এখনকার অনেক শিশু ডাইনোসর বা খেলনা ডাইনোসর খুব পছন্দ করে
এখনকার অনেক শিশু ডাইনোসর বা খেলনা ডাইনোসর খুব পছন্দ করে

শিশুরা কেন খেলনা ডাইনোসর এত পছন্দ করে, এটা কি ক্ষতিকর

খেয়াল করে দেখবেন, এখনকার অনেক শিশু ডাইনোসর বা খেলনা ডাইনোসর খুব পছন্দ করে। কিন্তু কেন শিশুরা এমন অতিকায় একটা প্রাণী এত পছন্দ করে? প্রশ্নটির উত্তর খুঁজেছেন ভারতীয় লেখক তন্ময় গোস্বামী। এ বিষয়ে একটি নিবন্ধও লিখেছেন। নিজের ছেলের ডাইনোসরপ্রীতির রহস্য খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছেন কিছু কারণ।

তন্ময় গোস্বামীর ছেলের বয়স পাঁচ বছর। নিবন্ধে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ‘এ’ নামে। ‘এ’ হঠাৎ একদিন ঘোষণা করল, একটা খেলনা টি-রেক্স তার ছেলে! এই খেলনা ডাইনোসরটি কিনে দেওয়ার আগে পরিস্থিতি অবশ্য অন্য রকম ছিল। আগে ‘এ’ নিজেকে সিংহশাবক ভাবত। একটা জলজ্যান্ত সিংহশাবক পোষার আবদারও করেছিল বাবার কাছে। কিন্তু নতুন টি-রেক্স পাওয়ার পর সিংহের কথা বেমালুম ভুলে গেছে ‘এ’।

‘এ’ এখন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তার ‘ছেলে’, মানে খেলনা টি-রেক্সকে ঘুম পাড়ায়। ব্যাটারিচালিত সবুজ রঙের খুদে ডাইনোসরটির হাত চেপে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে ডাইনোসরটির চোখ দুটি জ্বলে ওঠে। তারপর গরগর করে শব্দও করে।

‘এ’র খেলনা ডাইনোসরের সংগ্রহটা বেশ বড়। এসব ছাড়া তার আছে ডাইনোসর–বিষয়ক অনেক বই, ডাইনোসরের সিনেমা আর কার্টুন–অ্যানিমেশন দেখে তন্ময় হয়ে। বাড়িতে সারাক্ষণ বাজতে থাকে ডিজনির ‘জিগানোটোসরাস’ টিভি সিরিজের গান। তন্ময়ের ভাষায়, ‘বাসায় অন্য কোনো প্রাণী এতটা জায়গা দখল করতে পারেনি; হোক সেটা জীবিত কিংবা বিলুপ্ত।’

ডাইনোসরের বাবা

গবেষকদের মতে, শিশুদের এই ডাইনোসরপ্রীতি কিন্তু নতুন কিছু নয়

কখন থেকে এবং কীভাবে ছেলের এই ডাইনোসরপ্রীতি শুরু হলো, তা বলা তন্ময়ের পক্ষে মুশকিল। তাঁর ধারণা, ‘মনে হয় সে জন্ম থেকেই জানে স্টেগোসরাস আর স্পিনোসরাস আলাদা ধরনের ডাইনোসর। হয়তো এটাও জানে, কেন প্যারাসরোলোফাসের মাথায় ফাঁপা ঝুঁটি ছিল। অবশ্য এখনো বড় কারও আদেশ–নির্দেশ পছন্দ না হলে সে সিংহের মতো গর্জন করে; তবু ডাইনোসরের প্রতি তার ভালোবাসা আলাদা। সে এখন ডাইনোসরের বাবা হওয়ার স্বপ্ন দেখে।’

ডাইনোসর নিয়ে তন্ময় ও তাঁর ছেলের কথোপকথনের একটা নমুনা দেখুন—
তন্ময়: আচ্ছা, তুমি ডাইনোসরদের এত পছন্দ করো কেন?
এ: ডাইনোসর পছন্দ করি কারণ...যখন ওদের সম্পর্কে জানলাম, তখন আমার খুব ভালো লাগল।
তন্ময়: তোমার প্রিয় ডাইনোসর কোনটা?
এ: গর্জন করা ডাইনোসর আমার ভালো লাগে। কিন্তু আমার সবচেয়ে প্রিয় হ্যাড্রোসরাস, যদিও ওরা গর্জন করে না।
তন্ময়: আর টি-রেক্স?
এ: টি-রেক্সও আমার ভালো লাগে। কারণ, ওটা থপথপ করে হাঁটে আর বড় বড় পায়ের ছাপ ফেলে যায়।

ডাইনোসরের ব্যবসা

‘এ’র মতো বাকি শিশুদের এই ডাইনোসরপ্রীতি কিন্তু নতুন কিছু নয়। মার্কিন সাংবাদিক কেট মর্গান ঠিক একই বিষয়ে আরেক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘প্রায় সব শিশুই ডাইনোসর ভালোবাসে। শৈশবে ডাইনোসর–ভক্ত না হলেও আপনি নিশ্চয়ই এমন কাউকে চেনেন, যে ডাইনোসর পছন্দ করত।’

জাদুঘরে ডাইনোসরের ফসিল

ফলে শিশুরা অনায়াসে কয়েক ডজন, এমনকি কয়েক শ ডাইনোসরের বৈজ্ঞানিক নামও মুখস্থ বলতে পারে। ওরা কী খেত, দেখতে কেমন ছিল, কোথায় থাকত—সব প্রশ্নের উত্তর তাদের জানা। মেসোজোয়িক ও ক্রিটেশিয়াস যুগের মধ্যে পার্থক্যও জানে এই শিশুরা। অথচ একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে দশটার বেশি ডাইনোসরের নাম বলতে পারবেন কি না সন্দেহ।

ডাইনোসরের এই তুমুল জনপ্রিয়তাকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে খেলনা, টি-শার্ট থেকে শুরু করে থিম পার্কের বিশাল ব্যবসা গড়ে উঠেছে। আর এই ব্যবসায় চীনের জুড়ি নেই।

ডাইনোসর থিম পার্কের বিশাল ব্যবসা গড়ে উঠেছে বিশ্বের অনেক দেশে

১৯৭০-এর দশকে চীনের জিগং শহরে আবিষ্কৃত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডাইনোসরের ফসিল। এখন জিগং বিশ্বের ৮০ শতাংশ অ্যানিমেট্রনিক বা যান্ত্রিক ডাইনোসর তৈরি ও রপ্তানি করে। চীনে পাঁচ মিটার লম্বা একটি টাইরানোসরাসের দাম প্রায় সাত হাজার ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে খেলনা ডাইনোসরের বাজার ২৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ১৬ লাখ পাউন্ডে।

যুক্তরাজ্যে খেলনা ডাইনোসরের বাজার ২৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ১৬ লাখ পাউন্ডে

ডাইনোসরের জনপ্রিয়তার রহস্য

কিন্তু প্রশ্ন হলো, সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণী কীভাবে এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠল? এর পেছনে কি কোনো মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে?

অনেক মা–বাবা ও সমাজবিজ্ঞানী মিলে এই রহস্য সমাধানের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া ডাইনোসরের ফসিল খুঁজে পাওয়ার মতোই কঠিন। আশি বা নব্বইয়ের দশকে সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে খেলনা হিসেবে ডাইনোসর ছিল না। কিন্তু তখন ছিলেন স্টিভেন স্পিলবার্গ।

‘জুরাসিক পার্ক’ সিনেমাটিকে ডাইনোসরের জনপ্রিয়তার পেছনে একটা বড় কারণ বলে ধরা হয়

এই মার্কিন নির্মাতার ‘জুরাসিক পার্ক’ সিনেমাটি ডাইনোসরের এই জনপ্রিয়তার পেছনে একটা বড় কারণ বলে ধরা হয়। ১৯৯৩ সালে মুক্তি পাওয়ার পর সিনেমাটি বক্স অফিসে ঝড় তোলে বিশ্বব্যাপী এবং ডাইনোসরকে সবার কাছে করে তোলে জনপ্রিয়।

মনোবিদেরা কী বলেন

এই ভালোবাসার পেছনে আরও গভীর কারণ থাকতে পারে। মনোবিদেরা মনে করেন, শিশুরা বড়দের জগতে নিজেদের অনেক ছোট আর অসহায় ভাবে। ডাইনোসরের মতো বিশাল আর শক্তিশালী কিছুকে যখন ওরা ভালোবাসে, তখন নিজেদেরও শক্তিশালী ভাবতে শুরু করে। ওদের মতো গর্জন করে নিজেদের ভেতরের শক্তির প্রকাশ করে।

খেলনা ডাইনোসর শিশুদের সাহস জোগায়

মনোবিদেরা এ–ও মনে করেন, ডাইনোসরের মতো বিশাল প্রাণীর খেলনা দিয়ে খেলে বা ওদের সম্পর্কে জেনে শিশুরা নিজেদের ভয়কে জয় করতে শেখে। ঠিক যেমন বড়রা ভূতের সিনেমা দেখে ভয়কে উপভোগ করেন।

ডাইনোসরের মতো বিশাল প্রাণীর খেলনা দিয়ে খেলে বা ওদের সম্পর্কে জেনে শিশুরা নিজেদের ভয়কে জয় করতে শেখে

মূল বিষয়টা হলো, ডাইনোসরের বিশাল আকার শিশুদের মুগ্ধ করে। শিশুরা যেমন গাড়ি, বাস বা ট্রাকের মতো বড় জিনিস দেখলে কৌতূহলী হয়, ডাইনোসরও তাদের কাছে তেমনই এক বিশাল আকর্ষণের বিষয়।

একদম ছোটরাও খেলনা ডাইনোসর পছন্দ করে

তবে এই ডাইনোসর–সংস্কৃতির পেছনে আরও কিছু গল্প আছে। সে সম্পর্কে হয়তো আমরা অনেকেই জানি না বা কম জানি। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে বড় বড় ধনকুবেররা একসময় নিজেদের সুনাম বাড়াতে বিশাল বিশাল জাদুঘর তৈরি করেন এবং সেখানে ডাইনোসরের ফসিল সাজিয়ে রাখেন। এভাবে ডাইনোসর একটা জনপ্রিয় বিষয়ে পরিণত করা হয়।

বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানের শিশুরা টি–রেক্স বা ট্রাইসেরাটপস চিনলেও নিজেদের দেশের রাজাসরাস বা জাইনোসরাসের নাম জানে না

ভারতীয় উপমহাদেশেও প্রচুর ডাইনোসরের ফসিল পাওয়া গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো কিছু ডাইনোসরের ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে এই উপমহাদেশে। কিন্তু ঔপনিবেশিক শোষণ আর অবহেলার কারণে এই অঞ্চলে ডাইনোসর তেমন পরিচিতি পায়নি। তাই বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানের শিশুরা টি–রেক্স বা ট্রাইসেরাটপস চিনলেও নিজেদের দেশের রাজাসরাস বা জাইনোসরাসের নাম জানে না।

শিশুদের ডাইনোসরপ্রীতি কি খারাপ

এবার মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। শিশুরা কেন ডাইনোসরকে এত পছন্দ করে? আদতে এ প্রশ্নের কোনো নির্দিষ্ট সহজ উত্তর নেই। হয়তো তার দরকারও নেই। কারণ, আনন্দের কারণ বা ব্যাখ্যা জানা সব সময় প্রয়োজনীয় নয়।

শিশুদের খেলনা ডাইনোসরপ্রীতি খারাপ কিছু নয়

আবার শিশুদের এই ডাইনোসরপ্রীতি কিন্তু বেশি দিন থাকে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুদের এ ধরনের তীব্র আগ্রহ সাধারণত দুই থেকে ছয় বছর পর্যন্ত থাকে। স্কুল শুরু হলে আর দশটা বিষয়ের চাপে এই ভালোবাসা বা পছন্দ হারিয়ে যায়।

তাই শিশুদের এই খেলনা ডাইনোসরপ্রীতি খারাপ কিছু নয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর দশটা খেলনার মতো খেলনা ডাইনোসরের প্রতি আগ্রহেও ভাটা পড়ে, মিলিয়ে যায়।

সূত্র: মিডিয়াম