আমার ৬৬ বছরের বাবা ১৮ বছরের এক তরুণীর প্রেমে পড়েছেন

পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।

অবসরের পর কেউ কেউ সম্পর্কের ক্ষেত্রে দিশেহারা হতে পারেন
প্রতীকী ছবি: এআই/প্রথম আলো

প্রশ্ন: আমার বাবার বয়স ৬৬ বছর। তিনি কোভিডের সময় অবসরে যান এবং মুঠোফোনে আসক্ত হয়ে পড়েন। সেখান থেকেই তিনি ১৮ বছর বয়সী এক তরুণীর প্রেমে পড়েন। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর মা সেটার প্রতিবাদ করেন। এরপর মাকে আমার বাবা প্রথম তালাক দেন। মা পরে বিষয়টি ফুফুদের জানান। মাকে এবার দ্বিতীয় তালাক দেন বাবা। এরপর ওই তরুণীর সঙ্গে প্রেমের বিষয়টি পরিবারে জানান। তরুণীকে বিয়ে করার জন্য তাঁর পরিবারের সঙ্গেও দেখা করেন। কিন্তু তাঁর প্রস্তাব নাকচ করে মেয়েটিকে অন্যত্র বিয়ে দেয় তরুণীর পরিবার। এরপরও তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ বিদ্যমান। আমি জিজ্ঞাসা করলে বাবা জানান, বিয়ে না হলেও তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকবে। তাঁদের নিয়মিত চ্যাটিং চলছে, দেখাও করছেন এবং এতে বাধা দিলে মাকে তৃতীয় তালাক দেবেন বলে সাবধান করেছেন। তরুণীর পরিবারকে বিষয়টি অবগত করার পর তাঁরা বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। জানতে পেরেছি, আমার বাবার কাছ থেকে তাঁরা আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছেন। বাবা এখন দাদার থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া জমির একাংশ বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, পরিবার টিকিয়ে রাখতে আমার মা কি আইনি সহায়তা পেতে পারেন? তিনি আর্থিক দিক থেকে বাবার ওপর নির্ভরশীল, তাই আইনগতভাবে পদক্ষেপ নেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত? দ্বিতীয়ত, মুসলিম আইন অনুযায়ী বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলে তাঁর সন্তান কি তাঁকে বাধা দিতে পারে? পিতা কি সন্তানকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারবেন? শেষ প্রশ্ন, পরকীয়া বন্ধে তরুণী বা তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে আমরা কি মামলা করতে পারি?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

উত্তর: আপনার পরিবার একটি বড় সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। যার ভিত্তিতে অনেকগুলো প্রশ্ন আপনি করেছেন। একটি একটি করে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছি।

প্রথমত, বাবা যে পদ্ধতিতে আপনার মাকে তালাক দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন, সেটি আইনসিদ্ধ নয়। এভাবে তালাক হওয়ার কোনো সুযোগ এখানে নেই।

আপনার বাবা অন্য নারীতে আসক্ত এবং আপনার মাকে ডিভোর্স দিতে চাইছেন। বৈবাহিক সম্পর্কে কোনো এক পক্ষ যেকোনো কারণে যদি সম্পর্কটি আর রাখতে না চান, সে ক্ষেত্রে জোর করে বিয়ে টিকিয়ে রাখার সুযোগ আইনগতভাবে নেই। আইনগতভাবে বিচ্ছেদ ঠেকানোর কোনো উপায় নেই।

তবে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের বিষয়টি পারিবারিক আদালতের এখতিয়ারে দেওয়া রয়েছে। আইনানুযায়ী আদালত ডিক্রি জারি করতে পারেন। আপনার বাবা যদি কোনো কারণ ছাড়া আপনার মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখেন, তাহলে দাম্পত্য অধিকার দাবি করে আপনার মা পারিবারিক আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন। দাম্পত্য অধিকার উদ্ধারের বিষয়টি সাধারণত আদালতের বিবেচনার ব্যাপার। উভয়ের মধ্যে বিয়ে কার্যকর আছে কি না, আদালত তা দেখতে চাইবেন। এ অধিকার প্রতিষ্ঠায় আপনার মাকে প্রমাণ করতে হবে যে আপনার বাবা কোনো কারণ ছাড়াই তাঁর সঙ্গে পারিবারিক বা দাম্পত্য সম্পর্ক রাখছেন না।

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, খোরপোশ বা ভরণপোষণ স্ত্রীর আইনগত অধিকার। স্ত্রীর খোরপোশ দেওয়া স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক। যত দিন বিয়ে বলবৎ থাকবে, তত দিনই খোরপোশ দিতে বাধ্য থাকবেন স্বামী। কাজেই আপনার মা যদি আর্থিকভাবে আপনার বাবার ওপর নির্ভরশীল হন, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই মামলা করলে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

আপনার আরেকটি প্রশ্ন ছিল, সন্তান হিসেবে আপনার বাবাকে দ্বিতীয় বিয়েতে বাধা দিতে পারবেন কি না। আইনগতভাবে তাঁকে বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই।

মিতি সানজানা

আইন অনুযায়ী, একজন স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় আরেকটি বা একাধিক বিয়ে করাকে বহুবিবাহ বলে। মুসলিম শরিয়াহ আইন অনুযায়ী একজন পুরুষ একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী রাখতে পারেন। যদি কেউ স্ত্রী বর্তমান থাকাকালে আরেকটি বিয়ে করতে চান, তবে তাঁকে বর্তমান স্ত্রীর এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে আরেকটি বিয়ে করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করতে হবে।

মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১-এর ৬ ধারামতে, দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে সালিসি পরিষদের কাছে অনুমতি না নিলে বিয়ে নিবন্ধন হবে না। অনুমতির জন্য নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিয়ের অনুমতি দিতে যে বিষয়গুলো বিবেচনা করা হবে, বর্তমান স্ত্রীর বন্ধ্যত্ব, মারাত্মক শারীরিক দুর্বলতা, দাম্পত্য জীবন–সম্পর্কিত শারীরিক অযোগ্যতা, দাম্পত্য অধিকার পুনর্বহালের জন্য আদালত থেকে প্রদত্ত কোনো আদেশ বা ডিক্রি বর্জন, মানসিকভাবে অসুস্থতা ইত্যাদি।

কোনো পুরুষ যদি সালিসি পরিষদের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করেন, তবে তাঁকে অবিলম্বে তাঁর বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের আশু বা বিলম্বিত দেনমোহরের সম্পূর্ণ টাকা সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান স্ত্রী আদালতে মামলা করে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করার অধিকার রাখেন। দ্বিতীয় বিয়ে করার কারণে প্রথম স্ত্রী আলাদা বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিলেও তিনি ভরণপোষণ পাবেন। এ ক্ষেত্রে নাবালক সন্তানদের ভরণপোষণ বাবাকে দিতে হবে। ভরণপোষণের পাশাপাশি স্ত্রী ও সন্তানদের উত্তরাধিকারীর অধিকার কোনো অবস্থাতেই খর্ব হবে না। এ ছাড়া অনুমতি না নেওয়ার অভিযোগে স্বামী দোষী সাব্যস্ত হলে এক বছর পর্যন্ত জেল ও ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করার ঘটনা অহরহ ঘটছে, যা আইনিভাবে ঠিক নয়। বিয়েসংক্রান্ত প্রতারণা বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

আপনি আরও জানতে চেয়েছেন, পিতা সন্তানদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেন কি না। একজন ব্যক্তি চাইলে জীবিত অবস্থায় তাঁর সম্পত্তি অন্য উত্তরাধিকারদের দান করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত প্রযোজ্য।

আপনার শেষ প্রশ্নের উত্তরে বলতে চাই, যে তরুণীর সঙ্গে আপনার বাবার সম্পর্ক, তাঁকে বা তাঁর পরিবারের নামে মামলা করার কোনো সুযোগ আপনাদের নেই।

আশা করি, আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন।

লেখা পাঠানোর ঠিকানা

পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। ই–মেইল ঠিকানা: adhuna@prothomalo.com (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ডাক ঠিকানা : প্র অধুনা, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA