মিস ম্যাজিশিয়ান

জাদু দেখাচ্ছেন আজরা জ্যাবিন
ছবি: সংগৃহীত

‘এই যে, আপনার ব্যাগ পড়ে গেছে,’ চেঁচিয়ে উঠলেন কেউ।
দ্রুতগতির সাইকেল। ব্রেক কষতেই ধানখেতের কাদাপানিতে গিয়ে পড়লাম। সে অনেক বছর আগের কথা। স্কুলে যাওয়ার পথে এভাবেই নাজেহাল হয়েছিল অষ্টম শ্রেণির এক কিশোরী। শুধু তাই না, বেশ জোরেশোরে গিয়ে পড়ায় কনুইয়ের চামড়া কেটে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এল। তবুও নিঃশব্দে লজ্জায় কোনোরকমে উঠে গিয়ে পড়ে যাওয়া ব্যাগটা খুঁজতে লাগলাম। অবাক কাণ্ড! ওটা আমার ক্যারিয়ারেই ভালোভাবে আটকে আছে।
হঠাৎ ধাঁ করে মাথাটা চড়ে গেল। ‘এই যে আপনারা, বয়স্ক হয়েও আমাকে এভাবে অ্যাকসিডেন্ট করালেন, এটা কি ঠিক হলো!’ পাশের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুজনকে ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম।
‘আর এই যে তুমি মাইয়া হইয়া সাইকেল চালাইতাছো, এইডা বুঝি খুব ঠিক?’
এ কথা শুনে আর একটি বাক্য ব্যয়ের ইচ্ছাও হলো না। এই মানসিকতার মানুষগুলোর ওপর শুধু তীব্র ঘৃণা হলো। মেয়ে হয়ে সাইকেল চালানোটা যেন কত বড় অপরাধ! হাতের বড় কাটা দাগটা সেই মানুষগুলোর কথা আজও আমায় ভুলতে দেয় না।

প্রেমা অনন্যা

তখন মনে হয়েছিল আহা, যদি ম্যাজিশিয়ান হতাম! নিমেষে এই লোকগুলোকে বদলে দিতাম। হঠাৎ মনে হলো, আমি তো মেয়ে, মেয়েরা ম্যাজিশিয়ান হতে পারে না।
তবে সময়ের ব্যবধানে মানুষের সেসব দৃষ্টিভঙ্গি আজ বদলেছে। মেয়েরা এখন সবই করছে। যা ছিল ট্যাবু, তাই আজ কত না স্বাভাবিক সবার কাছে। মেয়েরা আজ আমাদের দেশেই সাইকেল চালিয়ে ম্যারাথনে যায়। হিমালয় জয় করে। প্লেন, ট্রেন চালায়। মেয়েরা আজ ‘জাদুকরি’ও! আমরা জাদুকর শুনে অভ্যস্ত, ‘জাদুকরি’ শুনিনি। অথচ আজ মেয়েরা জাদু দেখাচ্ছেন। সেই আশির দশকেই জাদু দেখাতেন আজরা জ্যাবিন। সে সময় তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র সেলিব্রেটি ম্যাজিশিয়ান। ব্ল্যাক বেল্ট হোল্ডার আজরা তখন ছিলেন তরুণীদের আইকন।
তবে এই অঞ্চলের নারী জাদুশিল্পীদের কথা বলতে গেলে অবশ্যই যাঁর নাম আগে আসবে, তিনি মানেকা সরকার। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নারী জাদুকর মানেকার দাদু প্রতুলচন্দ্র সরকার (পি সি সরকার) আর বাবা প্রদীপ সরকার (পি সি সরকার জুনিয়র)। ছোটবেলা থেকে বাবা–মাকে স্টেজ শো করতে দেখে বড় হয়েছেন। তাঁদের দেখাদেখি তিনিও হাতে তুলে নিয়েছেন জাদুর কাঠি। আর এখন এই ভারতবর্ষেই আছে গোটা পঞ্চাশেক নারী জাদুকর। জাদুকে যাঁরা পেশা হিসেবে নিতে চাইছেন।
প্রতিষ্ঠিত পরিবার হওয়া সত্ত্বেও এ পথে আসাটা মানেকার সহজ ছিল না। তবে পারিবারিক সহযোগিতা পেয়েছেন সব সময়। অনেকে ভাবতে পারেন, তিনি হয়তো পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষা করতেই এ পথে আসতে বাধ্য হয়েছেন।  তাই মানেকা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, ‘আই এম এ ম্যাজিশিয়ান বাই চয়েস, নট বাই ফোর্স!’
মানেকার অর্থ মোহময়ী। নামটি রেখেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি বলেছিলেন ‘আমি চাইব, বংশপরম্পরায় জাদুর যে ধারাটি চলে আসছে, সেটি ও এগিয়ে নিয়ে যাক।’ আজ সেই কথাই তিনি নিজের যোগ্যতায় প্রমাণ করেছেন। মানেকা বলেন, খুব ছোটবেলায় স্কুলে একবার যে যা হতে চায় তা আঁকতে বলা হয়েছিল। কেউ চিকিৎসক, কেউ নার্স, কেউ পাইলট আঁকল; আর আমি এঁকেছিলাম ম্যাজিশিয়ান। আসলে তখনই আমি জেনে গেছি, আমি জাদুকর হতে চাই! জাদুকর নারী বা পুরুষ—এই পার্থক্য বা ভেদাভেদ ছিল না আমার কাছে।

মানেকা সরকার

পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে মানেকা বলেন, ‘আসলে যেকোনো আর্টফর্ম শুধু নারী বা পুরুষে হয় না। আসলে নারী-পুরুষ নয়, আমরা তার ট্যালেন্টটা প্রমোট করব।’ মানেকা নিজেও ওটা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন।
জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ বললেন, এ দেশের নারী জাদুকরদের তিনি সব সময় সহযোগিতা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রেমা অনন্যা নামের একটি মেয়ে এখন ম্যাজিক ভালো করছে।’
এই লেখার প্রথমে উল্লেখিত সমাজের এ লোকগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি কোনো এক জাদুর ছোঁয়ায় বদলে গেছে। আমার এক বন্ধু, একসময় যার প্রবল ইচ্ছা ছিল ছেলেদের মতো সাইকেল চালানোর, ৪০ বছর বয়সে এসে সাইকেল চালনা শিখে নিয়েছে। ঢাকা শহরের অলিগলি, রাজপথ সাইকেলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাই মানেকার কথাতেই বলতে হয় ‘নারীদের কোনো জাদুর কাঠির প্রয়োজন হয় না, নারীরা জন্মায়ই জাদুকর হয়ে।’

মানেকা বলেন, ম্যাজিক ও সিনেমা দুটিই কম্পোজিট আর্ট। কিন্তু সিনেমার সুবিধা হলো, এর গল্প লেখেন একজন, স্ক্রিপ্ট লেখেন আরেকজন, পরিচালক একজন, দক্ষ অভিনয়শিল্পী, মিউজিক ডিরেক্টর, এডিটর প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ মানুষেরা একত্রে কাজ করে সিনেমাটাকে উপভোগ্য করে তোলেন। কিন্তু ম্যাজিক বিষয়টি অনেক জটিল ও কঠিন। কারণ, ম্যাজিকটি বিজ্ঞানীর মতো আবিষ্কার করতে হয় ম্যাজিশিয়ানকেই। তার সব রকম সাজসরঞ্জাম নিজেকে তৈরি করতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা সশরীর দর্শকের সামনে উপস্থাপন করতে হয়। এই জটিল কাজ যে যত ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন, তাঁর আনন্দ তত বেশি। মানেকা সরকার বলেন, আমি নিজ যোগ্যতায় জাদুকর, সেটি আমাকে প্রমাণ করতে হয়েছে। নিজ জায়গাটি আমি অর্জন করে নিয়েছি।
মানেকার বাবা পিসি সরকার জুনিয়র বলেন, ‘শুধু পুরুষ প্রজন্মই যে বংশের ধারা বহন করবে, এটা হয় নাকি! ছেলে–মেয়ে সমান সমান। আমি আমার মেয়ের কাছে হেরে যাব, এটা আমার স্বপ্ন। ম্যাজিক একটা দার্শনিক বার্তা দেয়, বললেন মানেকা। একটা আর্ট কালচার শুধু রক্তের ধারা রয়েছে বলে এগোবে, ব্যাপারটা তা নয় বলেই মনে করেন মনিকা।
পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বলব পুরুষ কি নারী, এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিভা। আসলে ম্যাজিককে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে প্রমাণ করা যায়, নারী-পুরুষ কোনো ভেদাভেদ নেই।