দাম্পত্য সমস্যা সমাধানে কাপল কাউন্সেলিং নিয়ে অনেকের মধ্যে দ্বিধা কাজ করে। কাউন্সেলর সায়মা রহমানের সঙ্গে মডেল হয়েছেন বেনজির ও কাউসার
দাম্পত্য সমস্যা সমাধানে কাপল কাউন্সেলিং নিয়ে অনেকের মধ্যে দ্বিধা কাজ করে। কাউন্সেলর সায়মা রহমানের সঙ্গে মডেল হয়েছেন বেনজির ও কাউসার

সম্পর্কের অসুখ সারাতে কাপল কাউন্সেলিং কতটা উপকারী?

বলা হয়ে থাকে, আমাদের সব সুখ ও অসুখের মূল হলো পরিবার। পরিবারে শান্তি থাকলে বাইরের মানসিক চাপগুলো সহজে সামলে নেওয়া যায়। কিন্তু নানা কারণে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ও দাম্পত্য হয়ে উঠতে পারে জটিল। শৈশবের তিক্ত কোনো অভিজ্ঞতা বা মানসিক আঘাত থেকে এটা হতে পারে, সম্পর্কে সততা ও বিশ্বাসের অভাব থেকে তৈরি হতে পারে এই জটিলতা, আবার যোগাযোগ ও সামাজিক দক্ষতার ঘাটতি বা মাদকাসক্তিও হতে পারে সংকটের কারণ।

নিজেদের মধ্যে আলাপ–আলোচনা করে সংকট নিরসন করতে পারলে সবচেয়ে ভালো। তবে অনেক সময় বাইরের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তেমনই একটি উপায় পরিবার ও যুগল কাউন্সেলিং। এই মানসিক স্বাস্থ্যসেবাটির মাধ্যমে সেবা গ্রহণকারীরা তাঁদের সম্পর্ক ও সম্পর্কের জটিলতাগুলোকে বুঝতে পারেন। এরপর কাউন্সেলরের উপস্থিতিতে বা মধ্যস্থতায় একে অপরকে আন্তরিকভাবে শোনার মধ্য দিয়ে দ্বন্দ্বের জায়গাগুলো শনাক্ত করেন। পরে কাউন্সেলরের সহযোগিতায় দ্বন্দ্বগুলো মিটিয়ে নিতে পারেন।

পারিবারিক কাউন্সেলিংয়ে সাধারণত পরিবারের সব সদস্য যুক্ত থাকেন। থেরাপিস্ট বা কাউন্সেলর পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে নিয়ে বসেন, প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবেও বসেন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, সমস্যা সমাধান, যোগাযোগের উন্নয়ন, দ্বন্দ্ব নিরসন এবং একে অপরকে বোঝার দক্ষতা বাড়ানোই এ ধরনের কাউন্সেলিংয়ের মূল উদ্দেশ্য।

অন্য দিকে কাপল বা যুগল কাউন্সেলিংয়ে কাউন্সেলর দম্পতির মধ্যে অবিশ্বাস, দূরত্ব ও সম্পর্কের অন্যান্য সমস্যার সমাধানে সাহায্য করে। যুগল কাউন্সেলিং যেহেতু দুজন ব্যক্তির, তাই এখানে শুধু দুটি পক্ষ থাকে। পরিবারের ক্ষেত্রে আরও বেশি পক্ষ থাকতে পারে। থেরাপিস্ট সব পক্ষকে তাদের অনুভূতি ও চাহিদা প্রকাশে সাহায্য করেন। তাঁদের সমস্যা সমাধান ও যোগাযোগে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করেন। ফ্যামিলি বা কাপল কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ায় কাউন্সেলর যেহেতু পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একসঙ্গে বসার পাশাপাশি প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবেও বসেন ও কাজ করেন, তাই প্রত্যেকেরই মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন হয়। কাউন্সেলিংয়ে যুক্ত প্রত্যেক সদস্যই মানসিকভাবে আরাম এবং কিছু থেরাপিউটিক সুবিধা পান। যেমন—

যুগল কাউন্সেলিং যেহেতু দুজন ব্যক্তির, তাই এখানে শুধু দুটি পক্ষ থাকে

আবেগীয় নিরাময়

পরিবার ও কাছের মানুষের সঙ্গে অশান্তিপূর্ণ সম্পর্ক, বাইরের বিভিন্ন উৎস থেকে আসা মানসিক চাপ এবং দিনের পর দিন অপূর্ণ চাওয়াগুলো একজন মানুষের ভেতরে দমবন্ধ অনুভূতির সৃষ্টি করে। কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি তাঁর কথাগুলো খোলামেলাভাবে বলে কষ্টকর অনুভূতিগুলোকে মুক্ত করে দেন। কাউন্সেলর একক সেশনে কোনো প্রকার রায় না দিয়ে তাঁর কথাগুলোকে পরম মমতা নিয়ে শোনেন। পারিবারিক সেশনে তাঁর অনুভূতি ও চাহিদাগুলোকে পরিবারের মানুষের কাছে নির্দ্বিধায় বলার জন্য পরিবেশ তৈরি করে দেন। অপূর্ণ চাহিদাগুলো পূরণ করার পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেন। ফলে দেখা যায়, কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তিই আবেগীয়ভাবে আরাম বোধ করেন, জীবন সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে ওঠেন।

আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি

কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তাঁর চিন্তাভাবনা, অনুভূতি, চাহিদা, আচরণ ও সম্পর্কগুলোকে বুঝতে পারেন। নিজের সম্পর্কে এই সচেতনতা তাঁকে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সামলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলো সুস্থভাবে পরিচালনা করে মানসিক শান্তিতে থাকতে সহযোগিতা করে।

কাউন্সেলিং–এ যুক্ত হওয়ার পর ব্যক্তি তাঁর চিন্তাভাবনা সম্পর্কে বুঝতে পারেন

সহ্যক্ষমতা বৃদ্ধি

আমরা কেউই নিখুঁত নই। আমাদের প্রত্যেকেরই যেমন বেশ কিছু গুণ থাকে, তেমনি কিছু খুঁত বা দুর্বলতাও থাকতে পারে। কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তি বুঝতে পারেন, সবকিছু পরিবর্তন করা যায় না এবং তার প্রয়োজনও নেই। যা পরিবর্তন করা যায় না, আবার বর্জনও করা যায় না, তা গ্রহণ করার মানসিকতা আমাদের শান্তিতে থাকতে সহযোগিতা করে। কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিবারের সদস্যরা যেমন কঠিন সময়ে মানসিক যাতনা সামলে নিতে শেখেন, পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রেখে অনুভূতি ও চাওয়াগুলোকে প্রকাশ করতে শেখেন, তেমনি নিজেকে ও অন্যকে গ্রহণ করে নেওয়ার মতো মানসিকতাও অর্জন করেন।

যোগাযোগে দক্ষতা বৃদ্ধি

কাউন্সেলর দুজনের কথাই মন দিয়ে শোনেন

আমাদের যোগাযোগ মূলত দুই ধরনের হয়—নিজের সঙ্গে যোগাযোগ ও অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ। নিজের সঙ্গে যোগাযোগ হলো নিজের ভেতরে কী চলছে, তা বুঝে পদক্ষেপ নিতে পারা। অর্থাৎ নিজের অনুভুতি ও চাওয়াগুলোকে বুঝে পদক্ষেপ নিতে পারা। আর অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের মানে হলো, অন্যের কাছে নিজের কথাগুলো স্পষ্টভাবে বলতে পারা। সেই সঙ্গে অন্যরা কী বলতে চাচ্ছে, কী অনুভব করছে, তা বুঝতে পারা। ফ্যামিলি হোক বা কাপল কাউন্সেলিং—সেখানে কাউন্সেলর প্রত্যেক সদস্যের যোগাযোগে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করেন।

বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা ও সম্পর্কের উন্নয়ন

যুগল ও পরিবার কাউন্সেলিংয়ে কাউন্সেলর উভয় পক্ষের অনুভূতি ও চাহিদাগুলোকে বলা ও শোনার মাধ্যমে চলমান সংঘাত নিরসনে সহযোগিতা করেন। আবার ভবিষ্যৎ সংঘাত মোকাবিলার জন্য যোগাযোগদক্ষতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করেন। ফলে দেখা যায়, কাউন্সেলিংয়ে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যরা মানসিক ক্ষত সারিয়ে সম্পর্কগুলোর ব্যাপারে যত্নশীল হয়ে ওঠেন।

সম্পর্কে সীমারেখার চর্চা

সীমারেখা হলো এমন একটি অদৃশ্য ও প্রতীকী বেড়া, যার মূলত তিনটি উদ্দেশ্য থাকে—

১. আমার ব্যক্তিগত গণ্ডির ভেতরে প্রবেশ করে আমাকে নিপীড়ন করা থেকে অন্যদের বিরত রাখা।

২. অন্যের ব্যক্তিগত গণ্ডির ভেতরে প্রবেশ করে অন্যকে নিপীড়ন করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা।

৩. প্রত্যেকেরই যে নিজস্ব ব্যক্তিসত্তা আছে, সে ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল ও সজাগ থাকা।

পারিবারিক সম্পর্কগুলোকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে হলে সীমারেখা চর্চার কোনো বিকল্প নেই। পারিবারিক বা দাম্পত্য কাউন্সেলিংয়ে কাউন্সেলর পরিবারের সদস্যদের সীমারেখা বুঝতে ও চর্চা করতে সহযোগিতা করেন। যেকোনো সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা আমাদের সবার মধ্যেই রয়েছে। তেমনি পারিবারিক জটিলতা ও সমস্যাগুলো সমাধানের সক্ষমতাও আমাদের রয়েছে। কাউন্সেলিংয়ের কাজ হলো আমাদের সেই সক্ষমতা উপলব্ধি ও বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করার মাধ্যমে সমাধানের কাজটিকে সহজ করে দেওয়া।