
সদ্যই বাবাকে হারিয়েছেন কেউ, কেউবা সেই শৈশবে, কারও বাবা আছেন বৃক্ষের মতো ছায়া হয়ে। তবে সবার বেড়ে ওঠায় মিশে আছে বাবার আদর, শাসন, অনুপ্রেরণা। প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার পালিত হয় বাবা দিবস। সেই হিসাবে কাল বাবা দিবস। দিনটি উপলক্ষে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে ছাপা হয়েছে বাবাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কয়েকজন সন্তানের লেখা। এখানে তেমনই একটি লেখা।
বাবা বেঁচে থাকলে এখন তাঁর বয়স হতো ৫৯ বছর। ২০০৫ সালে ৮ বছর বয়সেই আমি তাঁকে হারিয়েছি। তাই বাবার সঙ্গে খুব বেশি স্মৃতি নেই। ফুটবলার হিসেবে ‘মোনেম মুন্না’ নামের ওজন আন্দাজ করার মতো বয়সটাও তখন আমার হয়নি।
তবে মনে আছে, বাবা ফুটবল মাঠে ডিফেন্ডার পজিশনে খেলতেন বলে তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা করতাম। তখন মনে করতাম স্ট্রাইকার কিংবা মিডফিল্ডারই যেহেতু বেশির ভাগ গোল করেন, তাই তাঁরাই মূল খেলোয়াড়। বাবাও তখন ছোট্ট আমাকে পাল্টা যুক্তি দিয়ে বোঝাতেন, ফুটবল মাঠে ডিফেন্ডারের গুরুত্ব কতটা।
বাবাকে হারানোর পর ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেছি, সারা দেশের মানুষের কাছে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও আমার বাবার অনেক ভক্ত ছিলেন। মায়ের মুখে শুনেছি, বিয়ের আগে এমনকি বিয়ের পর বেশ কিছুদিন পর্যন্ত আমার আম্মুও জানতেন না যে তাঁর স্বামী এত বড় ফুটবলার! ১৯৯৩ সালের একটা ঘটনা বলতেন তিনি। বিয়ের কিছুদিন পরের কথা, অমর একুশে বইমেলায় একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে গেছেন বাবা। আম্মুও বাবার সঙ্গে গেছেন। সেখানে বাবাকে একনজর দেখার জন্য আর অটোগ্রাফের জন্য মানুষের হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। একপর্যায়ে মানুষের জমায়েত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা উপায় না পেয়ে মা-বাবাকে নিরাপত্তা দিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে আনেন। ওই ঘটনার পর তাঁর স্বামীর জনপ্রিয়তা আন্দাজ করতে পারলেন আম্মু।
তবে এত জনপ্রিয়তার পরও বাবা কখনো অহংকার দেখাতেন না। সাধারণ জীবনযাপন পছন্দ করতেন। বাবা সব সময় চাইতেন, আমি ও আমার বোন যেন আমাদের নিজ নিজ পরিচয়ে বড় হই। বাবার নাম ব্যবহার করে বাড়তি সুবিধা নেওয়া তিনি কখনোই পছন্দ করতেন না। এই কারণে তিনি আমাদের ফুটবলার বানানোর ব্যাপারেও আগ্রহ দেখাননি। বাবার উপদেশ ছিল, নিজের মতো করে বড় হও। আর যেই কাজই করো না কেন, সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে ওই কাজে সেরা হও। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যদি বাবা হওয়ার সৌভাগ্য দেন, আমার সন্তানকেও আমি এই উপদেশই দেব।
খেলাধুলায় বাবা যেমন সেরা ছিলেন, পরিবারের কর্তা হিসেবেও ছিলেন অসাধারণ। ৯ ভাইবোনের বড় পরিবারের সন্তান হিসেবে বাবা বেশ কষ্ট করে বড় হয়েছেন। যত দিন বেঁচে ছিলেন, সব ভাই-বোনের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন। সতীর্থ খেলোয়াড়, কোচ, সাংবাদিক এমনকি মাঠের কর্মীদের সঙ্গেও ছিল বাবার সমান যোগাযোগ। ফলে এখনো আমার বাবাকে সম্মান করে মানুষ। বাংলাদেশেও মানুষ আমাদের সঙ্গে দেখা হলে বাবার প্রশংসা করেন। এটাই আমাদের পরিবারের জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া।
আমি যখন একটু বড় হয়েছি, তখন থেকেই দেখতাম বাবা অসুস্থ। বাবা চলে যাওয়ার পর আম্মু একা সব সামাল দিয়েছেন। বাবার অভাব বুঝতে দেননি। বাবা না থাকায় আমিও হয়তো কম বয়সেই নিজের অজান্তে মানসিকভাবে পরিপক্ব হয়ে গেছি। তবে জীবনের বিশেষ কিছু কিছু দিনে বাবাকে অনেক মিস করি। যখন বিয়ে করলাম তখন মনে হয়েছে, আজ বাবা থাকলে হয়তো অনেক খুশি হতেন।