
চলতি বছর জেন-জিরাই আলোচনায় ছিল বেশি। তাদের কথাবার্তা ও জীবনযাপন নিয়ে অন্যান্য প্রজন্মের মধ্যে ছিল কৌতূহল। সম্পর্কের নতুন নতুন শব্দ যেমন জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তেমনি সেসবের চর্চাও বেড়েছে ২০২৪ সালের জীবনযাপনে। চলতি বছর সম্পর্কের প্রধান প্রবণতাগুলোর খবর জানুন
সিচুয়েশনশিপ, সোজা বাংলায় দায়হীন সম্পর্ক। না বন্ধুত্ব, না প্রেমের এই সম্পর্কে থাকা মানুষ উথালপাতাল প্রেমে পড়তে চান না। প্রাণভরে ভালোবাসার চেয়ে তাঁরা বর্তমানে থাকতে বেশি পছন্দ করেন। দুজনের কারও মধ্যেই আজীবন টিকিয়ে রাখার মতো কোনো প্রতিশ্রুতি থাকে না। যাঁদের জেনারেশন জি বলা হয়, তাঁরাই এ ধরনের সম্পর্কে জড়াচ্ছেন বেশি। কখনো জেনেশুনে, কখনো দীর্ঘ সম্পর্কে জড়ানোর ভীতি থেকে তাঁদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে গোলমেলে এই সম্পর্ক।
এই সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা থাকে। যুগলেরা প্রেমিক-প্রেমিকার মতো একসঙ্গে সময়ও কাটান। তবে সম্পর্কটি ততক্ষণই থাকে, যতক্ষণ কোনো পক্ষই এই সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত না করে। অর্থাৎ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ না ভাবেন। আপাতদৃষ্টে তাই যে কেউ তাঁদের দেখে ধন্দে পড়তে পারেন। কারণ, এখানে দুজন ব্যক্তির মধ্যে যে কেউ, যেকোনো সময় অন্যজনকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন। আর সেটা নিয়ে অন্যজন তাঁকে দোষারোপ করতে পারেন না।
সময়ের সঙ্গে প্রেমের ধরনে বদল এসেছে। এসেছে নানা পরত। মানুষ এখন আর কেবল সংসার পাতা বা সন্তান উৎপাদনের জন্য প্রেম, বিয়ে করে না। অনেকের কাছেই শারীরিক সৌন্দর্য ছাপিয়ে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে বুদ্ধিমত্তা। যাঁরা একটা মানুষের বুদ্ধিমত্তার প্রেমে পড়েন, তাঁদেরই ডাকা হয় সেপিওসেক্সুয়াল। সেই বুদ্ধিমত্তা কৃত্রিমও হতে পারে। আর এ কারণেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেও প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। এ ধরনের মানুষদের সংক্ষেপে ডাকা হয় সেপিও।
সেপিওদের ধরন দুই রকম। এক, যাঁরা বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে আকর্ষণ বোধ করেন। দুই, যাঁদের কাছে যৌনতা মুখ্য নয়। বরং মানুষটার সঙ্গে বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, রাজনীতি, দর্শন নিয়ে আলোচনা করতেই ভালোবাসেন তাঁরা। এটাকে বলা যায় প্লেটোনিক ধরনের প্রেম। যেখানে থাকে না যৌনাকাঙ্ক্ষা কিংবা যৌন আকর্ষণ থাকলেও সেটি মুখ্য নয়।
সামনে এআইয়ের (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোও হয়তো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কারণ, বাস্তব ও ভার্চ্যুয়ালের পার্থক্য ধীরে ধীরে অনেকটাই কমে আসবে। ধারণা করা হচ্ছে যে সময়ের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গ প্রেম করাটাই হয়ে উঠবে চলতি ধারা। ইতিমধ্যে ‘এক ঘণ্টা এক ডলার’ হিসেবে বিভিন্ন অ্যাপে পছন্দসই চেহারার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কথা বলা, মনের ভাব আদান–প্রদানের সেবা চালু হয়েছে।
‘টুইন ফ্লেম’ মূলত একধরনের আত্মিক সম্পর্ক, যা কেবল অনুভবের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়। একজন যদি আত্মার অর্ধেক হয়ে থাকেন, তাহলে অন্যজন হবেন বাকি অর্ধেক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টুইন ফ্লেমের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত অনেক মিল দেখা যায়। দুজন ভিন্ন মানুষ, কিন্তু তাঁদের মধ্যকার চিন্তাভাবনা, আচার, ব্যবহার ও কথায় অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আচরণগত ও রুচিগত সাদৃশ্যের কারণে এ জাতীয় সম্পর্কের মানুষদের মধ্যে আকর্ষণবোধ বেশি কাজ করে। তাই কখনো কখনো তাঁদের ‘মিরর সোল’ বা ‘সোলমেট’ হিসেবেও ডেকে থাকেন কেউ কেউ।
সোলমেট সব সময় ‘টুইন ফ্লেম’ নয়, তবে ‘টুইন ফ্লেম’ সোলমেট হতে পারে। সোলমেট সব সময় রোমান্টিক না–ও হতে পারেন, কিন্তু ‘টুইন ফ্লেম’ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোমান্টিক হন। ‘টুইন ফ্লেম’ চিকিৎসাশাস্ত্র বা বিজ্ঞানস্বীকৃত কোনো বিষয় নয়। তবে সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে বেশ চর্চা হচ্ছে তরুণদের মধ্যে। ইংরেজ উপন্যাসিক ‘মারি কোরেলি’ ১৮৮৬ সালে তাঁর উপন্যাস ‘আ রোমান্স অব টু ওয়ার্ল্ডস’ বইতে প্রথমবার এই শব্দ ব্যবহার করেন। তিনি অবশ্য লিখেছিলেন ‘টুইন রেস’ যা পরে ‘টুইন ফ্লেম’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
‘টুইন ফ্লেম’ একটি জটিল পরিস্থিতি। এতে ফ্যান্টাসি, প্রত্যাশা ও স্বপ্ন অনেক বেশি থাকে, যা ভবিষ্যতে অনেক সময় জটিলতার সৃষ্টি করে। টুইন ফ্লেমের ধারণাটি কিছু বিশ্বাসের সমষ্টিমাত্র। তবে এর মাধ্যমে আপনি আপনার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেতে পারেন।
ডেটিং অ্যাপে পরিচয়, অতঃপর কথা বলা, দেখা করা। মনের সঙ্গে মন মিললেই মন দেওয়া-নেওয়া, এ সমীকরণকেই আরও এক ধাপ ওপরে নিয়ে গেছে হাইব্রিড ডেটিং। প্রেম করা মানেই নিয়মিত দেখা করা, একই সঙ্গে সময় কাটানো, এ রকম ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসছে এই প্রজন্ম; বরং তারা প্রেম করার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছে হাইব্রিড ধারণা। যেখানে কালেভদ্রে হয়তো দেখা হবে, কিন্তু প্রেমের বড় একটা অংশই থাকবে স্ক্রিনবন্দী। তাদের ডেটগুলোও হবে ভিডিও কনফারেন্সে। তবে এটাকে ভিডিও কলে শুধু কথা বলা ভেবে থাকলে ভুল হবে। হাইব্রিড ডেটিংয়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া, নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করা, পছন্দের মানুষের জন্য সারপ্রাইজসহ অনেক কিছু থাকে। পার্থক্য শুধু একটাই; সামনাসামনি দেখা হওয়ার বদলে ডেটিং হয় ভিডিও স্ক্রিনে।
এ ধরনের সম্পর্কে ভুল মানুষের প্রেমে পড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। একটা মানুষের কাছে বসা, হাত ধরা বা তাঁর শরীরী ভাষা বোঝার কোনো উপায় অনলাইনে থাকে না। করোনার সময় সবাই যখন গৃহবন্দী, বাইরে বেরোনোই যখন ভয়ের, তখন যুগলেরা বেছে নিয়েছিলেন এই হাইব্রিড ডেটিং। কথা বলা, দেখা করার সবটাই যখন স্ক্রিনের ভেতর থেকে হচ্ছে, তাহলে রোমান্টিক ডেটই বা বাদ পড়বে কেন? ফোনের স্ক্রিনের সামনে কিছুটা সময় একে অপরের সঙ্গে কাটানোর পাশাপাশি সবই হচ্ছে সেখানে।
বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া মানেই একগাদা টাকা খরচ, বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রাফিক ঠেলে গন্তব্যে পৌঁছানো। আবার সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রেম শেষে সময়মতো বাড়িতে ফেরা—ব্যস্ত দিনে এতটা কষ্ট করতে অনেকেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। তাঁদের জন্যই যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে হাইব্রিড ডেটিং। বিশেষ করে ‘লং ডিসট্যান্স’ সম্পর্কে থাকা ব্যক্তিদের জন্য ‘হাইব্রিড ডেটিং’ আশীর্বাদ।