
আমার ছেলেবেলায় জীবননগর জায়গাটা কিন্তু মোটেও নগর ছিল না। তবু চুয়াডাঙ্গা জেলার ছোট্ট এই উপজেলাটা ছিল আমার ভীষণ আপন। ভোরের আলো ফোটার আগেই সাইকেল চালিয়ে প্রাইভেট পড়তে যেতাম। গাঁয়ের লোকের কত কথা যে শোনা লাগত। সেই আমি এখন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব হার্টফোর্ডশায়ারে শিক্ষকতা করি। পেছনে ফিরে তাকালে অবাক লাগে। কোথা থেকে কোথায় এলাম!
আমার বাবা নজরুল ইসলাম ছিলেন জীবননগরের একটি কলেজের উপাধ্যক্ষ। মা আয়েশা সুলতানা গৃহিণী। দুজনই চাইতেন, ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করে স্বমহিমায় আলোকিত হোক। শুধু লেখাপড়াই নয়, আমাদের সংস্কৃতিচর্চায়ও তাঁরা শুরু থেকেই সহায়তা করেছেন। গান, কবিতা, রচনা লেখার যত প্রতিযোগিতা হতো, সবকিছুতে নিয়ে যেতেন মা। ২০০৩ সালে জাতীয় পর্যায়ের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক পেয়েছিলাম। সে সময় থানা পর্যায় থেকে জেলা পর্যন্ত যাওয়াটাই ছিল আমার জন্য বিদেশ গমনের মতো।
এইচএসসিতে যখন জীবননগর ডিগ্রি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম, পুরো বিভাগে আমরা মেয়ে ছিলাম মাত্র তিনজন। ক্লাস থেকে কোচিং—সব জায়গাতেই শুধু ছেলেদের আধিপত্য দেখেছি। তবু ২০০৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় পুরো কলেজ থেকে শুধু আমিই জিপিএ–৫ পেয়ে গেলাম।
কিন্তু ভর্তি কোচিংয়ের জন্য ঢাকায় এসে যে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম, তাতে মনে হলো স্কুল-কলেজে যা শিখেছি সবই ভুল। একে তো ঢাকা খুব একটা চিনি না, তার ওপর আগে কখনো মা-বাবা ছাড়া শহরে গিয়ে থাকিনি। কোচিংয়ের সেই তিনটা মাস যে কী কঠিন কেটেছে, ভাবলে এখনো অস্থির লাগে। ভর্তি পরীক্ষার আগে এটাই তো ছিল বড় পরীক্ষা। সব নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়াতে আমাকে নিয়ে দেশের আনাচকানাচে ছুটেছিল মা। বড় ভাই তখন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। আমারও ইচ্ছে ছিল, প্রকৌশলী হব। শেষ পর্যন্ত আমার স্থান হয় স্বপ্নের বিদ্যাপীঠ—বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)।
জীবননগর থেকে আমিই প্রথম মেয়ে, যে বুয়েটে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। বুঝতেই পারছেন, বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকে শুরু করে হলজীবন—সব ক্ষেত্রেই আমাকে মানিয়ে নেওয়ার যুদ্ধে নামতে হয়েছে। খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে আমার পোশাক, ভাষা—সবকিছুর জন্যই নিজেকে ছোট মনে হতো।
মনে আছে, শুরুর দিকের একটা ক্লাস প্রেজেন্টেশনে ইংরেজিতে একটা বাক্য বলতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছিলাম। ক্লাসজুড়ে সে কী হাসাহাসি! তখনই পরিকল্পনা করি, উচ্চশিক্ষা নিতে দেশের বাইরে যাব। নিজে নিজেই শুরু করি আইইএলটিএসের প্রস্তুতি। একদিকে ইংরেজি ভাষা, অন্যদিকে বিভাগের ফলাফল—দুটিই উন্নতি হচ্ছিল একটু একটু করে। বুয়েট থেকে পাস করার পর দক্ষিণ কোরিয়ার পোহাং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে বৃত্তিসহ স্নাতকোত্তরে সুযোগ পেলাম। ওখানে পড়ালেখা ছিল গবেষণানির্ভর। তত দিনে ‘মানিয়ে নেওয়া’ বিষয়টির সঙ্গে যেহেতু মানিয়ে নিয়েছি, তাই নতুন দেশ, নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে আমার সখ্য হয়ে গিয়েছিল দ্রুত। ২৪ মাসের কোর্স ২১ মাসেই শেষ করে দেশে ফিরে আসি। এরপর বুয়েটেই কিছুদিন গবেষক হিসেবে কাজ করেছি।
তখন থেকেই পিএইচডির সুযোগ খুঁজছিলাম। ইরাসমাস মুন্ডাস বৃত্তি পেয়ে যাওয়াটা ছিল স্বপ্নের মতো। তবে লন্ডনে পিএইচডি করতে গিয়ে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। যে তহবিল (ফান্ড) নিয়ে পড়তে এসেছিলাম, সেটুকুর মধ্যে টিউশন ফি, থাকা-খাওয়া—সব খরচ চালাতে হতো। ‘একা মেয়ে’র জন্য এটা বেশ বড় চ্যালেঞ্জিং। দিন-রাত গবেষণায় ডুবে ছিলাম বলেই হয়তো অনুপ্রেরণা পেয়েছি।
শুরুতে ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইকে যোগ দিয়েছিলাম। দুই বছরের বেশি সেখানে পোস্ট ডক রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করার পর সম্প্রতি প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছি হার্টফোর্ডশায়ারে। জীবন আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। এখন মনে হয় আমার দেওয়ার পালা। তাই আমার গবেষণা ও শিক্ষকতা দিয়ে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করার চেষ্টা করছি। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য একটা স্কুল করার স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন পূরণের কাজও চলছে একটু একটু করে। আমার এই গল্প যদি একটি ছেলে বা মেয়েকেও বাধা পেরোনোর সাহস জোগায়, সেটুকুই আমার সার্থকতা।