
জীবনে নানা ঘাত–প্রতিঘাতে মানসিকভাবে মুষড়ে পড়েছেন বারবার। অনেক সময় হাতটা ধরার জন্য পাশে ছিল না কেউ, ছিল না ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি। তখন চিকিৎসক আর থেরাপিস্টের সহযোগিতায় ফিরেছেন স্বাভাবিক জীবনে। নিজেই ঘুরে দাঁড়ানোর সেই সব গল্প শোনালেন আজমেরী হক বাঁধন
আমার বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার আছে। আমি যখন ইতিবাচক থাকি, মনে হয় যে আমি একাই বিশ্বটা ঠিক করে ফেলতে পারব। আবার কিছুক্ষণ পরেই মনে হয়, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। ডুবে যাচ্ছি, সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। সমস্যা হলো, ৯ মাস ধরে আমি এই অবস্থার ভেতর দিয়েই যাচ্ছি। জুলাই আন্দোলনে আমি ঘরে, বাইরে, রাস্তায় সবখান থেকে ছাত্রদের সমর্থন করেছি। ছাত্র-জনতার সঙ্গেই ছিলাম। দেশটাকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে স্বপ্ন ভঙ্গ হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অস্থিরতা কাজ করে। ঘর থেকে বের হই না। কারও সঙ্গে কথা বলি না। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা হয়। সবকিছু নিয়ে অনিশ্চয়তা কাজ করে। হাত-পা কাঁপে, রাতে ঘুম হয় না। ইটিং ডিজঅর্ডারে গত ৯ মাসে আমার ১৭ কেজি ওজন বেড়েছে।
তবে একটু একটু করে আমি সেরেও উঠছি, ফিরছি। এই যাত্রায় আমার হাত ধরে রেখেছে আমার মেয়ে। এ ছাড়া এক দশক ধরে আমার বাসায় কাজের সাহায্যকারী হালিমা বেগম, বিভিন্ন বয়সের কিছু কাছের বন্ধু আর আমার থেরাপিস্ট ডা. রেহানূর ইসলামও এই যাত্রায় আমার সঙ্গে আছেন। দিনে তিনটা করে অবসাদ–নিরাময়ী (অ্যান্টি-ডিপ্রেসান্ট) ওষুধ খাচ্ছি। জিমে যাচ্ছি। আমাকে ওজন ঝরাতে সাহায্য করছেন ডায়েটিশিয়ান ডা. তামান্না। এসবের অনুপ্রেরণা হিসেবে রয়েছে একটা কাজ। অনেক আগে একজন পরিচালকের সঙ্গে কাজটার ব্যাপারে আলাপ হয়েছিল। তারপর বছর কেটে গেছে। কয়েক দিন আগে ফোন করে আমাকে তৈরি হতে বললেন। আমি আবার নতুন করে নিজের সেরাটা দিয়ে ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছি। সব মিলিয়ে আমি হয়তো আবার বেঁচে উঠব।
প্রথম যেবার পেশাদার সাহায্য নিই, তখন আমার বয়স ১৯ বছর। তখন আমি মেডিকেলে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।
খুবই জঘন্য, বিষাক্ত, অ্যাবিউসিভ বিবাহিত সম্পর্কে ছিলাম। এই বীভৎস বাস্তবতা থেকে পালাতে ঠিক করলাম মরে যাব। সেটাই তখন আমার কাছে সবচেয়ে সহজ আর একমাত্র রাস্তা। এককথায় বেঁচে থেকে আমি প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছিলাম, তাই বাঁচার একমাত্র রাস্তা ছিল মরে যাওয়া। তখন নিয়মিত মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরার মতো পড়ে থাকতাম। রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন বলত, ‘ওকে পাগলা গারদে ফেলে আসো।’ সেই সময় আমার ছোট ভাই রাজীব আমাকে প্রত্যয় মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যায়। আমার অবস্থা এত সিরিয়াস ছিল যে ডা. মোহিত কামাল আমাকে দেখেই আগে ভর্তি করে নেন। আর ভাইকে আমার মা–বাবাকে খবর দিতে বলেন।
বেশ কয়েক দিন ভর্তি ছিলাম। থেরাপি আর মেডিসিন দুটোই চলেছে সমানতালে। হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে বাসায় আসি। আরও দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে আবার প্রত্যয়ে ভর্তি হই। এত উচ্চ মাত্রার ওষুধ চলেছে যে সব সময় আমার হাত-পা কাঁপত। আমি দন্তচিকিৎসা নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম। আমার কাজই হাত দিয়ে। সেই হাতই যদি সব সময় কাঁপে, আমার ক্যারিয়ার তো শেষ! আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল। তবে চিকিৎসা চলছিল। সেই সময় একজন ভারতীয় মনোবিজ্ঞানী আমার চিকিৎসা শুরু করেন। এখন পর্যন্ত পরামর্শ দিয়ে তিনি আমার সঙ্গে আছেন।
সেই সময় হঠাৎ একটা বিজ্ঞাপনে চোখ পড়ে। দারুচিনি দ্বীপ নামে একটা সিনেমা বানাবেন হুমায়ূন আহমেদ। নায়িকা খোঁজা হচ্ছে। কিছু না ভেবেই লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় নাম দিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল এর মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ পর্যন্ত পৌঁছাব। স্যারকে আমার জীবনের গল্পটা বলব। তারপর আবার মরে যাব।
‘গালা’তে আমি সেকেন্ড রানারআপ হই। ওই দিন থেকে বেঁচে থাকার আত্মবিশ্বাস আর উদ্দেশ্য পাই। ওই রাত থেকে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিই। ওই রাতে আব্বুকে ফোন করে খুব কেঁদেছিলাম। আর কেবল একটা কথাই বলেছিলাম, ‘আমি বাঁচতে চাই। যেকোনো মূল্যে আমি কেবল বেঁচে থাকতে চাই।’
অন্যরা আব্বুকে বলেছিল, ‘ও যেটা করে শান্তি পায়, করুক।’
মিডিয়াতে কাজ শুরু করি। অনেকটা স্টেবল হই। আর ডেন্টাল সার্জারি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করি।
আবারও বিয়ে করি। আবারও আরেকটা ভুল মানুষকে। অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ি। প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে পড়ে যাই। একটা মেয়ে হয়। মেয়েকে নিজের কাছে রেখে দেয় তার বাবা। আবারও পাগলপ্রায় আর সুইসাইডাল হয়ে যাই। আবার থেরাপি নিতে শুরু করি। মেয়ের অভিভাবকত্বের জন্য মামলা করি। ঐতিহাসিক রায়ে মেয়েকে ফিরে পাই। মেয়ে চোখের সামনে বড় হতে থাকে। কাজে মন দিই। ধীরে ধীরে আবার সব ঠিক হতে থাকে।
এরপর আমার জীবনে আসে ‘রেহানা’। আমার জীবনের যত ক্ষত, সেগুলোকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে পর্দায় আমার রেহানা হয়ে ওঠা। শুটিং শেষ। ডাবিং শেষ। এডিটিং শেষ। অনেক দিন আর কোনো খোঁজখবর নেই। মহামারিকালের বিষণ্ন, স্থবির দিনগুলোর মধ্যে একদিন (রেহানা মরিয়ম নূর–এর পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ) সাদ আমাকে ফোন করে জানায়, এই সিনেমা কান চলচ্চিত্র উৎসবে নির্বাচিত হয়েছে।
এটা হওয়ার কথা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির মুহূর্ত, খুশির দিন। কিন্তু এত বড় একটা সুখবর আমি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলাম না, কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলাম। আসলে আমার জীবনে যদি এত ট্রমা না ঘটত, তাহলে আমি রেহানার ট্রমার সঙ্গে কখনোই ‘কানেক্টেড’ ফিল করতে পারতাম না। নিজের ট্রমা ভাঙিয়ে রেহানার চরিত্রে অভিনয় করা। বড় পর্দায় রেহানা চরিত্রে যেভাবে আমাকে দেখা যায়, সেটা আসলে আমার অভিনয় নয়, একান্তই আমার ট্রমা রেসপন্স। রেহানা কান উৎসবে যাওয়ার কথা শুনে আমি থেকে থেকে চিৎকার করে কাঁদতাম। ঘরের জিনিসপত্র এলোমেলো করে রেখে দিতাম। যেমন আলমারি থেকে সব জামাকাপড় বের করে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রাখতাম। বিষয়টাকে উদ্যাপন করার মতো পরিস্থিতিতে যেতে আমার সময় লেগেছিল। থেরাপিস্টের সাহায্য লেগেছিল। সাইকো থেরাপিস্ট ডা. সেলিনা বহু বছর ধরে আমাকে সাহায্য করছেন।
জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় থেরাপিস্টের তত্ত্বাবধানে আছি। তাঁরা আমার কাছে অভিভাবক বা জীবনসঙ্গীর মতোই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনে ও পর্দায় যা কিছু হয়ে উঠতে পেরেছি, যা কিছু অর্জন করেছি, সবই সম্ভব হয়েছে থেরাপির জন্য। নিজেকে, নিজের অতীত, ট্রমা সবকিছুকে মেনে নিয়েছি। এখন যদি পেছনে ফিরে তাকাই, না, আমি কিচ্ছু বদলাতে চাই না। এটাই আমার জীবন। এক জীবনে থেরাপি বারবার নতুন জীবন দিয়েছে। এককথায়, থেরাপি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
অনুলিখন: জিনাত শারমিন