গত ২৯ ডিসেম্বর মারা গেছেন ফুটবলের রাজা পেলে। ২০১৬ সালে ‘নিজের ছেলেবেলার উদ্দেশে’ নিজেই একটি চিঠি লিখেছিলেন তিনি। প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে প্রকাশিত সেই চিঠির শিরোনাম ছিল ‘লেটার টু মাই ইয়ঙ্গার সেলফ’। তিন পর্বে চিঠির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন শেষ পর্ব।

সান্তোসের ফুটবল মাঠে তুমি খুঁজে পাবে রাজ্যের স্বাচ্ছন্দ্য। দুই দশক তুমি এই ফুটবল দলের হয়ে খেলবে। এ সময় তোমার কাছে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অনেক লোভনীয় প্রস্তাব আসবে। মাদ্রিদের মিলানের ক্লাবেও যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পাবে তুমি। প্রস্তাবগুলো খুব আকর্ষণীয় মনে হলেও আমার কথা মন দিয়ে শোনো—একটি প্রস্তাবও গ্রহণ কোরো না। আবার বলছি—একটি প্রস্তাবও গ্রহণ কোরো না। বিশ্বাস করো, অনেক বড় বড় প্রস্তাব জীবনের পরের ধাপে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
তুমি সান্তোস ক্লাব কেন ছাড়বে? তুমি আর তোমার সতীর্থরা মিলে সান্তোসকে একসময় বিশ্বের সেরা ক্লাবের তালিকায় নিয়ে যাবে। ১৯৬২ সালে তোমার ক্লাবকে কনটিনেন্টাল ট্রেবল জেতাবে। বিশ্বের নানা দেশ ঘুরে ঘুরে প্রীতি ম্যাচ খেলবে। কঙ্গোর গৃহযুদ্ধের সময় শুধু তোমার খেলা দেখার জন্য যুদ্ধবিরতি দেওয়া হবে। সান্তোসের সঙ্গে তোমার যাত্রা হবে সুখস্মৃতিতে ভরপুর। তুমি তোমার পরিবারের কাছাকাছি থাকবে। তাই আমি আবার জিজ্ঞেস করছি, কেন তুমি সান্তোস ছাড়বে?
তুমি তোমার দেশের জন্য খেলা শুরু করবে খুব অল্প বয়স থেকে। এটা হবে এক বিরাট সম্মানের ব্যাপার। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নিতে তুমি জীবনে প্রথমবারের মতো উড়োজাহাজে চড়বে, সুইডেনে যাবে। ব্রাজিলের চেয়ে সুইডেন অনেক অন্য রকম।
১৯৫৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ তুমি জিতে যাবে। ফাইনালের শেষে তুমি মাঠে জ্ঞান হারিয়ে পড়েও যাবে। ওই মুহূর্তের অনুভূতি আজও আমার জন্য ব্যক্ত করা কঠিন। আমার ১৭ বছরের শরীরের জন্য ওই সব অনুভূতি ধারণ করা একরকম অসম্ভব ছিল। দলের সতীর্থরা যখন তোমার জ্ঞান ফেরাবে, তুমি চোখ খুলেই কেঁদে ফেলবে। তুমি সব সময়ই কাঁদো, এডসন। বুড়ো বয়সেও কেঁদেছ। তুমি ভীষণ আবেগপ্রবণ মানুষ, যে কিনা অল্পতেই কেঁদে ফেলে।
বিশ্বকাপ জেতা শুধু তোমার একার স্বপ্ন ছিল না। এই স্বপ্ন ছিল তোমার দেশের। আর মাত্র ১৭ বছর বয়সে দেশের ও নিজের এই স্বপ্ন পূরণ করতে পারা সহজ কথা নয়। বিশ্বকাপজয়ী সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হওয়ার ইতিহাস তুমিই গড়বে।
১৯৭০ সালে তুমি আবার কাঁদবে। কারণ, সে বছর তুমি শেষবারের মতো বিশ্বকাপের মাঠে ফুটবলার হিসেবে পা রাখবে। ওই কান্নাটা হবে অন্য রকম, আর পরিস্থিতি হবে আরও জটিল। ওই ম্যাচে কী ঘটবে? সেটা তোমাকে বলব না। কিছু পরিস্থিতির বয়ান এভাবে লিখে করা যায় না। এমনকি ওই পরিস্থিতি তুমি পেরিয়ে এলেও সেটা প্রকাশ করা যায় না।
বিদায় নেওয়ার আগে তোমার সঙ্গে ‘সৌন্দর্য’ নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। তোমার ক্যারিয়ারে তুমি অনেক সুন্দর স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, দেখবে, উপলব্ধি করবে। একটা গোল করার পর যখন তুমি দৌড়ে দর্শকদের দিকে যাবে, তখন ভেজা চোখে তাঁদের উল্লাসে ফেটে পড়ার দৃশ্য তোমার মনে গেঁথে থাকবে। এই দৃশ্য তোমাকে বারবার মনে করিয়ে দেবে, তুমি সবার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এমনই একটি মুহূর্তের গল্প শোনাই তোমাকে। ১৯৬৮ সালে কলম্বিয়ার একটি ম্যাচের কথা বলছি।
ম্যাচের মাঝখানে হঠাৎ দেখবে, তোমার দলের খেলোয়াড় কুতিনহো কলম্বিয়ার এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে হাতাহাতি শুরু হচ্ছে। বাকি খেলোয়াড়েরা ছুটে যাবেন সেই গন্ডগোল থামাতে। যখন পরিস্থিতি ঠান্ডা হবে, দেখবে, রেফারি তোমাকে ‘লাল কার্ড’ দেখাচ্ছেন। তুমি তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করবে, ‘না না, আমি তো মারপিট করিনি।’ এরপরও রেফারি তোমার কোনো কথা শুনবেন না। তোমাকেই মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে বলবেন। কারণ, রেফারি তোমার আর কুতিনহোর চেহারা গুলিয়ে ফেলবেন। ভাববেন মারপিট তুমিই করেছ। রাগ-ক্ষোভ নিয়ে তুমি মাঠ ছেড়ে লকার রুমে গিয়ে ফুঁসবে। কিন্তু তখনই শুনবে বাইরে গোলমাল, চিৎকার-চেঁচামেচি। কোচ দৌড়ে এসে বলবেন, ‘পেলে, জলদি চলো। তোমাকে আবার মাঠে নামতে হবে।’
তুমি বলবে, ‘কী! আমি লাল কার্ড পেয়েছি। আমি তো মাঠে নামতে পারব না।’ কোচ বোঝাবেন তোমাকে, ‘না, তুমি বুঝতে পারছ না। জুতা খুলো না। দর্শকেরা অনেক হল্লা করছেন। তাঁরা রেফারির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করছেন। সবাই তোমাকে মাঠে দেখতে চান।’
লাল কার্ড পেয়েও মাঠে আবার ফেরত যাওয়ার মতো দুর্লভ মুহূর্তের অভিজ্ঞতা তোমার জীবনে এটাই প্রথম ও একমাত্র। তোমার বিপক্ষ দলের সমর্থকেরা তোমার প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। তাঁরাই ‘পেলে! পেলে!’ বলে চিৎকার করবেন, তোমাকে চাইবেন। মনে রেখো, এর চেয়ে পবিত্র মুহূর্ত তুমি আর কখনো পাবে না। মাঠে ফিরে দেখবে, আগের রেফারির জায়গায় নতুন রেফারি নেমেছেন। ফুটবলে কখনো এভাবে একই ম্যাচে রেফারির পরিবর্তন আর মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়া খেলোয়াড়ের ফিরে আসার নজির তুমি পাবে না। ঠিক এই মুহূর্তেই তুমি উপলব্ধি করতে পারবে, কত মানুষের ভালোবাসা আছে তোমার প্রতি। দেখেছ? ঈশ্বর তোমার জন্য কত সুন্দর একটা জীবন সাজিয়ে রেখেছেন।
ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো, ‘আমার পরিবারকে নিরাপদে রেখো’। তোমাকে অনেকের খেয়াল রাখতে হবে। তোমার খেয়ালও সবাই রাখবে, কথা দিচ্ছি। আরও একটা প্রার্থনা প্রতি রাতে কোরো। ব্রাজিলের মানুষেরা খুব সুন্দর। আমাদের খাবার, সুর, সংস্কৃতি সবই অপরূপ–অসাধারণ। তবে আমাদের অনেক সমস্যাও আছে। আমাদের এখানে অপরাধ আর দারিদ্র্যও আছে। এমনকি আজও যখন আমি তোমাকে এই চিঠি লিখছি, আমাদের দেশ এখনো নানা দিক থেকে সংগ্রাম করছে, এডসন। তুমি প্রার্থনা কোরো, ‘ঈশ্বর, আমাদের ব্রাজিলকে আরও সফল করো, উন্নত করো, সচ্ছল করো।’ এখনো ব্রাজিলের রাস্তায় ছেলেমেয়েরা খালি পায়ে ফুটবল খেলে। বুট বা একটা বল কেনার সামর্থ্য এখনো অনেক পরিবারের নেই। এখনো ব্রাজিলের বাচ্চাদের আম চুরি করে খেতে হয়। এটা খুবই দুঃখজনক।
এডসন, তুমি এই দেশের ছেলে হয়েই থেকো। এডসনই থেকো। আর তিনটা শব্দ মনে রেখো: সততা, ধৈর্য আর সম্মান।