শীত-শীত রোদ হাতছানি দিয়ে এক বিকেলে টেনে নিয়ে গিয়েছিল রমনা পার্কে। একটা চক্কর দিয়ে লেকের পাশে রেলিংয়ে ভর দিয়ে একটু দাঁড়িয়েছি। পাশেই দাঁড়ানো দুই তরুণের কথোপকথন কানে এল।
কথা বলছেন আসলে একজনই। আরেকজন নীরব শ্রোতা। একটা কথা শুনে একটু উৎকর্ণ হয়ে উঠলাম, ‘কাল স্টেডিয়ামে ফ্রি ফুটবল খেলা দেখলাম। দারুণ লাগল।’
এরপর সেই খেলার বর্ণনা। যা শুনে এই তরুণের সঙ্গে একটু কথা না বলে পারলাম না। যে ‘ফুটবল খেলা’র কথা বলছেন, সেটি যে ইস্পাহানি-প্রথম আলো আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল, এটা তো বুঝেই ফেলেছি। কথা বলে জানলাম, ওই তরুণ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে পাঞ্জাবি বিক্রি করেন। ফুটবল খেলা খুব পছন্দ; কিন্তু টিকিটের টাকা খরচ করে সব সময় স্টেডিয়ামে ঢোকা হয় না।
সেমিফাইনাল যেহেতু দেখেছেন, তাই ফাইনালটা কেন বাদ থাকবে? ওই দুই তরুণকে পরদিনের ফাইনাল দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম। ফাইনালেও টিকিট লাগবে না জানার পর সোৎসাহে তাঁরা খেলা শুরুর সময়টা জেনে নিলেন। এআইইউবি ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যকার ফাইনালে ওই দুজনকে খুঁজে বেড়াল আমার চোখ। হয়তো এসেছিলেন; কিন্তু দুই পাশের দুই গ্যালারিতে ফাইনালের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভিড়েই হয়তো হারিয়ে গেছেন।
ঘটনাটা বলার কারণ আছে। ইস্পাহানি-প্রথম আলো আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে বৃহত্তর ক্রীড়ামোদী মহলেও একটু বুদ্বুদ তুলতে পেরেছে, সেটি বোঝানো। তোলারই কথা। তৃতীয়বারের মতো আয়োজিত এই টুর্নামেন্ট প্রতিবছরই আগের বারের চেয়ে বিস্তৃত হয়েছে। প্রথমবার ৩২ দল, দ্বিতীয়বার ৪২ আর এবার ছিল ৪৬টি দল। হতে পারত আরও বেশি। এবার খেলতে চেয়েছিল ৭১টি বিশ্ববিদ্যালয়। নানা সীমাবদ্ধতায় ফিরিয়ে দিতে হয়েছে ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়কে। দুঃখ প্রকাশ করে আগামীবার দল বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিও তাদের মনস্তাপ কমাতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
ক্রমবর্ধমান দলের সংখ্যা এই টুর্নামেন্টের বড় থেকে আরেকটু বড় হয়ে ওঠার একটা প্রমাণ। এবার সেমিফাইনাল ও ফাইনাল জাতীয় স্টেডিয়ামে হওয়াটাও কি তা নয়! অনেক বিশ্ববিদ্যালয় দলেই বাংলাদেশের শীর্ষ লিগের খেলোয়াড় আছেন। তাঁদেরও অনেকে এই প্রথম খেলেছেন অনেক ইতিহাসের সাক্ষী জাতীয় স্টেডিয়ামে। এই অভিজ্ঞতার মূল্য হয়তো টুর্নামেন্টের প্রাইজমানির চেয়েও বেশি।
২০২৩ সালে এই টুর্নামেন্ট শুরুর সময় আমাদের একটা স্বপ্ন ছিল। এটা যেন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়ে ওঠে। সেই উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন সারা বছর এই টুর্নামেন্টের অপেক্ষায় থাকে। আলাদা করে প্রস্তুতিও নেয় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই।
এটুকু পথ আসতে অনেকের কাছেই ঋণ আছে। টুর্নামেন্ট কমিটিতে আছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত সব ফুটবলার, যাঁদের অনেককেই অনায়াসে কিংবদন্তি বলতে পারেন। তাঁদের সপ্রতিভ উপস্থিতি টুর্নামেন্টে যোগ করে বাড়তি রং। পৃষ্ঠপোষক ইস্পাহানি গ্রুপকে একটা বড় ধন্যবাদ দিতে হয়। একইভাবে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিকেও। প্রথম দুটি টুর্নামেন্টের ঢাকার আঞ্চলিক পর্ব ও চূড়ান্ত পর্বের খেলা হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজানো-গোছানো মাঠে। এবারও ঢাকা পর্বের পর চূড়ান্ত পর্বের ৪টি কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। সেমিফাইনাল-ফাইনালের জন্য জাতীয় স্টেডিয়াম বরাদ্দ দেওয়ায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনেরও একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য।
সবশেষে ধন্যবাদ দিতে চাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। আমরা যা কিছুই করি না কেন, শেষ পর্যন্ত এই টুর্নামেন্টকে রঙিন করে তোলে তো অংশগ্রহণকারী দলগুলোই। একটা টুর্নামেন্ট শেষে যারা পরের টুর্নামেন্টের জন্য দিন গোনে।
দিন গুনি আমরাও।