ছবি: কাবুম পিকস, পেকজেলস ডট কম
ছবি: কাবুম পিকস, পেকজেলস ডট কম

অণুজীব থেকে চকলেট

এ বছরের শুরুতেই বিজ্ঞানীরা আরেকটি চমকপ্রদ খবর দিয়েছেন। তা হলো দুধের জন্য আর গাভির দরকার হবে না। ভবিষ্যতে এক কোষী অণুজীব হবে দুধের প্রধান উৎস। তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর তামির টুলের এবং খাদ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা ড. আইয়াল ইফারগান দুজনে মিলে এককোষী ছত্রাক ইস্ট থেকে দুধ উৎপাদনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে এক বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছেন। পুষ্টিগুণের সঙ্গে রং, ঘ্রাণ, স্বাদ আর গঠন বিবেচনায় অণুজীব উৎপাদিত দুধ কোনো অংশেই কম যায় না; বরং আর কিছু পুষ্টিগুণ যোগ করে স্বাস্থ্যের জন্য আরও উত্তম করা যাবে বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা। এমনকি এ থেকে উৎকৃষ্ট মানের চিজ অর্থাৎ পনির তৈরি করা যাবে।

খবরটি যেমন জৈবপ্রযুক্তিবিদদের জন্য চমকপ্রদ, তেমন আমার জন্য আরও খানিকটা বেশি উৎসাহের। কারণ, আণুবীক্ষণিক অণুজীব নিয়ে কিছুটা পড়াশোনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ধাপটি পার হয়েছি এবং পরবর্তীকালে এককোষী ইস্ট নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তা–ও আবার ইস্ট থেকে সুগন্ধি, সুস্বাদু চকলেট উৎপাদন করার মতো ব্যাপারে।

গবেষণাগারে লেখক (বাঁয়ে) সঙ্গে তিউনিসিয়ার একজন গবেষক

আশির দশকের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে সবে কাজ শুরু করেছি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, মাত্র কয়েক মাসের মাথায় উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার জন্য ফরাসি সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আমন্ত্রণ পেলাম। আমি যেন জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি। প্রথমবার বিদেশে, তা–ও আবার ফ্রান্সে এসেছি। প্রথম এক বছর মধ্য ফ্রান্সের ছোট শহর ভিশিতে থাকতে হয়েছে বিভাষা ফরাসি রপ্ত করার জন্য।

কিছুটা ফরাসি সম্বল করে পড়াশোনা এবং গবেষণার জন্য ভিশি ছেড়ে তুলুজ শহরে চলে আসি। প্যারিস থেকে সোজা দক্ষিণে প্রায় সাত শ কিলোমিটার দূরে ছবির চেয়ে সুন্দর এই শহর তুলুজ, এখানেই আমার ল্যাবরেটরি।

চকলেট

এখানে পৌঁছানোর আগেই আমার সব বৃত্তান্ত প্রফেসর জেরার গোমার হাতে এসেছে। প্রফেসর গোমা তখন ফ্রান্সের প্রথম সারির একজন জৈবপ্রযুক্তিবিদ। নভেম্বরের এক সকালে প্রথম তাঁর সঙ্গে দেখা হলো। বললেন, অনেক বছর আগে তিনি ঢাকায় কার্জন হলে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পর্কে তিনি খুব ভালো ধারণা পোষণ করেন। তাই তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে কাজ করার জন্য সুযোগ দিচ্ছেন। আমার কাজ হচ্ছে, শিল্পবর্জ্য থেকে উন্নত মানের চকলেট উৎপাদন করতে হবে। আমার তখন ভিরমি খাবার মতো অবস্থা। এ যেন সেই জাদুর কাঠি, ছোঁয়াতেই সব সোনায় পরিণত হবে।

মনে মনে ভাবছিলাম, পৃথিবীতে এত জিনিস থাকতে চকলেটের মতো এমন সুস্বাদু খাবার কেন? মজার খাবার আসবে বর্জ্য অর্থাৎ নাক ছিটকানো ময়লা কিছু থেকে। তা–ও আবার অণুজীব তা নিজের দেহে তৈরি করবে! ব্যাপারটা খুব সুবিধের মনে হয়েছিল, তা নয়। প্রফেসর উত্তর দিলেন, ‘কারণ, চকলেটের চাহিদা অনেক বেশি। সে তুলনায় এক উদ্ভিদ তা সামাল দিতে পারছে না। চকলেটের জন্য পশ্চিম আফ্রিকা, মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয়। রাজনৈতিক কিংবা বিরূপ আবহাওয়ার কারণে সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে ভোক্তারা দারুণ অখুশি হবে। চকলেটনির্ভর সব শিল্পকারখানা এবং কর্মীজীবীরা দারুণ বিপাকে পড়বে। তাই বিকল্প ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রাখার জন্য এমন আয়োজন।’

ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে চকলেট সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোতে আসতে শুরু করে

প্রথম দিকে এমন মহার্ঘ খাবার সাধারণের নাগালের বাইরে ছিল। মাত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে চকলেট নামক অসাধারণ খাবার সাধারণের মুঠোতে আসতে শুরু করলে আজ অবধি বিশ্বব্যাপী এর চাহিদা ব্যাপক এবং ক্রমবর্ধমান।

সমস্যা সেখানে নয়। পনির উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে ফ্রান্সের খুব নাম আছে। প্রায় ১৮০০ রকমের নানা স্বাদের পনির উৎপাদন করে দেশটি। পনির ভোক্তা দেশ হিসেবে পৃথিবীতে গ্রিস প্রথম এবং এরপরেই ফ্রান্স। দুধ ফেটিয়ে বিপুল পরিমাণ পনির উৎপাদন করতে গিয়ে বর্জ্য হিসেবে ফেলে দিতে হয় বিশাল পরিমাণে ছানার জল। তাতে করে পরিবেশ দূষিত হয়। পানি আর মাটিকে দূষণমুক্ত রাখতে পনির শিল্পের বর্জ্যকে এমন কাজে লাগাতে হবে। মাঠাতে একধরনের চিনি, প্রচুর ল্যাকটোজেন থাকে।

বিভিন্ন স্বাদের চকলেট। অণুজীব থেকে চকলেট উৎপাদনের জৈবপ্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী

সেই শুরু, এক গাদা জার্নাল নিয়ে বসে গেলাম। আমার দিনরাত্রির প্রায় সবটুকু কাটে ল্যাবরেটরিতে। প্রথমেই জানতে হবে, চকলেট কী?

চিনি, দুধ, ঘ্রাণ আর মূল উপাদানের হেরফের করে নানা ব্র্যান্ডের চকলেটে বাজারে সয়লাব। গ্রিন অ্যান্ড ব্ল্যাকস, তাজা, থিও, মিল্কা, মার্স, নেস্টেলে, গডিভা, পাচি, গাইলিয়ান, ক্যাডবারি, ফেরেরো, আরও কত কী!

নানা তথ্য ঘাঁটতে গিয়ে প্রথমেই হোঁচট খেলাম। পৃথিবীজুড়ে মানুষের খুবই প্রিয় এই মজার খাবার। শুধু তা–ই নয়, এটি একেবারে স্বয়ং ‘ঈশ্বরের খাদ্য’। বহু বছর পূর্বে একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী কোকোয়া গাছটির নামকরণ করেছিলেন এমন করেই।

কোকোয়া বিন

এমন নামকরণের যুক্তি আছে। বহু আগে থেকেই চকলেটের জাদুকরি স্বাদের কথা মানুষ জানত। মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার আদিবাসী অ্যাজটেক এবং মায়ারা ভগবানের খাবার চকলেট পানিতে গুলিয়ে ভগবানের পানীয় জ্ঞানে পান করত। এরপর আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে হার্নান কর্টেস নামে এক ইউরোপীয় অভিযাত্রী এই কোকোয়া বিনে লুকানো চমৎকার স্বাদের এবং সুগন্ধি ঘ্রাণের খাবারের সন্ধান পান। তিনি যেমনটি বলেছেন, ‘চকলেট অত্যন্ত উপাদেয়, সেই সঙ্গে জীবন রক্ষাকারী, এনার্জি প্রদায়ী খাবার’। আর এ জন্যই দুর্গম স্থানে অভিযানকারী সৈনিকেরা সঙ্গে চকলেট বহন করে। ধীরে ধীরে এই পৃথিবীর খাবারপ্রেমীরা বেশুমার পরিমাণে চকলেটের প্রেমে পড়েছেন।

কোকোয়া বিন হাতে একটি এজটেক ভাস্কর্য

আমি কাজে লেগে গেলাম। আমার কাজের জন্য শিল্পবর্জ্য হলো পনির শিল্পের ফেলে দেওয়া জল বা মাঠা আর অনুঘটক হলো লিপোজেনিক ইস্ট। এই অণুজীবের একটি বিশেষ গুণ হচ্ছে, খাবারে অতিরিক্ত চিনি থাকলে এককোষীটি শরীরে প্রচুর চর্বি জমা করে। আমাকে এমন ইস্ট কাজে লাগিয়ে উৎপাদন করতে হবে ‘কোকোয়া বাটার’ অর্থাৎ চকলেটের অন্যতম উপাদান ‘চকলেট মাখন’।

বলে রাখা ভালো, অণুজীব হলেও এই প্রজাতির ইস্ট খুব নিরাপদ এবং উপকারী। তা ছাড়া বেকারি এবং বিয়ার, অ্যালকোহল তৈরিতে নিরাপদ ইস্টের ব্যবহার সভ্যতার আদি থেকে চলে আসছে। এরা পাকা ফল, আখ, খেজুর, তাল ইত্যাদির মিষ্টি রসে জন্মায় এবং এরা খুব দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করতে পারে।

চকলেট কেক

প্রথমে বেশ কায়দা করে ইস্টের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মাঠার চিনিকে কোষের প্রায় ৮০ শতাংশ চর্বি (লিপিড) হিসেবে জমা করাতে সক্ষম হলাম। অর্থাৎ এক কেজি শুকনা ইস্ট থেকে প্রায় আট শ গ্রাম তেল অর্থাৎ চর্বি পাওয়া যাবে। কম কথা নয়। এমন স্নেহজাতীয় পদার্থের গুণগত মান বিশ্লেষণ করে দেখা গেল যে একদম সস্তার পাম তেলের মতো তেল উৎপাদন করছে এই ইস্ট। ইস্টকে কাজে লাগিয়ে এমন সস্তা এবং সহজলভ্য তেল উৎপাদনের কোনো মানে হয় না। তাই এর গুণগত মান উন্নয়নের চেষ্টা করতে শুরু করি এবং এটাই ছিল আমার প্রধান চ্যালেঞ্জ।

অবশেষে বংশগতির অণুতে খানিকটা প্রকৌশল কাজে লাগিয়ে একদম চকলেট মাখনের মতো স্বাদ, সুগন্ধের মাখন উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছি। যত সহজে এবং অল্প কথায় এমন অসাধ্য সাধনের কথা এখানে লিখেছি, তা তেমন সহজ মোটেই ছিল না।

আজ অণুজীব থেকে মজার চকলেট উৎপাদনের জৈবপ্রযুক্তি আমাদের হাতের মুঠোয় আছে। তবে অণুজীব এবং বর্জ্য—দুটোতেই সাধারণ মানুষের নেতিবাচক মনোভাব বেশ তীব্র। তাই এখনো সময় আসেনি বড়দিন বা ইস্টারে ইস্টের চকলেটে রসনা তৃপ্ত করার।

লেখক: ফ্রান্সপ্রবাসী গবেষক এবং লেখক।