সালটা ১৯৭২। অভিজাত এলাকা গুলশানের অনেক অংশই তখন ঘন জঙ্গল। ৫২ কাঠার সে রকমই একটা জায়গা সে সময়ে ২০ হাজার টাকা কাঠায় কিনেছিলেন দিঠি আনোয়ারের শ্বশুর। সেই জায়গার ওপর নির্মিত তিনতলা একটি বাড়িতে থাকেন সংগীতশিল্পী। সেই বাড়িই ঘুরে দেখলেন তানজিনা আলম
গেট দিয়ে ঢুকতেই বাঁয়ে বিশালাকৃতির একটা সুইমিংপুল। স্বচ্ছ নীল পানির নিচে তিমি প্রতিকৃতির টাইলস। ক্লান্ত লাগলেই এখানে নেমে পড়েন দিঠি আনোয়ার। শরীর ও মনের জন্য সাঁতার যে একটি ভালো ব্যায়াম, এ কথা সব সময়ই তাঁর মাথায় থাকে। তাই শীতকাল বাদ দিয়ে সারা বছরই এটি ভীষণ কাজে আসে বাড়ির সবার।
পুল পার হয়ে সামনে একটু এগিয়ে গেলেই বিশাল খেলার মাঠ। চারদিক ঘিরে আছে শোভাবর্ধক ফুলের গাছ। শুধু ফুলই নয়, এই বাগান থেকে মেলে নানা রকম ফল ও সবজি। দিঠি আনোয়ার বলেন, ‘বাৎসরিক আম, কাঁঠালসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল আমরা এখান থেকেই পাই। এ মাঠে সন্তানের বন্ধুরা এসে খেলে ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি।’ ছোটখাটো অনুষ্ঠানও এ মাঠেই আয়োজন করেন। মাঠ ঘুরে গাছের সঙ্গে পরিচয় করাতে করাতে জানান, সব সময় একটু খোলামেলা পরিবেশে থাকতে পারি, এর চেয়ে ভালো আর হয় না।
শুধু মাঠেই নয়, পুরো বাড়িতেই সবুজের সমারোহ। এ বাড়ি যখন তৈরি হয়, তখন সবে সংসারে প্রবেশ করেছেন দিঠি আনোয়ার। বাড়ির মূল নকশায় তাই তাঁর ভূমিকা ছিল না। তবে বাড়ির অন্দরসজ্জায় তাঁর বিশেষ ভূমিকা আছে। দ্বিতীয় তলার ফটক খুলে ভেতরে ঢুকতেই বিশাল বারান্দা। এ বারান্দার সামনেও আবার একটি খোলা বারান্দা। এখানে চেয়ার–টেবিল পেতে বসলে গুলশানের ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ির চলাচল ও মানুষের পদচারণ দেখা যায় সারাক্ষণ।
বাড়ির ভেতর ঢুকতেই ডানে ডাইনিং আর রান্নাঘর, বাঁ দিকে ড্রয়িংরুম। এখানের সব আসবাব সবুজ আর বেগুনির মিশেলে। শিল্পী জানালেন, সবুজ রং তাঁর ভীষণ পছন্দ। আর মীন রাশির জাতক বলে স্বভাবতই বেগুনিও তাঁকে টানে।
সংগীত যাঁর রক্তে, তাঁর বাড়ি গানের সরঞ্জামেই সাজবে, এ-ই তো স্বাভাবিক। তাই আনুষ্ঠানিক ও আটপৌরে দুটি ড্রয়িংরুমেই শোভা পাচ্ছে পিয়ানো। এর মধ্যে একটি পেয়েছেন বিয়ের পর সংগীত অনুরাগী শাশুড়ির কাছ থেকে। জানা গেল, পিয়ানোটি কম করে হলেও ৫০ বছরের পুরোনো। আরেকটি হালফ্যাশনের। সেটি মূলত দিঠির বড় সন্তানই ব্যবহার করেন বেশি।
এ কামরার দেয়ালের একদিকে পুরস্কার, সম্মাননা, দেয়ালচিত্রের সঙ্গে শোভাবর্ধন করছে তাঁর বিয়ের ওড়না দিয়ে তৈরি বিশাল একটি ফ্রেম। বিয়ের এবং ভালোবাসার স্মৃতির ভিন্ন এক উপস্থাপন।
ঐতিহ্যবাহী পুরোনো জিনিসের প্রতিও তাঁর ঝোঁক আছে। বসার ঘরে দিঠির জীবনের প্রথম সেতারও পরিপাটি করে সাজানো আছে। বাড়ির আসবাব কিংবা পর্দায় স্পষ্ট এই শিল্পীর পছন্দের বার্তা। ভিনটেজ আর ফুলের মোটিফের সবকিছুই ভীষণ পছন্দ করেন তিনি।
দোতলার মোট চারটি কামরার ভেতরে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী একটিতে আর দুই সন্তান দুটোয় থাকেন। অন্যটি অতিথিদের জন্য বরাদ্দ। চারটি ঘর ছাড়াও একটি কক্ষে আছে ব্যায়ামের সরঞ্জাম আর গানের বাদ্যযন্ত্র।
রুমের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দা থাকলেও দিঠির পছন্দ নিচের মাঠের দিকে মুখ করা বাড়ির মাঝের খোলা অন্য একটি বারান্দা। বন্ধুবান্ধব নিয়ে এ বারান্দায় আড্ডা দেন তিনি। এখান থেকে বৃষ্টি সবচেয়ে সুন্দর দেখা যায়। এখানে এসে বসলে গুনগুন করে গান ধরতে একদণ্ড সময় লাগে না। আশপাশ খোলামেলা বলে বছরজুড়েই পাওয়া যায় পর্যাপ্ত রোদ আর আলো–বাতাস।
নিজের ঘর পেরিয়ে সন্তানদের ঘরে যাওয়ার পথের দেয়ালে রেখেছেন বাবা গাজী মাজহারুল আনোয়ারের একটি ফটো গ্যালারি। সন্তানদের ঘরে যাওয়ার সময় সদ্য প্রয়াত বাবাকেও দেখা হয়ে যায়। এই দেয়ালে ছবি ছাড়াও ফ্রেমে বাঁধা আছে বাবার হাতে লেখা কাগজপত্র। দিঠি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে এসব ছুঁয়ে দেখলেও বাবার অস্তিত্ব খানিকটা অনুভব করা যায়।’ মেয়ের এই বাড়িতে বসেই অনেক কালজয়ী গান রচনা করেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। আর মেয়ের শাশুড়ি বন্ধু হওয়ায় যেন মেয়ের বাসায় নয়, বন্ধুর সঙ্গেই আড্ডা দিতে আসতেন মাজহারুল আনোয়ার।
আলোর প্রতি দিঠি আনোয়ারের বিশেষ দুর্বলতা আছে। তাই এ বাড়িতে আলোকবাতির নানা রকম শেডের দেখা মিলবে। ঘরজুড়ে ছোট–বড় অন্তত ৩০টি আলোকবাতি।
দেয়ালজুড়ে বন্ধু, সন্তান, প্রিয়জনদের বিভিন্ন ছবি যেন ইতিহাসের সাক্ষী। জীবনের ফেলে আসা সময়কে মুহূর্তেই চোখের সামনে এনে দেয় এসব ছবি।
দিঠি আনোয়ার বলেন, ‘সারা দিন কাজ এবং কর্মব্যস্ততার পর ঘরে এসেই কেবল শান্তির নিশ্বাস নেওয়া যায়। আমার এ আপন আলয় তাই নিজের মতো করেই সাজিয়ে নিয়েছি।’