রংপুরের নিসবেতগঞ্জে পাট দিয়ে শতরঞ্জি বুনত কয়েকটি পরিবার। তবে বিশেষ কোনো চাহিদা না থাকায় ধীরে ধীরে নাই হয়ে যাচ্ছিল এই শিল্প। নিজেদের অঞ্চলের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে এবং দেশে ও দেশের বাইরে শতরঞ্জিকে ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নেন শফিকুল আলম সেলিম। তখনো যাঁরা শতরঞ্জি তৈরি করতেন, তাঁদের মাধ্যমে যাঁরা আগে থেকেই এ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের একটা তালিকা করলেন শফিকুল। নানা কারণে পেশা বদল করে ফেলেছিলেন কারিগরেরা। শতরঞ্জি তৈরিতে আগ্রহী সবাইকে জড়ো করে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন শফিকুল। তাঁদের শতরঞ্জি তৈরিতে উৎসাহ দেন। জানান, বিক্রির ব্যবস্থা তিনি করবেন। এভাবেই মৌলিক কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের হাত ধরে ১৯৯১ সালে পথচলা শুরু করে ‘রংপুরের শতরঞ্জি’।
১৯৯৪ সালে রংপুরের শতরঞ্জিকে ঢাকায় নিয়ে আসেন শফিকুল আলম সেলিম। কিন্তু ঢাকায় আসার পরও শতরঞ্জির জনপ্রিয়তা তেমনভাবে বাড়ছিল না। এর একটা অন্যতম কারণ, অ্যালার্জি। শতরঞ্জি তৈরির মূল উপকরণ ছিল পাট। শতরঞ্জির মধ্যে থাকা পাটের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঁশে অনেকের অ্যালার্জি হচ্ছিল। বিষয়টি আমলে নেন শফিকুল আলম। পাট গবেষণাকেন্দ্রে গিয়ে পাটকে কীভাবে ‘প্রক্রিয়াজাত’ করে ব্যবহার করবেন, আঁশের সমস্যা কমিয়ে আনবেন, সেই বিষয়ে পরামর্শ নেন। নিজেদের কর্মীদেরও সেভাবে প্রশিক্ষণ দেন। ১৯৯৫ সালে পাট ছাড়াও সুতি, উলের সুতা, অ্যাক্রিলিক সুতা—এ রকম নানা বিষয় দিয়ে নকশাদার শতরঞ্জি তৈরি শুরু করেন। এরপর রঙিন নকশাদার শতরঞ্জির প্রদর্শনী করেন ১৯৯৬ সালে। কয়েকটি প্রদর্শনীর পর শতরঞ্জির প্রচার আর প্রসার বাড়ে। দেশের বাইরে থেকেও ফরমাশ আসতে শুরু করে। ২০০০ সালে জার্মানির একটি মেলা থেকে আমন্ত্রণ পায় রংপুরের শতরঞ্জি। এরপরই বিভিন্ন দেশে কদর বাড়ে রংপুরের শতরঞ্জির। ২০২২ সালে এসে বিশ্বের ৭০টি দেশে এখন রপ্তানি হচ্ছে রংপুরের শতরঞ্জি।
রংপুরের ঐতিহ্যবাহী এই শতরঞ্জি পেল ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআইএর স্বীকৃতি। এ সম্পর্কে শফিকুল আলমের ছোট ভাই সাইফুর রহমান লেলিন বলেন, এর আগে বাংলাদেশের জামদানি, মসলিন, ইলিশ মাছ—এগুলো এই স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বীকৃতি দেওয়ার আগে পণ্যটি আর্থসামাজিক পরিবর্তনে কেমন ভূমিকা রাখছে, ভৌগোলিক বা পরিবেশগত প্রভাব, আন্তর্জাতিকভাবে কতটা সুনাম অর্জন করতে পারছে—এগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়।
সোমবার ধানমন্ডিতে নিজেদের শাখায় একটি বিশেষ আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি উদ্যাপন করে রংপুরের শতরঞ্জি। পুরোনো শাখাটিকে নতুনভাবে সাজিয়েছেন তাঁরা। শতরঞ্জির পাশাপাশি কচুরিপানা, খড়, তামা, লোহা—এ রকম দেশি উপাদানে তৈরি বিভিন্ন পণ্য নিয়েও কাজ শুরু করবেন তাঁরা।