ফিফা টিকিটিং সাইটে প্রথম যেদিন টিকিটের আবেদন করি, সেদিনও জানতাম না কাতার বিশ্বকাপ দেখতে যাব। আত্মীয়দের এক অনুষ্ঠানে কয়েকজন আবেদন করেছিল, আমাকেও বলল করে রাখ, পরেরটা পরে দেখা যাবে। আমিও কয়েকটা ম্যাচের টিকিটের আবেদন করলাম। তারপর একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। যে কারণে, টিকিট পেয়েছি—এটা জানতেও আমার দুই দিন লেগে গেছে।
আমার এক সহকর্মী গল্প করছিল তাঁর বন্ধু আর্জেন্টিনা–মেক্সিকো খেলার টিকিট পেয়েছে। শুনে আমি ই–মেইল চেক করে দেখি পর্তুগাল–ঘানা খেলা দেখার জন্য আমি প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়েছি। এখন টিকিটের দাম পরিশোধ করলেই আমার নামে ইস্যু হয়ে যাবে। পেমেন্ট করার শেষ দিন ১৫ জুন। আমি আবারও ভুলে গেলাম। ফিফার বেঁধে দেওয়া সময়সীমার ৬ ঘণ্টা আগে মনে হলো, কেটে ফেলি টিকিট। নিয়ত করলে উপায় হয়। আল্লাহ যদি কপালে কাতার লিখে থাকে, যাওয়া হবে।
কাতার যেতে হলে প্রথাগত যে ভিসা নিতে হয়, বিশ্বকাপে তা খাটবে না। ২০২২ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর কাতারে প্রবেশ করার জন্য হায়া কার্ড লাগবে। এই কার্ড থাকলে বিশ্বকাপ চলাকালীন গণপরিবহন ফ্রি। হায়া কার্ড না থাকলে স্টেডিয়ামেও প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। আর হায়া কার্ড পেতে হলে লাগবে ম্যাচের টিকিট, পাসপোর্ট আর থাকার জায়গার নিশ্চয়তা। স্কুলজীবনের বন্ধু কাতারে আছে প্রায় ১২ বছর। ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তার শরণাপন্ন হয়ে থাকার জায়গাবিষয়ক সমস্যার সমাধান করে পেয়ে গেলাম হায়া কার্ড। তখন পর্যন্ত ম্যাচ টিকিট একটাই।
তবে ‘রিসেল’ অপশন থেকে যেকোনো সময় অন্যান্য ম্যাচের টিকিট পাওয়া যেতে পারে। সেই অপেক্ষায় থাকলাম। কিছুদিনের অপেক্ষা শেষে পাওয়া গেল আরও বেশ কিছু ম্যাচের টিকিট, প্লেনের টিকিট কেটে অফিস থেকে ছুটি মঞ্জুর করে অপেক্ষায় থাকলাম। সে অপেক্ষায় ছিল অনিশ্চয়তার টেনশন, আর ছিল চাপা আনন্দ। টেনশন, কারণ মানুষের সঙ্গে কখন কী ঘটে, সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ জানে না। একজনকে চিনতাম, রাশিয়া বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি নেওয়ার পরও ডেঙ্গুর কারণে যেতে পারেনি। সবকিছুর সঙ্গেই ‘লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট ফ্যাক্টর’ হিসেবে আছে কপাল।
২১ তারিখ সকাল ৭টায় কাতার পৌঁছালাম। এয়ারপোর্ট নেমে দেখি বিভিন্ন দেশের প্রচুর ফুটবল ফ্যান। সবাই ইমিগ্রেশনে দৌড়াচ্ছে। তাদের সবার হাতে নিজের দেশের পতাকা। ইমিগ্রেশনের মহিলা জিজ্ঞেস করল, খেলা দেখতে এসেছ? ব্রাজিল? বললাম, ব্রাজিলের খেলা দেখতে এসেছি, তবে ব্রাজিল থেকে না। আমি বাংলাদেশি, এক মিনিটের বেশি সময় লাগল না।
ব্যাগেজ নিয়ে বের হতেই দেখি ফ্রি সিম কার্ডের ব্যবস্থা৷ শুধু হায়া কার্ড স্ক্যান করেই দিয়ে দিচ্ছে। কাতার যে আয়োজনে কোনো ত্রুটি রাখেনি, সেই নমুনা পেলাম। পত্রিকায় অনেক কিছুই পড়েছি, কিন্তু সত্যি বলতে, কাতার সফল বিশ্বকাপ আয়োজনের সব চেষ্টাই করেছে। টাকাপয়সা অনেক আছে, কিন্তু মানি, ম্যানেজমেন্টও একটা বিষয়। আন্তরিকতা না থাকলে শুধু টাকা দিয়েও হয় না। অথচ দেশটার আয়তন আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার থেকেও কম। জনসংখ্যা ২৯ লাখের মতো। তাদের বিশ্বকাপ আয়োজন করতে দেওয়া নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। আশপাশের দেশগুলোও ছিল প্রতিপক্ষ। আরব আমিরাত যৌথভাবে করতে চেয়েছিল। নিজ বিশ্বাসে অটল কাতার কাউকেই পাত্তা দেয়নি।
কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলারদের জন্য বেশ আরামের বিশ্বকাপ বলা যায়। ক্যাম্প যেখানে–সেখানেই থাকার সুবিধা। স্টেডিয়ামগুলো সব কাছেই বিধায় হোটেল পরিবর্তনের ঝামেলা নেই। দর্শকদের জন্যও সুবিধা। যেসব স্টেডিয়ামে খেলা দেখব, সেগুলো যেখানে, সেখানে উঠেছি, সেখান থেকেই যাওয়া যাবে। প্রথম দিনই গেলাম নৌকা আকৃতির লুসাইল স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপের সব থেকে বড় স্টেডিয়াম এটি। বিশ্বকাপকে ঘিরে আলাদা শহর করা হয়েছে, নাম লুসাইল সিটি। ব্যাপক উৎসাহ–উদ্দীপনা বিরাজমান। লোকজন ঘুরে ঘুরে দেখছে সব। তবে খাবার বা পানীয় সবকিছুর দাম এই এলাকায় বেশি৷ এক কাপ কফি খেতে বাংলাদেশি টাকায় ২ হাজার টাকা বের হয়ে যাবে। তাই আপাতত কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকলাম।
পরের দিন গেলাম স্টেডিয়ামে। আর্জেন্টিনা সৌদি আরব ম্যাচ দেখতে। ঢুকে টের পেলাম গ্যালারির আর্জেন্টাইন শিবিরে এসে পড়েছি। ব্রাজিল সাপোর্ট ভেতরে রেখে বাইরে অনুগত আর্জেন্টাইনের ভূমিকা পালন করলাম। পেনাল্টিতে গোল দিল মেসি। সাপোর্টারদের দলগত গান শুরু হয়ে গেল, ‘ওলেলেএ আর্জেন্টিনো…’৷ গানটা বেশ সুন্দর। সবাই মিলে সুর তুললে শুনতে বেশ লাগে। এর মাঝে আমার পাশের দীর্ঘদেহী আর্জেন্টাইন স্প্যানিশ ভাষায় গালাগালি করেই যাচ্ছে। আর্জেন্টিনার কয়েকটা সম্ভাব্য গোল ‘অফসাইড’-এর নামে বাতিল করে দিয়েছে রেফারি।
আচমকা সৌদি আরব গোল দিয়ে দিল। প্রচুর সৌদি সমর্থকও আছে। পাশের দেশ থেকে আসা তাদের জন্য সুবিধাও। এবার তারা গর্জন করে উঠল। সেই গর্জন থামার আগেই আরেকটি গোল দিল তারা। এখন আর্জেন্টাইন সাপোর্টারদের হতভম্ব অবস্থা। পারলে নিজেরাই মাঠে নেমে গোল দিয়ে আসে।
খেলা শেষে বের হয়ে দেখি জনসমুদ্র। সৌদি ফ্যানরা স্টেডিয়ামের বাইরে আয়োজিত ডিজে পার্টিতে যোগ দিয়েছে। দামি দামি গাড়ি দিয়ে শোডাউন দিচ্ছে। আর্জেন্টাইনরাও মজা করছে।১ শুধু ২-১ জনের মন খারাপ। তবে যা বুঝলাম কমবেশি সবাই স্পোর্টিং মেন্টালিটির৷ এদিকে আমি ভয়াবহ ক্ষুধার্ত। কিন্তু স্টেডিয়ামসংলগ্ন এলাকা থেকে কোনো কিছু কেনার সাহস হচ্ছে না। যে বন্ধুর বাসায় উঠেছি, সেখানে পৌঁছাতেও মেট্রো, বাস পাড়ি দিতে হবে। ঠিক করলাম বাসায় গিয়েই খাব। মেট্রোতে তখনো উৎসব চলছে৷ আর্জেন্টাইনরা আলোচনা করছে মেক্সিকো বধ করা নিয়ে। তবে কারও সেভাবে মন খারাপ নেই। ২-১ জনের সঙ্গে পরিচয় হলো। একজন ছিল হুইলচেয়ারে, ৮০ বছরের কাছাকাছি বয়স। পেলে, ম্যারাডোনা, জিদানকে কাপ উঁচিয়ে ধরতে দেখেছেন। দেখেছেন লোথার ম্যাথিউসকেও। মৃত্যুর আগে ইচ্ছা মেসি আর নেইমারকে কাপ উঁচিয়ে দেখতে।
জিজ্ঞেস করলাম মেসি না নেইমার? দুজন একসঙ্গে তো আর হবে না। আমাকে চোখ টিপ দিয়ে হুইলচেয়ার ধরে রাখা স্ত্রীর দিকে ইশারা করল। বুঝলাম দাদু বিয়ে করেছেন ব্রাজিলে। মনের মধ্যে মেসি থাকলেও বলার সময় নেইমারও বলেন। বউয়ের মন রক্ষা শুধু না, বউয়ের পছন্দকে সম্মান করেন। এই যেমন তার দুই দিন পর ক্যামেরুনে জন্মানো ফুটবলার সুইজারল্যান্ডের হয়ে খেলে ক্যামেরুনের বিপক্ষে গোল দিয়ে ক্যামেরুনকে হারাল। সে-ও বিয়ে করেছে এক সুইস নারীকে। মেট্রো থেকে নেমে মনে হলো, যাহ, ভুল হয়ে গেল। আর্জেন্টাইন দাদু আর ব্রাজিলিয়ান দাদির ছবি তোলা হয়নি। ক্লান্তিতে, ক্ষুধায় ভুলে গেছি।
পর্তুগাল-ঘানা খেলা দেখার দিন গেলাম স্টেডিয়াম ৯৭৪-এ। কনটেইনার দিয়ে বানানো স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপের পর এই স্টেডিয়ামের অস্তিত্ব থাকবে না। লেগোর মতো খুলে দিয়ে দেওয়া হবে অন্য কোনো দেশকে। ঝাঁকে ঝাঁকে ঘানা আর পর্তুগাল ফ্যান। ঘানার নাগরিক ম্যাম্বো জাম্বো খুবই আত্মবিশ্বাসী। বললেন, রোনালদো এক গোল দিলে ঘানা ফিরিয়ে দেবে তিনটা৷ স্টেডিয়ামে ঢুকে দেখি সিট সবার ওপরে, পাশের সিটে মিসরীয় নাগরিক ইউসুফ, তার পাশে নাইজেরিয়ার জো। ইউসুফ রোনালদোর পাগলা ফ্যান। জো নাইজেরিয়ার নাগরিক, এসেছে ঘানার সমর্থনে। ৩ জন মিলে ছবি তুললাম। জো-র পাশে ছিল ইথিওপিয়ার গেলাইয়া। আত্মীয়ের অসুস্থতার কথা বলে বসের কাছে ৭ দিনের ছুটি নিয়েছে। এসেছে খেলা দেখতে। ছবি তুলবে না।
সেকেন্ড হাফে হলো ৫ গোল। তবে ৫ নম্বর গোল দেখিনি। ব্রাজিল–সার্বিয়ার স্টেডিয়ামে যাব, বের হতে গিয়ে হর্ষধ্বনি শুনে ফিরে এলাম। পুলিশকে জিজ্ঞেস করলাম, কে গোল দিছে? পুলিশ বলে, কারা খেলছে, এটাই তো মনে নেই! ওখানে পুলিশদের ডিউটি অনেক কঠিন। মাঠের দিকে তাকানোরই অনুমতি নেই। পর্তুগাল ৩-২ রেখে লুসাইলের উদ্দেশে বের হলাম। সেখানে যেতে যেতেই খেলার অর্ধেক শেষ। তবে ব্রাজিল ২ গোল দেওয়ায় খুশি লাগল। হাজার হাজার ব্রাজিল সমর্থক মহাখুশি।
ফ্রান্স-ডেনমার্কের খেলা দেখতে গেলাম। দুই ইউরোপিয়ান মুখোমুখি। ফ্রান্স বেশ গোছানো দল, কিন্তু বিরক্ত হলাম ডেনমার্কের খেলা দেখে। কোনো সামঞ্জস্য নেই। কেমন যেন তাল কেটে গেছে। মেসি আর রোনালদোর পর এমবাপ্পের গোল দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। সেটা দেখলাম ২ বার। কাতার ছাড়ার আগে ব্রাজিল–সুইজারল্যান্ড খেলা দেখে ফিরলাম। এই খেলার টিকিট রিসেল অপশনে পেলাম খেলা শুরুর মাত্র ২ ঘণ্টা আগে। ব্রাজিল ১ গোলে জেতায় আর ক্যামেরুন-সার্বিয়া ড্র হওয়ায় দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত হয়ে গেল।
কাতারকে এত চমৎকার আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ দিতেই হয়। বিভিন্ন কারণে যত সমালোচনাই হোক, দর্শকদের আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখেনি তারা।
ফেরার জন্য প্লেনে উঠলাম। নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসব। সেই আর্জেন্টাইন দাদুর মতো বয়সেও যদি এমন হয়, আমার নিজ দেশে হচ্ছে বিশ্বকাপ, বাসা থেকে লাল–সবুজ জার্সি পরে বের হয়েছি, হুইলচেয়ারে করে যাচ্ছি ঢাকার স্টেডিয়ামে। আমাদের ছেলেরা দুর্বার গতিতে প্রতিপক্ষের ডিফেন্স তছনছ করে দিচ্ছে! চিরবিদায়ের আগে সেই দৃশ্য মন ভরে দেখলাম। স্বপ্ন দেখতে তো আর বাধা নেই।
লিখেছেন: রাসয়াত রহমান জিকো, লেখক ও নাট্যকার।