৬ মাস থেকে ৩ বছর বয়সের শিশুরাই সবচেয়ে বেশি সেপারেশন অ্যাংজাইটি বা বিচ্ছেদ উদ্বেগে ভোগে
৬ মাস থেকে ৩ বছর বয়সের শিশুরাই সবচেয়ে বেশি সেপারেশন অ্যাংজাইটি বা বিচ্ছেদ উদ্বেগে ভোগে

শিশুর সেপারেশন অ্যাংজাইটি নিয়ে যা কিছু জানা জরুরি

আপনার শিশুর বয়স কি ৬ মাস থেকে ৩ বছর? এই বয়সের শিশুরাই সবচেয়ে বেশি সেপারেশন অ্যাংজাইটি বা বিচ্ছেদ উদ্বেগে ভোগে। তবে এটি আপনার শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের অংশ। সাধারণত তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি কাটিয়ে ওঠে। জেনে নিন এর কারণ ও সমাধান।

সেপারেশন অ্যাংজাইটি বা বিচ্ছেদের উদ্বেগ কী

এককথায় সেপারেশন অ্যাংজাইটি বা বিচ্ছেদ উদ্বেগ হলো শিশু যাকে সবচেয়ে কাছের মানুষ মনে করে, তাঁর অনুপস্থিতির ভয়।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মায়ের জন্যই শিশুর বিচ্ছেদ উদ্বেগ দেখা দেয় সবচেয়ে বেশি। মজার ব্যাপার হলো, কেবল শিশুরাই নয়, যেকোনো বয়সের নারী-পুরুষ, বিশেষ করে বয়স্ক মানুষেরাও ভোগেন এ ধরনের উদ্বিগ্নতায়।

৬ মাস থেকে ৩ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা উদ্বেগ ও অপরিচিত মানুষের ভয় খুবই সাধারণ বিষয়। এটি আপনার শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের অংশ। সাধারণত তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি কাটিয়ে ওঠে।

কীভাবে বুঝবেন শিশুর বিচ্ছেদ উদ্বেগ আছে

আপনি যদি এই বয়সী শিশুর মা, বাবা কিংবা কাছের কেউ হন, তাহলে আপনি ইতিমধ্যে বিচ্ছেদ উদ্বেগের লক্ষণগুলোর সঙ্গে পরিচিত।  

  • বিচ্ছেদের আশঙ্কা দেখা দিলে মা বা অন্য যেকোনো যত্নকারীকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা, তাঁদেরকে কোথাও যেতে দিতে না চাওয়া।

  • বিশ্বস্ত, নির্ভরশীল ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে চিৎকার করে কাঁদা, বিচ্ছেদ নিয়ে রাগ হওয়া, খাওয়া-ঘুমের রুটিন ঠিক না থাকা, বিচ্ছেদ নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখা, স্কুল বা অন্য কোথাও যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ ইত্যাদি।

  • নতুন কোনো ব্যক্তিকে সহজে গ্রহণ না করা, এক মুহূর্তও অপরিচিত কারও কাছে থাকতে না চাওয়া।

  • মা বা অন্য যত্নকারীর অনুপস্থিতিতে তীব্র কষ্ট বা যন্ত্রণা অনুভব করা, যা স্বল্পস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

  • কোনো কিছুতেই শান্ত হতে না চাওয়া।

বিচ্ছিন্নতার উদ্বেগ মন্দ নয়

আপনার শিশু আগে হয়তো শান্তভাবে আপনাকে ঘর থেকে বের হতে দিত। অপরিচিত লোকদের কোলে যেতেও কোনো আপত্তি করত না। একদিন হঠাৎই আপনি অল্প কিছু সময়ের জন্য বাইরে গেলেও কাঁদতে শুরু করল। অপরিচিত লোকদের ভয় পেতে শুরু করল। শুরুতে সেটি আপনার কাছে অদ্ভুত মনে হতে পারে।

বাস্তবে এটি একটি ইতিবাচক লক্ষণ। এর মানে আপনার শিশু এখন বুঝতে শিখেছে যে সে তার মা, বাবা ও অন্য যত্নকারীদের ওপর কতটা নির্ভরশীল। এই যত্নকারীদের মধ্যে মা–বাবা ছাড়াও আছেন দাদা-দাদি, নানা-নানি বা বিশ্বস্ত কেউ। এর মানে সে এখন হুট করে কাউকে বিশ্বাস করতে রাজি নয়। আর এটি তার স্বাভাবিক বিকাশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।

যখন শিশুরা তাদের চারপাশ সম্পর্কে সচেতন হয়, তখন তারা যাঁদের ওপর নির্ভরশীল, সেই ছোট গোষ্ঠীর সদস্যদের ভালোভাবে চিনে নেয়। কেবল তাঁদেরকেই তারা ভরসা করে। তাঁদের সঙ্গে শিশুদের মানসিক সংযোগ এত গভীর হয় যে তাদের অনুপস্থিতিতে নিরাপত্তাহীন বোধ করে।

এ ছাড়া নতুন মানুষ বা নতুন পরিস্থিতিতে থাকাও, এমনকি আপনি পাশে থাকলেও, তাদের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে। শিশুর জীবনে কোনো বড় ধরনের চাপ বা আঘাতমূলক ঘটনা; যেমন হাসপাতালে থাকা, প্রিয়জনের মৃত্যু, পড়াশোনা বা কাজের সুবাদে মা–বাবার দেশের বাইরে যাওয়া এবং বাসা বা শহর বদলানোর মতো পরিবেশের পরিবর্তনের ফলেও বিচ্ছেদের উদ্বেগ দেখা দিতে পারে।  

বিচ্ছিন্নতা উদ্বেগ মোকাবিলা করার উপায়

বিচ্ছিন্নতা উদ্বেগের কারণে আপনার শিশুকে নার্সারিতে বা অন্য কারও তত্ত্বাবধানে রেখে তার চোখের আড়াল হওয়া বা বাইরে যাওয়া কঠিন হতে পারে। আপনি হয়তো তাদের কান্নায় কষ্ট পাবেন। বা ভাববেন, এতে শিশুর ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে কি না।

তবে মনে রাখবেন, আপনার অনুপস্থিতিতে শিশুর দুশ্চিন্তা বা অস্থিরতা একদম স্বাভাবিক। এতে নিজেকে অপরাধী ভাবার কিছু নেই। বরং এটি প্রমাণ করে আপনি ও আপনার শিশুর মধ্যে গভীর বন্ধন তৈরি হয়েছে।

ধৈর্য হারানো চলবে না, শিশুকে বোঝান যে আপনি যদি চলে যান, তবু সে নিরাপদে থাকবে

তাহলে আপনি এখন কী করবেন

শিশুকে যথাসম্ভব সাহায্য করবেন। শিশুরা যাতে এসব অনুভূতি বুঝতে ও সামলাতে শেখে। তারা ধীরে ধীরে শিখবে। তাই ধৈর্য হারানো চলবে না। শিশুকে বোঝান যে আপনি যদি চলে যান, তবু সে নিরাপদে থাকবে।

আর আপনি কাজ শেষ হওয়ামাত্রই ফিরে আসবেন। যদি আপনার শিশু একটু বড় হয়, তাহলে তাদের সহজভাবে বলুন আপনি কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন আর কখন ফিরবেন। এতে সে আশ্বস্তবোধ করবে।  

শিশুকে অন্যের কাছে রেখে গেলে আপনি তার ক্ষতি করছেন না। বরং তাকে শেখাচ্ছেন কীভাবে আপনার অনুপস্থিতিতেও মানিয়ে নিতে হয়, যা তাদের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। মনে রাখবেন, বিচ্ছিন্নতা উদ্বেগ খুবই সাধারণ এবং এটি অস্থায়ী।

কিছু পরামর্শ

১. বেবি স্টেপ: ধীরে ধীরে বিচ্ছেদের অনুশীলন শুরু করুন। শুরুতে কয়েক মিনিটের জন্য শিশুকে পরিচিত কারও কাছে রেখে যান। বাইরে থেকে হেঁটে আসুন বা প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা করে আসুন। এতে তারা বুঝতে শিখবে, আপনি গেলে আবার ফিরে আসেন। পরে ধীরে ধীরে আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা...এভাবে সময় বাড়ান।  

২. অপরিচিত মানুষকে আগে পরিচিত করান: যার কাছে শিশুকে রেখে যাবেন, তাঁর সঙ্গে শিশুকে পরিচিত করুন। শিশুকে বলুন, এই মানুষটি বিশ্বস্ত আর তিনি তোমার দেখাশোনা করবেন। আপনার সামনেই ওই ব্যক্তির সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ করে দিন।

যত্নকারী ব্যক্তি, আপনি ও শিশু মিলে খেলুন। তাঁর সাহায্য নিয়ে খাওয়ানোর অভ্যাস করুন। এককথায়, এমন কারও কাছে শিশুকে ছেড়ে যান, যাঁকে সে ভালো করে চেনে। যাতে সে নিরাপদ বোধ করে।

৩. বারবার বলুন পুনর্মিলনের কথা: আপনার শিশুকে বলুন, আপনি বাইরে গেলে তার জন্য কী নিয়ে আসবেন। ফিরে এলে একসঙ্গে কী করবেন। এতে তাদের আগ্রহ ও ইতিবাচক প্রত্যাশা তৈরি হবে। যেমন বলুন যে ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাব।

৪. মাইক্রো অ্যাওয়ার্ড: আপনার অনুপস্থিতিতে ঘরে ভালোভাবে থাকার জন্য মাঝেমধ্যে ছোট ছোট পুরস্কারও দিতে পারেন। প্রিয় কোনো খেলনা কিনে দিতে পারেন বা খাওয়াতে পারেন তার প্রিয় খাবার।

৫. হাসিমুখে বিদায় নিন: যখন আপনি বের হচ্ছেন, তখন দুঃখ বা চিন্তা প্রকাশ না করে হাসিমুখে শিশুকে বুঝিয়ে, আদর করে, সান্ত্বনা দিয়ে বিদায় নিন।

কখন সাহায্য নিতে হবে

মূল যত্নকারীর থেকে দূরে গেলে শিশুদের কান্নাকাটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তবে সময়ের সঙ্গে তারা আপনার প্রয়োজন, পরিস্থিতি বুঝতে শেখে। মানিয়ে নেয়। অভ্যস্ত হয়ে যায়।

এর আগপর্যন্ত চেষ্টা করুন শিশুর এই উদ্বেগ যেন কোনোভাবেই মাত্রাছাড়া না হয়। শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ, রুটিন, সামাজিকতা বা নার্সারিতে শেখার অভিজ্ঞতায় বাধা না দেয়। আর এটি যেন আপনাকেও আপনার কাজ থেকে বিরত না রাখে।

যদি দেখেন আপনার শিশুর উদ্বেগ খুব তীব্র, অনেকক্ষণ ধরে কাঁদে বা কয়েক সপ্তাহ ধরে উন্নতি হচ্ছে না, স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে বা অসুখে পড়ছে, তাহলে স্বাস্থ্যকর্মী বা শিশুবিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলুন।

সূত্র: এনএইচএস ইউকে