আইসিডিডিআরবির গবেষক ইমা আক্তার
আইসিডিডিআরবির গবেষক ইমা আক্তার

স্নাতকোত্তরে ৪-এ ৪ পাওয়া ইমা যেভাবে পরিসংখ্যানবিদ থেকে গবেষক হলেন

প্রতি বাংলা নববর্ষের মতো ১৪৩২ সনেও দেশের ক্রীড়া, অভিনয়, গবেষণা, স্থাপত্যসহ নানা ক্ষেত্রের তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে হাজির হয়েছে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। একঝাঁক উজ্জ্বল তরুণকে নিয়ে দুই পাতার আয়োজন থেকে পড়ুন গবেষক ইমা আক্তারের গল্প।

ভোলার দৌলতখানের প্রত্যন্ত দ্বীপগ্রামটিতে স্থল আর জল যেন একাকার হয়ে মিশে আছে। সেখানে যোগাযোগের সুযোগ সীমিত, শিক্ষার সুযোগ আরও সীমিত। সেই গ্রামেরই ইমা আক্তার। শৈশব থেকেই গণিতের প্রতি তাঁর দারুণ আগ্রহ। সমস্যা বিশ্লেষণ যুক্তি দিয়ে সমাধান খুঁজে বের করাটা তাঁর পছন্দের কাজ। পড়াশোনায় ভীষণ মনোযোগী। এই মনোযোগের ফলও পান। পঞ্চম শ্রেণির পর অষ্টম শ্রেণিতেও ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি। এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে সরকারি বৃত্তি অর্জন করে নিজের মেধার প্রমাণ দেন ইমা।

এরপরই আসে প্রতিবন্ধকতা। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উচ্চশিক্ষা নিতে যে শহরে পড়তে যাবেন, কার বাসায় উঠবেন? এমন কেউ তো তাঁর নেই। খরচের বিষয়ও আছে। সেই বাধাও কাটান ইমা। নিজের চেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরও তাঁর পথচলা মসৃণ ছিল না। টাইফয়েডের কারণে দুবার মরতে মরতে ফিরে আসেন। মূল্যবান সময়ও হারান। শামসুন্নাহার হলের ছোট রুমে অসুস্থ শরীর নিয়ে বই আঁকড়ে পড়াশোনা করাটাই ছিল তাঁর লড়াইয়ের হাতিয়ার। ফলস্বরূপ স্নাতকে সিজিপিএ–৪-এ ৩.৯৪ পেয়ে ডিনস অ্যাওয়ার্ড পান। আর স্নাতকোত্তরে একেবারে ৪-এ ৪। কৃতিত্বপূর্ণ এই ফলের জন্য কাজী মোতাহার হোসেন পুরস্কারে ভূষিত হন ইমা।

বছর ছয়েক আগে স্নাতকোত্তর শেষ করেই আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) আমার টিমে যোগ দিয়েছিলেন ইমা। শুরুর দিকে তাঁর ছিল পুরোদস্তুর পরিসংখ্যানবিদের কাজ। আমাদের দলের বিভিন্ন অ্যানালাইসিসে সহায়তা করা। ধীরে ধীরে তাঁকে আমরা গবেষণার অন্যান্য কাজেও যুক্ত করতে শুরু করি। নিজে নিজে পেপার লেখা, ছোটখাটো প্রকল্পে নেতৃত্ব দেওয়া চলতে থাকে। মাস কয়েক পর দেখা গেল, সারা জীবন অঙ্ক বোঝা মেয়েটা পলিসি বুঝতে শুরু করছে, নতুন আইডিয়াও হাজির করছে, পেপারও তৈরি করছে।

আমাদের এখানে কোনো চিকিৎসকও যখন যোগ দেন, তাঁর প্রথম কাজ হয় চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট। পরে তাঁদেরও কনটেন্ট বুঝতে হয়, অ্যানালাইসিস বুঝতে হয়, পলিসি বুঝতে হয়। এভাবেই তাঁরা হয়ে ওঠেন গবেষক। ইমাও এভাবে এক-দুই বছরের মধ্যে গবেষক হয়ে উঠলেন।

গবেষণার প্রতি তাঁর আগ্রহ ক্রমে গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করতে দেশের প্রত্যন্ত সব অঞ্চলে গেছেন। প্রতিকূলতার মুখোমুখি হলে সহকর্মীদের সহযোগিতায় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে শিখেছেন। কঠিন মুহূর্তগুলো তাঁকে আরও দক্ষ ও পেশাদার করে তুলেছে।

ইমা আক্তার

ভোলায় বেড়ে ওঠার সময় ইমা কাছ থেকে দেখেছেন, সচেতনতার অভাব ও স্বাস্থ্যসেবায় সীমাবদ্ধতা কীভাবে মানুষের জীবনমানকে প্রভাবিত করে। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে নারীর স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ কীভাবে সীমিত হয়ে পড়ে। এসব অভিজ্ঞতা ইমার গবেষণাকে প্রাণ দিয়েছে। তাঁর গবেষণাপত্র গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে নারীশিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেছে, যা আর্কাইভস অব পাবলিক হেলথ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। শিশু টিকাদান, গর্ভকালীন সেবা ও মাতৃমৃত্যু কমানোর বিষয়ে গবেষণাপত্রসহ ২৫টির বেশি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন ইমা। এর অনেকগুলোর নেতৃত্বেও ছিলেন তিনি।

এ বছরই পিএইচডি করতে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন ইমা। দেশটির টুলেন ইউনিভার্সিটি থেকে পূর্ণ স্কলারশিপ ও রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ পেয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে পরিসংখ্যানের উন্নত বিশ্লেষণ প্রয়োগ করতে চান।

আশা করি, এই ডিগ্রি ইমাকে পরিপূর্ণ গবেষকে পরিণত করবে। উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে জনমানুষের কথা চিন্তা করে তাদের জন্য কাজ করবেন। প্রান্তিক মানুষের জন্য গবেষণা করা ইমার মধ্যে দেশের প্রতি সেই মমত্ববোধ ও দায়বদ্ধতা আমি আঁচ করতে পারি।

ড. আহমদ এহসানূর রহমান: জনস্বাস্থ্য–গবেষক