রেসিপি

বিয়েবাড়ির রান্নায় যার ডাক পড়ে

বিভিন্ন মসলা আর রান্নার নিজস্ব ধরনের গুণে পুরান ঢাকার খাবার বরাবরই অনন্য। গনগনে আগুনে ডেকচি বসিয়ে এসব মসলা দিয়ে তেলেসমাতি দেখান পুরান ঢাকার বাবুর্চিরা। এর মধ্যে আবার কোনো কোনো বাবুর্চির চাহিদা এতই বেশি যে স্লট বুকিং দিয়ে রান্না করেন তাঁরা। তেমনই এক বাবুর্চি মোহাম্মদ মঞ্জুর।

দেশভাগের আগে পিয়ারু বাবুর্চি ছিলেন পুরান ঢাকার অন্যতম খ্যাতিমান বাবুর্চি। সামির উদ্দিন বাবুর্চি আর কালু বাবুর্চিরও খুব নামডাক ছিল। স্বাধীনতার আগে পুরান ঢাকার রান্নায় জনপ্রিয়তা পান লুলা বাবুর্চি ওরফে খোদাবক্স। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ছড়িয়েছিল তাঁর সুনাম। এই সময়ের তেমনই এক বাবুর্চি মোহাম্মদ মঞ্জুর।

আমৃত্যু রান্না করতে চান বাবুর্চি মোহাম্মদ মঞ্জুর

শীতের মৌসুমে তাঁর দম ফেলার ফুসরত থাকে না। সকাল–বিকেল রান্না করতে থাকেন। এখন অবশ্য আগের থেকে পরিস্থিতি কিছুটা বদলে গেছে বলে জানালেন মোহাম্মদ মঞ্জুর। বলেন, ‘আগে যেইহানে কাজ পাইতাম সপ্তায় ১০–১২টা। এখন সেটা কমে ৪–৫টা হয়েছে।’

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার দ্বিগুবাবু লেন মহল্লার বাসিন্দা মঞ্জুর। তাঁর বাবা মোহাম্মদ চানও ছিলেন নামকরা বাবুর্চি। তবে রান্নায় বাবার কাছ থেকে তালিম পাননি মঞ্জুর, রান্না শিখেছেন মেজ ভাই আলম চানের কাছে। ১৭ বছর বয়স থেকে মেজ ভাই তাঁকে রান্নার প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। কোন মসলা কোন খাবারের জন্য নয়, কোনটা ঠিক কতটুকু দিলে মাংসের ভেতর পর্যন্ত পৌঁছাবে, রান্নার কোন পর্যায়ে এসে আঁচ ঠিক কতটা কমাতে হবে—এসব এখন চোখ বন্ধ করেই সারতে পারেন মঞ্জুর।

চোখ বন্ধ করেই রান্নার কাজ সারতে পারেন মঞ্জুর

বাবুর্চি পেশায় ৩৪ বছর পার করছেন মঞ্জুর৷ এই পেশাতেই সুনামের সঙ্গে মরার ইচ্ছা পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘বিয়াবাড়ির খাওন না খালি আমগো আলাম ডাকাইয়া খাওন মোগলগো ঐতিহ্য আচে। বিশ্বাস করেন, রানতে আমার খুব বাল্লাগে। মাইনসে খায়া বালা কইলে বুকটা বইরা যায়গা। আগে খাওনের আইটেম কম আছিল, অহন বাড়ছে। মাগার হালায় এই ক্যাটারিং না ফ্যাটারিং আমগো বাতে হাত দিছে। আগের চায়া কাম বাড়লেও এগো লেগা ঝামেলায় আচি। তারপর চায়নিজ আর বুফে। আচ্চা কন দেহি ভাই, এরা আমগো খাওনের লগে পাড়ব?’

শীতের মৌসুমে তাঁর দম ফেলার ফুসরত থাকে না

আগের দিনে মুরগি, খাসি, বুন্দিয়া পোলাও ও বোরহানি ছিল মূল আইটেম৷ সময় গেছে, আইটেম বাড়ছে। এখন সাদা পোলাও, মোরগ পোলাও, টিকিয়া, খাসি, নানরুটি, শিরমাল রুটি, জর্দা, ফিরনিসহ নানা পদ নিয়ে আয়োজন হয় বিয়েবাড়ির খাবার।

তবে আয়োজন বাড়লেও বাবুর্চির পরিশ্রম সেই তুলনায় বাড়েনি। এক হাজার লোকের রান্না করে ১০-১২ জনের দল নিয়ে ৩০-৩৫ হাজার টাকা পান, জানালেন মঞ্জুর বাবুর্চি। সে টাকাও অনেক সময় নগদ পাওয়া যায় না!

মঞ্জুর ভাইকে বিদায় জানিয়ে চলে আসব—এমন সময় মঞ্জুর বাবুর্চিকে ডাকতে এল তাঁর একমাত্র ছেলে। ছেলেকে দেখিয়ে মঞ্জুর ভাই বলেন, ‘এই যে আমার পোলা। আপনেরা যতই বুফে আর চায়নিজে যান না কেন, আমার পোলা শেফ না, বাবুর্চিই হইব, বিয়াবাড়ির খাওন–রান্দনের বাবুর্চি!’