রেস্তোরাঁ, হোটেল কিংবা সেলুনের মতো জায়গায় সেবা পেয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশের অন্যতম উপায় টিপস বা বকশিশ
রেস্তোরাঁ, হোটেল কিংবা সেলুনের মতো জায়গায় সেবা পেয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশের অন্যতম উপায় টিপস বা বকশিশ

কাকে, কখন ও কত টাকা টিপস বা বকশিশ দেবেন

রেস্তোরাঁ, হোটেল কিংবা সেলুনের মতো জায়গায় সেবা পেয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশের অন্যতম উপায় টিপস বা বকশিশ। তবে এই টিপস নিয়ে অনেক সময় বিব্রতকর বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়। সব মিলিয়ে কোথায়, কাকে, কেন ও কত টাকা টিপস দেবেন, এ নিয়ে প্রায়ই দ্বিধায় পড়ি আমরা। এসবের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হলো এই লেখায়।

টিপস বা বকশিশ কী?

ইংরেজি ‘টিপস’ শব্দটির বাংলা অর্থ ‘বকশিশ’। বাংলা একাডেমি প্রণীত অভিধান অনুযায়ী ‘বকশিশ’ মানে পারিতোষিক, পুরস্কার, উপহার, পাওনার ওপর দেওয়া অথবা অতিরিক্ত কিছু দেওয়া। অর্থাৎ কারও কোনো কাজ বা সেবায় খুশি হয়ে তাঁকে অতিরিক্ত যা দেওয়া হয়, তা–ই বকশিশ।

টিপসের উৎপত্তি

১৬ শতকে ইউরোপের কফি হাউস ও পানশালাগুলো হয়ে উঠেছিল নিয়মিত আড্ডাখানা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে বসে কফি, পানীয় ও চা–নাশতার ফাঁকেই চলত আড্ডা। লোকের ভিড়ে সেবা দিয়ে কুলাতে পারতেন না ওয়েটাররা।

অতিথিদের ফরমাশ নিতে ও সেবা দিতে দেরি হতো তাঁদের। বিরক্ত হতেন খদ্দেররা। এ সমস্যা সমাধানে একটি বুদ্ধি বের করেন রেস্তোরাঁর মালিকেরা।

টিপস দেওয়ার ব্যাপারে অনেকটাই সংযত ইউরোপের দেশগুলো

রেস্তোরাঁর কাউন্টার ও দরজার পাশে একটি করে বাটি বা কৌটা রাখতে শুরু করেন তাঁরা। তাতে লেখা থাকত, ‘টু ইনশিওর প্রম্পটিচুড (To Insure Promptitude)’, যার বাংলা অর্থ ‘দ্রুত সেবার নিশ্চয়তার জন্য’।

ইংরেজি বাক্যটির তিনটি শব্দের প্রথম অক্ষরগুলো (T, I, P) নিয়ে তৈরি হয় নতুন শব্দ ‘টিপ’। রেস্তোরাঁর খদ্দের দ্রুত সেবা পাওয়ার আশায় টিপ লেখা কৌটায় পয়সা ফেলতেন আর দ্রুত সেবা দিতে হাসিমুখে এগিয়ে যেতেন ওয়েটাররা। এই নিয়ম দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

টিপস যখন সামাজিক মর্যাদার প্রতীক

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টিপস বা বকশিশ দেওয়া হয়ে উঠেছিল আভিজাত্যের প্রতীক। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ধনীরা নিয়মিত টিপস দিতেন। গৃহকর্মী, কোচম্যান, গাড়িচালক, ওয়েটার ছাড়া যাঁর কাছ থেকেই সেবা নেওয়া হতো, তাঁকে সেবার দামের বাইরে অতিরিক্ত কিছু টাকা দেওয়া হতো।

ভালো সেবা পাওয়ার পাশাপাশি এটিকে সামাজিক মর্যাদা বজায় রাখার একটি কৌশল মনে করতেন সেবাগ্রহীতারা। টিপস পেয়ে খুশি হতেন সেবাদাতাও।

১৮ ও ১৯ শতকে ইউরোপের রেস্তোরাঁ, হোটেল আর ঘোড়ার গাড়ির সেবায় টিপস ছিল স্বাভাবিক বিষয়। ফ্রান্সে এটিকে দেখা হতো কৃতজ্ঞতার প্রতীক হিসেবে।

আজকের যুক্তরাষ্ট্রে একপ্রকার বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে টিপস

মার্কিন মুলুকে কেন টিপস নিষিদ্ধ হয়েছিল

ইউরোপ, বিশেষত ফ্রান্স পেরিয়ে টিপসের সংস্কৃতি যখন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাল, তখনই বিপত্তি বাধল। ১৯ শতকের গৃহযুদ্ধের পর সদ্য মুক্তি পাওয়া দাসদের অনেকেই রেস্তোরাঁ আর রেলওয়ের চাকরিতে যোগ দেন।

এই শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি না দিয়ে তাঁদের গ্রাহকদের টিপসের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করেন মালিকেরা। ফলে সে সময় টিপস হয়ে ওঠে ‘শ্রম শোষণের’ প্রতীক।

টিপসের ওপর নির্ভর করত শ্রমিকের জীবনমান। পর্যাপ্ত টিপস পাওয়াও ছিল ভোগান্তির। এ নিয়ে সে সময় শ্রমিকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে টিপস দেওয়া–নেওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে এখন কী অবস্থা

আজকের যুক্তরাষ্ট্রে একপ্রকার বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে টিপস। সেখানকার রেস্তোরাঁগুলোয় সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ টিপসও দাবি করে বসেন সেবাদাতারা। অর্থাৎ টিপস দেওয়াকে প্রায় বাধ্যতামূলক করে ফেলেছেন তাঁরা।
সেবা দেওয়ার আগেই টিপস দাবি করছেন সেবাদাতারা।

এ নিয়ে সাধারণ গ্রাহকদের অভিযোগেরও শেষ নেই। তাঁদের কথা, সেবা ভালো লাগলে টিপস দেব, আগে দেব কেন? কিন্তু কে শোনে কার কথা! টিপস না পেলে আজকাল সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন সেখানকার সেবাদাতারা।

জাপানে কেউ টিপস দিলে সেটিকে অভদ্রতা ভাবা হয়

ইউরোপ ও এশিয়ায় কী চলছে

টিপস দেওয়ার ব্যাপারে অনেকটাই সংযত ইউরোপের দেশগুলো। যেমন কখনো সেটা ‘বিল রাউন্ড’ করে দেওয়া, আবার কখনো স্বল্প পরিমাণে বাড়তি টাকা দেওয়া।

এশিয়ায় টিপসের চিত্রটা আবার আলাদা। জাপানে কেউ টিপস দিলে সেটিকে অভদ্রতা ভাবা হয়। কারণ, তাঁরা মনে করেন, ভালো সেবা দেওয়া সেবাদাতাদের দায়িত্বের অংশ। কিন্তু ভারত, মিসর কিংবা তুরস্কে ছোটখাটো বকশিশ খুবই সাধারণ বিষয়। জোরাজুরি নেই, তবে দিলে খুশি হন সেবাদাতারা।

বাংলাদেশের চিত্র

যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশে টিপসের জন্য সেবাদাতারা গ্রাহককে জোরাজুরি হয়তো করেন না, তবে মার্কিন মুলুকের মতো এ দেশেও রেস্তোরাঁর ওয়েটারদের আয় ও তাঁদের জীবনমান অনেকটাই নির্ভর করে গ্রাহকদের দেওয়া টিপসের ওপর।

রাজধানীর ধানমন্ডি, নিউমার্কেট ও তেজগাঁও এলাকার বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁর ওয়েটারদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা যায়।

আরও জানা যায়, রাজধানীর অভিজাত রেস্তোরাঁগুলোয় ওয়েটারের কাজ করতে হলে শিক্ষাগত যোগ্যতা অন্ততপক্ষে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হতে হয়। সঙ্গে নিতে হয় বেশ কয়েক ধরনের প্রশিক্ষণও। সে ক্ষেত্রে বেতনও তুলনামূলক বেশি হয়।

অভিজ্ঞতাভেদে অভিজাত রেস্তোরাঁর ওয়েটারদের বেতন ২৫ হাজারের বেশি হয়। শহরের একটু ভালো মানের রেস্তোরাঁগুলোয় ওয়েটারদের মাসিক বেতন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা।

ভাতের হোটেলের ওয়েটারদের ক্ষেত্রে সেটা ৮ থেকে ১২ হাজার টাকা হয়। প্রায় সব ধরনের রেস্তোরাঁর ওয়েটারদের আয়ের একটি অংশ আসে টিপস থেকে।

আজকাল অনেক রেস্তোরাঁয় খাবারের দামের সঙ্গে সার্ভিস চার্জ বা অতিরিক্ত টাকা আলাদা করে দিতে হয়

ধানমন্ডির একটি ফাস্ট ফুড রেস্তোরাঁয় প্রায় দুই বছর ধরে কর্মরত এক ওয়েটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চাকরির শুরুতেই মালিকপক্ষ জানিয়ে দেয়, টিপস থেকে আয় হবে, তাই বেতন কম। গ্রাহকদের কাছ থেকে তো আমরা জোর করে টিপস আদায় করতে পারি না। কত টাকা দেবেন, তারও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অথচ অনেক সময় এই টিপস দিয়েই আমাদের জীবন চালাতে হয়।’

‘টিপস পাই, এই অজুহাতে বছরের পর বছর একই বেতনে কাজ করতে হয় আমাদের।’ বলছিলেন ফার্মগেটের একটি ভাতের হোটেলের এক ওয়েটার। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় টিপস থেকেও টাকা কেটে রাখে মালিকপক্ষ।’

সার্ভিস চার্জ আর টিপস কি একই বিষয়

সাধারণত কখন টিপস দেন না? যতজনকে এ প্রশ্ন করা হলো, তাঁদের সবার উত্তর, ‘খাবার বা সেবার দামের সঙ্গে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ নিলে টিপস দিই না।’

আজকাল অনেক রেস্তোরাঁয় খাবারের দামের সঙ্গে সার্ভিস চার্জ বা অতিরিক্ত টাকা আলাদা করে দিতে হয়। রেস্তোরাঁর কর্মীদের কাছ থেকে জানা যায়, সাধারণত এই টাকার পুরোটা নয়; বরং আংশিক পান ওয়েটাররা। তাই এটিকে আদতে টিপস হিসেবে দেখেন না তাঁরা।

কাকে, কখন ও কত টাকা টিপস দেবেন

রেস্তোরাঁর ওয়েটার, হোটেল বয় কিংবা সেলুনের নাপিতের কাজ ও সেবায় খুশি হয়ে নিজে থেকেই টিপস দেন অনেকে

বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ আইন ২০১৪–তে টিপস বা সার্ভিস চার্জ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা দেওয়া নেই। যুক্তরাষ্ট্রের মতো সেবার মূল্যের কত শতাংশ, এ নিয়েও কোনো নিয়মনীতি নেই।

রেস্তোরাঁর ওয়েটার, হোটেল বয় কিংবা সেলুনের নাপিতের কাজ ও সেবায় খুশি হয়ে নিজে থেকেই টিপস দেন অনেকে। তাই কত টাকা দেবেন, সেটা আপনার সামর্থ্য ও ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তবে টিপস দেওয়ার আগে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন।

  • বিলে আলাদাভাবে সার্ভিস চার্জ যুক্ত থাকলে টিপস না দিলেও ক্ষতি নেই। কারণ, সেখান থেকে একটি অংশ কর্মীকে দেওয়া হয়।

  • অতিরিক্ত কোনো সার্ভিস চার্জ না থাকলে এবং ওয়েটার বা অন্য যেকোনো সেবাদাতার সেবায় সন্তুষ্ট হলে তাঁকে পুরো বিলের ১০ শতাংশ টিপস আলাদাভাবে দিতে পারেন।

  • রেস্তোরাঁ, সেলুন ও চায়ের দোকানের বিল দেওয়ার সময় বিল রাউন্ড করে দিতে পারেন। যেমন আপনার বিল যদি ৪৭৫ টাকা হয়, তাহলে আপনি ৫০০ টাকা দিতে পারেন।

  • যেসব রেস্তোরাঁয় সেলফ সার্ভিস চালু আছে, সেখানে টিপস দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

  • যদি ওয়েটার বা হোটেলকর্মী আপনাকে ভালো সেবা দেন, যেমন হোটেলকর্মী যদি আপনার ব্যাগ বইতে সাহায্য করেন, বাইরে থেকে কোনো কিছু এনে দেন, খাবার দ্রুত নিয়ে আসেন, ভালো টেবিল দেন, তাহলে তাঁকে অতিরিক্ত কিছু টাকা দিতে পারেন। সেটা ন্যূনতম ২০ থেকে ১০০ টাকা, ২০০ টাকা বা এর বেশিও হতে পারে।