প্রতীকী এই ছবিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মডেল হয়েছেন শিশু সাহিত্যিক আখতার হুসেন
প্রতীকী এই ছবিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মডেল হয়েছেন শিশু সাহিত্যিক আখতার হুসেন

শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক

শিক্ষকেরা তোমাদের প্রতিপক্ষ নন

জ্ঞানের রাজ্যে অসংখ্য ঘর আছে। শিক্ষক সেসব ঘরে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যান। হাত ধরে নতুন নতুন ঘর চেনান। জ্ঞানের রাজ্যের খোঁজ পেয়ে পুলকিত হয় শিক্ষার্থী। শিক্ষকের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা চলার পথের দিশা পায়। নতুন জ্ঞান সৃজনের দক্ষতা অর্জন করে।

অবশ্য শিক্ষক ছাড়াও পৃথিবীতে অনেক মানুষ বড় হয়েছেন। তবে শিক্ষক পাশে থাকলে কাজটি সহজ হয়। প্রাচীন ভারতবর্ষে আশ্রমকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। তখন গুরুগৃহে থেকে বিদ্যা অর্জন করতে হতো। সরাসরি অর্থ লেনদেনের ব্যাপার ছিল না। প্রাচীন গ্রিসেও শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে কোনো অর্থের বিনিময় যুক্ত ছিল না। গাছতলায় বসে কিংবা পথে দাঁড়িয়েই জ্ঞান বিতরণের কাজ করতেন শিক্ষক।

আদি থেকেই শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীর ভক্তির ব্যাপারটি দেখা যায়। এই ভক্তির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে শ্রদ্ধা মেশানো ভয়। তবে নানা কারণে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকের ওপর ভক্তি-শ্রদ্ধা হারিয়েছে। এর সঙ্গে হারিয়েছে ভয়, ভালোবাসা। এ জন্য দায়ী কে কিংবা কী? শিক্ষক, না শিক্ষার্থী? নাকি আরও কিছুর দায় রয়েছে?

জুলাই আন্দোলনের পর থেকেই চারদিকে শিক্ষক হেনস্তার খবর দেখছি। মনে হয়, এই তো থেমে যাবে। কিন্তু পুরোপুরি থামছে না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের অবনতির পেছনে প্রথম দায় শিক্ষকের। তাঁর আসল কাজ ছিল শ্রেণিকক্ষে পড়ানো। অথচ কি স্কুল কি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়—সব জায়গাতেই একই অভিযোগ—শিক্ষকেরা ক্লাসে ঠিকমতো পড়ান না। তাঁরা ‘ব্যাচে’ পড়লে বেশি নম্বর দেন। সিলেবাস শেষ না করেই পরীক্ষা নেন।

আগের দিনে শিক্ষক নানা রকম উপদেশ দিতেন। বলতেন, সদা সত্য কথা বলবে। সৎ কাজ করবে। লোভ করবে না। কাউকে কষ্ট দেবে না। আর এখনকার অনেক শিক্ষক নিজেই সত্য বলা ছেড়েছেন। ব্যক্তিস্বার্থে সৎ-অসতের পার্থক্য ভুলেছেন। অর্থবিত্তের লোভ তাঁর প্রবল। শিশুশিক্ষার্থীর সঙ্গেও অমানবিক আচরণ করেন।

একালে শিক্ষক আরও কিছু কারণে শিক্ষার্থীদের আস্থা হারিয়েছেন। সবাই বলে, দেশের রাজনীতি পচে গেছে। শিক্ষকদের অনেকে সেই পচা রাজনীতির লেজ ধরেছেন! নিজের স্বার্থকে আর সবকিছুর চেয়ে বড় করে দেখতে চান। গত কয়েক দশকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গাতেই শিক্ষক–রাজনীতি প্রবলভাবে ‘দলীয়’ রূপ লাভ করেছে।

ন্যায়-নীতি-আদর্শের শিক্ষা দেন শিক্ষক

সবাই জানে, ন্যায়-নীতি-আদর্শের শিক্ষা দেন শিক্ষক। অথচ সেই শিক্ষকেরাই ন্যায়-নীতি-আদর্শ হারাতে বসেছেন। এটা দেখে শিক্ষার্থীরা কষ্ট পেয়েছে, অবাক হয়েছে। তাদের চাপা কষ্ট এখন শিক্ষকের কাছে অপমান আর আঘাত হয়ে ফিরে এসেছে। রাজনীতিবিদদের মতো অনেক শিক্ষকও তাই শিক্ষার্থীদের কাছে অভিযুক্ত হয়েছেন। শিক্ষকদের অপমান করতে শিক্ষার্থীরা তাই দ্বিধা করেনি। গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা অনেক শিক্ষককে তারা জোর করে পদত্যাগ করিয়েছে। কোনো কোনো শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরিয়েছে। এমনকি অনেক শিক্ষকের গায়েও হাত তুলেছে!

শিক্ষকেরা যেগুলো কোনো দিন ভাবেননি, ভাবতে পারতেন না, সেগুলোই হয়েছে। এসব হেনস্তা ও হয়রানি শুধু ওই সব শিক্ষককে অপমানিত করেনি, পুরো শিক্ষক-সমাজকে অপমানিত করেছে। শিক্ষকেরা সাধারণভাবে সংবেদনশীল হয়ে থাকেন। এসব ঘটনায় তাঁরা ভেতরে ভেতরে দুমড়েমুচড়ে গেছেন। শিক্ষার্থীদের অভাবিত আচরণে তাঁরা বিস্মিত হয়েছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কীভাবে বোঝাবেন, ভেবে পাননি। শিক্ষার্থীরাও ঠিকমতো বুঝতে পারেনি, তাদের কী করা উচিত।

একটি অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে অনেক কিছু ঘটতে পারে। যা স্বাভাবিক, তা ঘটতে পারে; যা স্বাভাবিক নয়, তা–ও ঘটতে পারে। যা ভাবা যায় তা যেমন ঘটে, যা ভাবা যায় না তা–ও ঘটে। শিক্ষকদের সঙ্গে এসব অপমান ও হয়রানিমূলক ঘটনা তারই প্রমাণ। কিন্তু এমন তো অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে না, একটা জায়গায় এসে তো থামতে হবে। শিক্ষার্থীদেরও থামতে হবে। শিক্ষক ‘স্বৈরাচারের দোসর’ হতে পারেন। শিক্ষক আরও অনেক কারণে অভিযুক্ত হতে পারেন। তবু তাঁকে সরাসরি শারীরিকভাবে আক্রমণ করা যায় না। ‘মব’ তৈরি করে কখনোই কোনো পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নেওয়া ঠিক না।

শিক্ষার্থীদের কাছে যাঁরা ভালো শিক্ষক হিসেবে পরিচিত, তাঁদেরও দায়িত্ব আছে। তাঁরা শিক্ষার্থীদের বোঝাবেন, ক্ষোভ প্রকাশের উপায় কী। শেখাবেন প্রতিবাদ জানানোর ভাষা কেমন হতে পারে। দেশে আইন আছে, বিচার আছে। সেগুলো অস্বীকার করে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। শিক্ষার্থীরা তাদের আচরণ দিয়েই বোঝাবে, তারা ‘শিক্ষিত’। শিক্ষার আলো শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লোগো বা সার্টিফিকেটে থাকে না। শিক্ষার্থীদের জীবন ও কাজের মধ্যেও এই আলোর প্রকাশ থাকতে হয়।

কোনো শিক্ষক কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতেই পারে। তাই বলে সেই শিক্ষক বা সেই ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করা যাবে না। সংক্ষুব্ধ পক্ষকে বোঝাতে হবে, এভাবে সমস্যার সমাধান হয় না। এভাবে সমাজ আর সমাজের মানুষের মধ্যে বিভাজন বাড়ে। বরং অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো যায়। অভিযোগের প্রমাণ হাজির করে নিজেদের দাবিকে জোরালো করা যায়।

আমরা যে দেশ চেয়েছি, তেমনটি এখনো পাইনি। যেমন সমাজ চেয়েছি, তেমনটি রয়ে গেছে অধরা। যেসব বিধিব্যবস্থা আশা করেছি, সেগুলো কবে পাব, জানি না। তবে আমাদের হতাশ হলে চলবে না। যে শিক্ষার্থীদের নিয়ে এত কথা, তারাই আমাদের বারবার আশাবাদী করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শিক্ষার্থীরা সব সময় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানেও শিক্ষার্থীরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। আর সব সময়ই তাদের পাশে থেকেছেন ড. শামসুজ্জোহার মতো হাজারো শিক্ষক। আমাদের অধরা সেই বাংলাদেশ গড়তেও শিক্ষার্থীদের পাশে আছে বৃহৎ শিক্ষক–সমাজ।