেহেরপুরে মীর মোজাফফর আলীর কাছে। স্বরলিপি দিয়ে যে নজরুলের গান তোলে, এটা আমি মীর মোজাফফর আলীর কাছেই প্রথম শিখেছি। ’৬৮ থেকেই আমি রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত নজরুলসংগীতের শিল্পী।’

ফরিদা পারভীনের প্রথম হারমোনিয়াম

লালনগীতি হলো জীবনসঙ্গী

তাহলে লালনগীতির সঙ্গে আপনার যোগাযোগ কবে থেকে? সংক্ষেপে জানালেন, ‘স্বাধীনতার পরে।’

সেটা কি হঠাৎ করেই?

‘হঠাৎ করেও না, আবার হঠাৎ করে। ১৯৭৩ সালে কুষ্টিয়ায় একজন ডাক্তার ছিল, নামটা মনে নেই, লালনের আখড়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তার। সে–ই প্রথম আসছিল আমার কাছে। আমাদের কুষ্টিয়ার হসপিটালের বাসায় এসে আমার আব্বারে বলছে যে “লালনের আখড়ায় দোলপূর্ণিমায় মহাসমাবেশ হবে, মেয়েটা যদি একটা-দুটো গান করত, তাহলে তো ভালো হতো। পূর্ণদাস বাউল আসবে।” তখন আব্বা বললেন যে “ওরে একটু জিজ্ঞেস করে নিই, ও তো পাগলি, ওর মন কখন কী বলে...।” আব্বা এসে আমাকে বলল। আমি বললাম, “দূর, লালন ফকিরির গান করব! এই একটা কথা হলো! আমি তো নজরুলের গান করি। সেই আমি ফকিরির গান করব!” তখন ওই ডাক্তার আমাকে ‘সত্য বল সুপথে চল’ গানটার একটু টাচ দিলেন। তারপর এলেন মোকসেদ কাকা। উনি সব শুনে বললেন, ঠিক আছে আমি নাহয় গানটা তুলে দেব।

‘আমার কিন্তু তখনো মন টানছে না। আব্বা বলল,—“দু-একটা গান শিখে রাখলে অসুবিধা কী, তুমি তো নজরুলের পাশাপাশি আধুনিক গানও করো।” কথা ঠিকই। সে সময়ে আবু জাফর সাহেবও ওই শহরের মধ্যেই থাকতেন, মাঝেমধ্যে আমাদের বাসায় আসতেন, একটা-দুটো আধুনিক গান আমাকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। যদিও আমার নজরুলসংগীতের প্রতিই বেশি প্রেম ছিল।’

যাহোক, বাবা ও মোকসেদ কাকার পরামর্শমতো একটা গান শিখে মঞ্চে উঠলেন ফরিদা পারভীন। আর ম্যাজিকটা ঘটল তখনই। মঞ্চে উঠে যখন ‘সত্য বল সুপথে চল’ গানটি ধরলেন, শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনল। আর গান শেষ হওয়ার পরই পাগলের মতো ‘আরেকটা হোক, আরেকটা হোক’ করতে লাগল। ফরিদা পারভীন তখন শ্রোতাদের বললেন, ‘ভাই, আবার শিখে আসি, তারপর আরও গান গাইব।’

কথাটা এমনিতেই বলা। কিন্তু লালনগীতি চর্চার চিন্তাটা হয়তো তখনই ফরিদা পারভীনের অবচেতনায় কাজ করেছিল। মঞ্চে প্রথমবারের মতো লালনগীতি গেয়ে শিহরিত ফরিদা পারভীনের মনে তখন এমতো চিন্তাও এল যে ‘নজরুলের গান গেয়ে তো ফিরোজা বেগম হতে পারব না। কিন্তু লালনের গানটা গাওয়া যেতে পারে। সে সময় লালনের গান মেয়েরা বিশেষ একটা গাইত না। মেয়েরা যে লালনের গান করতে পারে, এটা আমাকে দিয়েই ভঙ্গ হয়েছে।’

স্বাধীনতার পর চলে এলেন ঢাকায়। ‘আমার গান দিয়ে ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস শুরু হলো। মোকসেদ আলী সাঁই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ছিলেন, উনি এলেন। তখন ঢাকায় আমাকে অনেকে লালনের গান গাইতে বললেন। সাবিনা ইয়াসমীনসহ অনেক আর্টিস্ট দিয়ে তখন উনি “খাঁচার ভিতর”, “বাড়ির কাছে আরশিনগর” এই গানগুলো গাইয়েছিলেন, কিন্তু উনি যেটা চেয়েছেন, সেটা পাননি। তারপর উনি কুষ্টিয়া থেকে আমাকে এনে অনেক গান শিখিয়েছেন এবং আমি তা ট্রান্সক্রিপশনে রেকর্ডিং করেছি।’

মোকসেদ আলী সাঁই ছাড়াও ফরিদা পারভীন লালনগীতি শিখেছেন খোদাবক্স সাঁই, করিম সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াসিন সাঁই—এঁদের কাছে।

লালনগীতি সম্পর্কে ফরিদা পারভীনের কথা

লালন সাঁইজির গানগুলো মূলত তত্ত্বনির্ভর। সেই তত্ত্বনির্ভর গানগুলোয় আধুনিক সুর-তাল সংযোজনার যৌক্তিকতা কী? এ সম্পর্কে শিল্পী ফরিদা পারভীনের বক্তব্য হচ্ছে, ‘হ্যাঁ, লালনের গানগুলো তত্ত্বনির্ভর। সুর ও লয় কিন্তু মানুষকে আলোড়িত করে। যেমন “মিলন হবে কত দিনে”, এটা একটা আকুতির গান। কিন্তু এই গানটার রিদম মানুষকে নাচিয়ে তোলে। এই ভেবে আমি এখন লালনের গানকে বৈতালিকে গেয়ে নতুন একটা কিছু সংযোজন করতে চাইছি। কারণ, গানের সুর ও কথার মাদকতা লয়টা দিলে নষ্ট হয়ে যায়। যেমন “সময় গেলে সাধন হবে না।” এটা কিন্তু আমি বৈতালিকে করেছি। আমি দেখেছি গানের বাণীটা এক রকম আর সুর-তাল আরেক রকম, তাই আমি গানটা শুধু সুরে বৈতালিকে গাইলাম, এর সুরের দিকটা আরেকটু আলোড়িত করে।’

আপনার লালনগীতি নিয়ে লালনপন্থী সাধুদের কিছু অংশের আপত্তির কথা কি জানেন? প্রশ্নটা করতেই ফরিদা পারভীন বেশ জোরালোভাবে উচ্চারণ করলেন, ‘একটা কথা কিন্তু মনে রাখবেন, আমি লালনের গানের গুরু ধরেই শিখছি—মোকসেদ সাঁই, খোদাবক্স সাঁই, করিম সাঁই আমার লালনগীতির গুরু। তবে এটা বলতে পারেন, যখন একটি গান আরেকটি পরিশীলিত গলায় ধারণ করে, তখন তার চেহারাটা একটু আলাদা হয় বৈকি। যেমন একটা সাধারণ মেয়েকে আপনি কানে দুল পরাবেন, নাকফুল পরাবেন, তখন তার সৌন্দর্য একটু বৃদ্ধি করবে বৈকি। কারণ, আমি তো সংগীতের মানুষ, সংগীত চর্চা করেই লালনগীতিতে এসেছি। সেখানে আমার কণ্ঠে গানটি গাওয়ার পর আলাদা একটা দ্যুতি আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এখন আমি যে সুরে গাইছি, বড় বড় গুরু তো আমার সুরেই গাইছেন।’

গুরুরা তো শিষ্যপরম্পরায় বিশ্বাসী? এ কথার উত্তরে ফরিদা পারভীন বলেন, ‘ওরা তত্ত্বের গুরু মানে, আমি সংগীতের গুরু ধরে গান শিখেছি। সাধুরা তত্ত্ব নিয়েই ব্যস্ত, কিন্তু তত্ত্ব দিয়ে লালন সাঁইকে কয়জন চেনে। লালন ফকিরের গান মানেই লালন ফকির।’

শুধু দেশে নয়, লালনগীতিকে ফরিদা পারভীন পরিচয় করিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং তরুণদের গায়কি নিয়ে কথা

লালনগীতি করে তৃপ্ত ফরিদা পারভীন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সফর করেন লালনের গান নিয়েই। ২০০১ সালের আগস্ট মাসজুড়ে ‘ফরিদা পারভীন প্রজেক্ট কমিটি’র আওতায় তিনি জাপানের বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে লালন সাঁইজির গানকে পরিচয় করিয়েছেন। সাঁইজির গান নিয়ে তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বেশ বিস্তৃত, তিনি এখন তাঁর গায়কিতে লালনগীতিকে বিশ্বময় করার স্বপ্ন দেখেন। এর বাইরে তিনি আরও বলেন, ‘লালনের গান নিয়ে বর্তমানে স্বরলিপি করছি। স্বরলিপির কাজ করার উদ্দেশ্য লালনের গানের গায়কিটা ধরে রাখা।’ তাঁর কাছেই জানা গেল, ‘ফরিদা পারভীন ট্রাস্ট’ হতে যাচ্ছে। ট্রাস্টের পরিকল্পনায় আছে—লালনের গান সংগ্রহ, স্বরলিপি, স্টাফ নোটেশন, লালনের গানের ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রের আর্কাইভ ইত্যাদি। অন্যান্য ফোকগানও সংরক্ষণ করা হবে এবং বছরে অন্তত একটা করে লালনগীতির সম্মেলন আয়োজনের চেষ্টা করবেন তাঁরা। ‘এখন লালন নিয়েই আমার সব চিন্তা।’

হালের অনেক তরুণ-তরুণীই নিজেদের মতো করে লালনগীতি গাইছেন, এ সম্পর্কে ফরিদা পারভীনের প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক। তাঁর কথা হচ্ছে, ‘লালনের গান ভক্তি দিয়ে শিখে গাইতে হবে। লালনের গানের গুরু ধরে গাইতে হবে। শুনে শুনে নিজের মতো করে গাইলাম, তা কিন্তু হবে না।’

লালনগীতি নিয়ে বাইরের দেশে

এযাবৎ লালনগীতি নিয়ে ফরিদা পারভীন জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ডসহ আরও বহু দেশে গিয়েছেন। তাঁর হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে একটি স্মৃতি। ‘ঘটনাটা ১৯৮৪-৮৫ সালের। বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে ডেলিগেটস গিয়েছিল সুইডেনে, সেই সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের নেতা ছিলেন সাঈদ আহমদ, ওনার সামনেই ঘটনাটা ঘটে। সুইডেনের রানি গ্রামে থাকেন, তাঁর গ্রামের বাড়িতেই আমাদের নিয়ে গেছেন, সেখানে “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি” গানটা গাইছি। শুনে রানি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। রানি তো কথা বুঝতে পারছেন না। তিনি শুধু একটা কথাই বললেন, ‘ওর গায়কি, ওর সুরের যে ডেপথনেস, তাতে আমার মনে হলো, ওর কণ্ঠের মধ্যে ঈশ্বর বাস করছে। ...ওর কথা বোঝার আমার দরকার নেই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, ওর সুরের ভেতর একটা কষ্ট লুকিয়ে আছে, সেই কষ্টটা আমার কষ্টের সঙ্গে মিলে গেছে।’