
সরিষায় সরস সে মহিমা অপার
রজত কান্তি তার অতি মনোহর।
রায় কহে শোনো বাপু, খাও মন দিয়া
ভাজা ঝোল মাখো মাখো
কাছাটি খুলিয়া।
বাঙালি আর ইলিশ যেন একই সূত্রে গাঁথা। ইলিশের কথা বলেন না, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সৈয়দবাড়ির মানুষ মুজতবা আলী ইলিশের গুণগানই গেয়ে গেছেন আজীবন। আর মধ্যযুগের কবিরা মঙ্গলকাব্যসহ বিভিন্ন কাব্যে ইলিশ রান্নার কত যে প্রণালির কথা বলে গেছেন, তার কোনো হিসাব নেই। আমাদের ট্র্যাজেডির নায়িকা বেহুলার বিয়েতে ঝোল-ঝাল-ভাজাসহ রান্না হয়েছিল যে ১৮ পদের মাছ, তার ১ পদ ছিল ইলিশ!
নামের ফেরে
শুধু বাঙালিই নয়, বিভিন্ন জনপদের মানুষ বিভিন্ন নামে ইলিশ খায়। হিলসা, শ্যাড, মদার, বিম, পাল্লা, পোলাসা, গাঙ্গ, কাজলগৌরী, জলতাপী, মুখপ্রিয়া, চাসকি, চাসিস, মোদেন, পালভা—এই সবই ইলিশের বিভিন্ন নাম—আলাদা জনপদে। একটু খুলে বলি। সাগর থেকে নর্মদা নদী হয়ে ইলিশ যখন ব্রোচ অঞ্চলে চলে যায়, তখন তার নাম হয় মদার। পারসিরা তাকে ডাকে বিম নামে। সিন্ধু অঞ্চলে ইলিশের নাম পাল্লা। ভারতের গুজরাটে স্ত্রী ও পুরুষ ইলিশকে ডাকা হয় যথাক্রমে মোদেন ও পালভা নামে। তেলেগু ভাষায় এর নাম পোলাস, তামিলে ওলাম, কন্নড় ভাষায় পালিয়া, মারাঠিতে পলা।
আমাদের দেশেও বিভিন্ন জনপদে এবং বিভিন্ন অবস্থায় এর ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। যেমন চিটা, বিল্লি, খাল্লিশ, বাম, পাইটে, সকড়ি, রাজেশ্বরী ইত্যাদি। শোনা যায়, ইলিশ সাঁতার কেটে পরিশ্রান্ত হয়ে বিলে আশ্রয় নিলে তার নাম হয় বিলিশ। অবশ্য বাংলাদেশে ইলিশ নামের জনপ্রিয়তার আড়ালে সে নামগুলো হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। নামের কথাই যখন উঠল তখন বলে রাখি, এর বৈজ্ঞানিক নাম টেনুয়ালোসা ইলিশা, নামটি রাখেন ফ্রান্সিস হ্যামিলটন। ইলিশ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় মাছ। তবে পারস্য উপসাগর থেকে শুরু করে পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্র উপকূলে ইলিশ পাওয়া যায়।
আমাদের ইলিশ-সংস্কৃতি
ইলিশ বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। ভাজা, ভাপা, ঝোল আর তরকারি—এই চার পদ্ধতিতে ইলিশ খায় বাঙালি। ‘মাছের রাজা ইলিশ’ বলে ইলিশকে নিয়ে বাঙালি প্রবাদ বানিয়েছে। জীবনচর্চায় শত শত বছরের পরম্পরা তৈরি না হলে কোনো কিছু নিয়ে প্রবাদ তৈরি হয় না। ইলিশ আমাদের জীবনের এতটাই গভীরে ঢুকে গেছে যে আমরা জোড়া ইলিশকে বানিয়ে ফেলেছি শুভ ও মঙ্গলের প্রতীক। বিয়ের মতো শুভ কাজে আমরা এখন এক জোড়া রুই বা কাতলা মাছ দিই বটে। কিন্তু একসময় জোড়া ইলিশ দেওয়া হতো। বাঙালির নতুন বছর শুরু হয় ইলিশ খেয়ে। আমাদের অতিথি আপ্যায়নে ইলিশের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। যে পরিবারে ইলিশের যত বাহারি আয়োজন, সে পরিবারের ততটাই সুখ্যাতি।
১৯৭১ সালে বাঙালি যখন সর্বাত্মক যুদ্ধ করছে স্বাধীনতার জন্য, তখন মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ জোগাতে মুখে মুখে রচিত হয়েছে ছড়া—
ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা
বোয়াল মাছের দাড়ি।
ইয়াহিয়া খান ভিক্ষা করে
শেখ মুজিবের বাড়ি।
এভাবেই ইলিশ আমাদের জাতীয়তাবাদের সমার্থক হয়ে উঠেছে।
এই যে জীবনের এত পর্বে ইলিশের জড়িয়ে যাওয়া, তার প্রধান কারণ এর স্বাদ। ভাজা, ভাপা, ঝোল, তরকারি—যেভাবেই রান্না করা হোক না কেন, এই একমাত্র মাছ, যার স্বাদের কোনো কমতি হয় না। বরং ভাজা-ভাপা-ঝোল-তরকারি এই চার রান্নার স্বাদ চার রকম এবং অন্যান্য মাছের চেয়ে একেবারে আলাদা।
ইলিশ সাগর থেকে উঠে এসে মিঠাপানিতে ডিম পাড়ে। সাগর থেকে যতই সে উজানে আসতে থাকে, ততই তার শরীর থেকে লবণসহ বিভিন্ন সমুদ্রজাত খনিজ ঝরে যেতে থাকে। ইলিশ যত বেশি মিঠাপানিতে থাকবে, ততই তার স্বাদ বাড়বে। এ কারণে মোহনায় ধরা ইলিশ আর গোয়ালন্দের কাছের পদ্মায় ধরা ইলিশের স্বাদের মধ্যে পার্থক্য হয়। মিঠাপানি যত স্বচ্ছ এবং দূষণমুক্ত হবে, ইলিশের স্বাদ তত বেশি হবে। ইলিশের আঁশ অন্য যেকোনো মাছের চেয়ে নরম। খুব সম্ভবত নোনা ও মিঠাপানির জীবনচক্রে ইলিশের দৈহিক গঠনে রাসায়নিক যে পরিবর্তন হয়, সেই পরিবর্তনই তাকে সুস্বাদু করে তোলে অন্যান্য মাছ থেকে। ইলিশের মতো কোনো একটি মাছ দিয়ে এত বৈচিত্র্যময় খাবার আর কোনো দেশে তৈরি হয় বলে মনে হয় না। এই স্বাদ ও রন্ধনপ্রণালির বৈচিত্র্যের জন্য অন্যান্য মাছকে টেক্কা দিয়ে তৈরি হয়েছে আমাদের ইলিশ-সংস্কৃতি। এই ইলিশ-সংস্কৃতি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের খাদ্যসংস্কৃতি থেকে পৃথক করেছে বাঙালিয়ানাকে।