
মাত্র ১০টি বই নিয়ে শুরু। ‘সারপুকুর যুব ফোরাম পাঠাগার’–এ এখন বই আছে ১৫ হাজার। পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মানুষকে বই পড়তেও উৎসাহিত করে চলেছেন লালমনিরহাটের জামাল হোসেন। তাঁর আরও গল্প শোনাচ্ছেন কাজী আলিম-উজ-জামান
ঢাকার একটি কলেজে স্নাতকোত্তর পড়ছেন জামাল হোসেন। পড়াশোনার জন্য ঢাকায় থাকলেও তাঁর ধ্যানজ্ঞান নিজ গ্রাম টিপারবাজার। আদিতমারীর এই গ্রামে একটা পাঠাগার গড়ে তুলেছেন এই তরুণ, মানুষকে বই পড়াতে উৎসাহিত করতে এলাকায় নিয়েছেন নানা উদ্যোগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেসব দেখে তাঁর সঙ্গে প্রায় আট বছর ধরে পরিচয়। তবে সামনাসামনি দেখা হলো গত মাসের মাঝামাঝি। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত এক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসেছিলেন। সেই প্রশিক্ষণ–শিবিরেই সরাসরি আলাপ। জানালেন অনেক স্বপ্নের কথা।
পাঁচটি শ্রেণিতে ১২ জন তরুণকে গত ১৫ সেপ্টেম্বর ‘ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’ দিয়েছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। প্রবীণদের প্রতি সেবা ও সমাজকল্যাণে অবদানের জন্য এই পুরস্কার পেয়েছেন জামাল হোসেন। সেই স্বীকৃতির কথা মনে করিয়ে দিতেই মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর। তারপর জানতে চাইলাম ‘সারপুকুর যুব ফোরাম পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠার গল্প।
চার ভাই–বোনের মধ্যে জামাল হোসেন তৃতীয়। তাঁর বাবা আবদুল ছাত্তার একজন অবসরপ্রাপ্ত আনসার সদস্য, মা সাহেরবানু বেগম গৃহিণী। ব্র্যাকের একটি প্রাথমিক স্কুলে জামালের হাতেখড়ি। তারপর এলাকার হরিদাস উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েই স্কাউটিং দলে যোগ দেন। স্কাউটিংয়ের মাধ্যমেই সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী কাজে জড়িয়ে পড়া। তখন থেকেই অন্যের কষ্ট তাঁকে পীড়া দিত। বললেন, ‘কোনো বন্ধু কাঁদলে আমার খুব খারাপ লাগত।’
এই সহানুভূতিই তাঁকে সামাজিক কাজের পথে টেনে আনে। ২০১৪ সালে অষ্টম শ্রেণিতে থাকতে বন্ধুদের নিয়ে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। নিজের জমানো ৭৫০ টাকা দিয়ে ১০টি বই কিনে শুরু হয় ‘সারপুকুর যুব ফোরাম পাঠাগার’।
তারপর দিনে দিনে বেড়েছে বইয়ের সংখ্যা, এখন বই আছে ১৫ হাজার। সেই সঙ্গে বেড়েছে পাঠাগারের কলেবর। জামাল কলেজের গণ্ডি পেরোতে পেরোতেই টিনশেড ঘর পায় পাঠাগার। এখন এই পাঠাগার পাকা হয়েছে। ত্রিতল ভবনের ভিত্তির ওপর গড়া হয়েছে প্রথম তলা। ৫ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত সারপুকুর যুব ফোরাম পাঠাগার। এটি তাঁদের নিজস্ব জমি। পরে পাঠাগারের নামে লিখে দিয়েছেন তাঁর বাবা। সাহিত্য, ইতিহাস, গবেষণা, জীবনী, ভ্রমণ, বিজ্ঞান, ধর্ম, সংস্কৃতিসহ প্রায় সব বিষয়ে বই রয়েছে। আর বই পড়ার পাশাপাশি গান, কবিতা আবৃত্তিও শেখানো হয় শুক্র ও শনিবার।
২০১৬ সালে একদিন সেলুনে চুল কাটাতে গিয়ে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় জামালকে। এই সময়ে খেয়াল করলেন, চুল কাটাতে আসা অন্যদেরও সময় যেন আর কাটতে চায় না। কেউ কেউ মুঠোফোনে সময় পার করেন।
তখনই তাঁর মাথায় চিন্তা আসে—সেলুনে অপেক্ষার সময়টাকে কাজে লাগানো যায় না? প্রতিষ্ঠা করেন ‘সেলুন লাইব্রেরি’। মানে একটা তাকে কয়েকটা বই রাখা। অপেক্ষায় থাকা মানুষেরা যেন পড়তে পারেন। ওই বছরই লালমনিরহাটে ৩০টি সেলুনে বসানো হয় বইয়ের তাক। বর্তমানে ১ হাজার ২৩৪টি সেলুনে ছড়িয়ে গেছে এই লাইব্রেরি। প্রতিটি সেলুনে ১৫-২০টি করে বই রাখা আছে—গল্প, উপন্যাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে শুরু করে কৃষকের নানা প্রয়োজনীয় বই।
২০২০-২১ অর্থবছরে জামালের সেলুন লাইব্রেরি থেকে বেছে বেছে ১০০টি সেলুন নিয়ে একটি প্রকল্প চালু করে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, যা এখনো চলমান।
শুধু পাঠাগারে সীমাবদ্ধ নেই জামাল ও তাঁর বন্ধুদের কাজ। সারপুকুর যুব ফোরাম পাঠাগারের মাধ্যমে চলছে বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচি, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, মাদকবিরোধী আন্দোলন, দলিত ও হিজড়া সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়ন, বৃক্ষরোপণসহ নানা কাজ। জাতীয় যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ৬৪টি জেলার ১৯২টি প্রতিষ্ঠানে যুব নেতৃত্ব বিকাশেও কাজ করছেন তিনি।
জামালের এই পথচলা মসৃণ ছিল না। অনেকে বলতেন, ‘ছাত্র মানুষের কাজ পড়াশোনা, পাঠাগার করে কী হবে? মানুষ তো বই পড়ে না!’ তবু হাল ছাড়েননি জামাল। পাঠাগার প্রতিষ্ঠা ও পরবর্তী যাত্রায় স্থানীয় অনেক মানুষের সহযোগিতা পেয়েছেন জামাল। অনুদান, সদস্যদের চাঁদা, উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এগিয়ে চলেছে তাঁর পাঠাগার কার্যক্রম। তরুণসমাজকে আরও বইমুখী করতে চান জামাল।