আপনি কি ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ ওয়েব সিরিজটা দেখেছেন? যদি দেখে থাকেন, তাহলে এই গল্পের অন্যতম চরিত্র ‘জাদু’কে আপনার চেনা। পর্দায় জাদু চরিত্রটিতে রূপ দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ আল সেন্টু। তাঁর গল্পটা যেকোনো মোটিভেশনাল স্পিকারের বায়োপিককে টেক্কা দেওয়ার মতো।

কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর থানার পূর্ব লালপুর গ্রামে সেন্টুর যখন জন্ম হয়, তখন গ্রামটি ছিল যাকে বলে অজপাড়াগাঁ। জন্মের পরপরই কাজের সুবাদে সেন্টুর মা–বাবা তাঁকে নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। কিছুদিন পরই অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবা। টিবিতে আক্রান্ত হয়ে যখন মারা যান, তখন সেন্টুর বয়স সাড়ে তিন; ছোট বোন কোলের শিশু। দুই সন্তানকে নিয়ে অথই সাগরে পড়লেন মা। বুঝলেন, সেন্টুকে গ্রামে রাখলে লেখাপড়া কিছুই হবে না। তাই ২০০৩ সালে সাড়ে ছয় বছর বয়সে পাঠিয়ে দিলেন কিশোরগঞ্জ শহরে।
কিশোরগঞ্জে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন ‘সরকারি শিশু পরিবার’ নামের একটি সংস্থার তত্ত্বাবধানে বড় হতে থাকেন সেন্টু। সেন্টুর ভাষায়, ‘ছোটবেলায় যাদের বাবা মারা যায়, তারা ওইখানে থাকে।’
তিনি তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, তখন থেকেই ঘটনার শুরু। সেদিনটি ছিল ১৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, জাতীয় শিশু দিবস। সেই উপলক্ষে স্কুলের অনুষ্ঠানে হঠাৎই ‘রফিক স্যার’ বললেন অভিনয় করে দেখাতে। সেন্টু দেখালেন। সেই অভিনয় দেখে সবাই মুগ্ধ। খুশি হয়ে দুই হাজার টাকা দিলেন স্যার। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত এক অতিথি সেন্টুকে শিশু একাডেমিতে অভিনয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বলেন।
শিশু একাডেমিতে দলগত অভিনয়ের জন্য সেন্টু নিজেই একটি নাটক লিখে ফেললেন। তখন তিনি সবে পঞ্চম শ্রেণির ফাইনাল দিয়েছেন। নিজেই দিলেন নির্দেশনা। গিয়ে দেখেন, প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া সব দলই নিয়মিত অভিনয় শেখে। কেবল তাঁরাই অপেশাদার। তবে সবাইকে অবাক করে ১২ জনের সেই অপেশাদার দলই পেয়ে গেল পুরস্কার। ১ হাজার ২০০ টাকা। সেই টাকা স্কুলের মোতালেব স্যার সবাইকে ভাগ করে দিলেন। ভাগের ১০০ টাকা নিয়ে হলো ভূরিভোজ।
এরপর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলেন সেন্টু। হাতে এল চন্দ্রাবতী থিয়েটারে ভর্তির আবেদনপত্র। অডিশন দিলেন। ‘সকালে অডিশন, বিকেলে রেজাল্ট। ১৫২ জন অডিশন দিয়েছিলেন। ২০ জনকে নেওয়া হয়েছিল। আমি ৩ নম্বরে দেখলাম নিজের নাম। কী যে খুশি হলাম বলে বোঝানো যাবে না,’ বললেন সেন্টু। থিয়েটারের হয়ে অংশ নিলেন ‘আন্তর্জাতিক শিশু নাট্য উৎসব ২০০৯’-এ। সেখানে ছোট্ট একটা চরিত্রেই বাজিমাত করলেন। মঞ্চে একবারই উপস্থিতি, তিন লাইনের সংলাপ। তাই দেখে প্রধান অতিথি সেন্টুকে ডেকে নিজের খাবার দিয়ে বললেন, ‘একদিন দেখবা তুমি অনেক বড় অভিনেতা হয়ে গেছ।’
এখন সেন্টুর অভিনয় দেখে ভক্তরা বলতেই পারেন, সেদিন হয়তো বেশি দূরে নেই।
২০১৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে সেন্টু চলে এলেন ঢাকায়। বলে রাখা ভালো, সেন্টুদের পরিবারে তিনিই প্রথম উচ্চমাধ্যমিক পাস। ভর্তি হয়ে গেলেন কবি নজরুল সরকারি কলেজে। অভিনয় আর সেশন জটের টানাপোড়েনে এখনো তিনি ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
কলেজে ভর্তি হয়ে শুরু হলো অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার দৌড়। কিশোরগঞ্জের এক থিয়েটারকর্মী পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মেকআপ আর্টিস্ট রতন সরকারের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন ‘সাদা কাগজে সাজানো অনুভূতি’ নাটকের সেটে। সেদিন আফরান নিশোকে দেখে প্রথমে ভেবেছিলেন অপূর্ব! সে যা-ই হোক, রতন সরকার সেন্টুকে যথাসম্ভব সাহায্য করেছিলেন। সেদিন বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য হাতে গুজে দিয়েছিলেন ২০০ টাকা।
প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন দেখে ভর্তি হন আরণ্যকের ওয়ার্কশপে। সেন্টু তখন শিল্পকলা একাডেমি কোথায়, সেটাও চিনতেন না। ওয়ার্কশপের মধ্যেই চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলেন। তবু একটা দিন এক সেকেন্ডও দেরি করেননি, ক্লাস মিস করেননি। এরপর সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় কাজ করলেন ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র ব্যাকস্টেজে। কারণটা জানিয়ে বললেন, ‘আমি শিল্পের যে শাখায় কাজ করতে চাই, সেটা তো সবকিছু নিয়ে। তাই আমাকে তো সবকিছুই করতে হবে। থিয়েটারে আমি যে কাজ পেয়েছি, করেছি। আমি কেবল শিখতে চেয়েছি। নিজেকে তৈরি করতে চেয়েছি।’
এরপর একে একে মাসুদ আহমেদের একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা (সেটি আর মুক্তি পায়নি), শামসুদ্দীন আহমেদের সিনেমা ‘বিয়ন্ড ইকুয়েশন’, খন্দকার সুমনের গণ–অর্থায়নের ছবি ‘সাঁতাও’, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সৈয়দ আহমেদ শাওকীর প্রামাণ্যচিত্র ‘তারুণ্যের আলোকশিখা’য় অভিনয় করেন।
‘সাঁতাও’-এর অডিশন দিয়ে ভুলেও গিয়েছিলেন সেন্টু। একদিন ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে দেখেন ‘সাঁতাও’-এ অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। এরপর শুরু হলো মহামারিকাল। সব ফেলে গ্রামে চলে গেলেন সেন্টু।
দেড় বছর পর কাজের খোঁজে আবার ঢাকায় ফেরা। অভিনয় করলেন শঙ্খ দাশগুপ্তের ‘বলি’ ওয়েব সিরিজে। তারপর কাজ পাচ্ছিলেন না। শুরু করলেন ডেলিভারি বয়ের চাকরি। সেই সময় হঠাৎ একদিন সুকর্ণ শাহেদ ধীমান শোনালেন ‘বাঙ্কার বয়’-এর গল্প। শুনতে শুনতেই সেন্টু যেন আকবর চরিত্রটাকে চোখের সামনে দেখতে পেলেন। চাকরি ছেড়ে ধীমান আর সেন্টু দিন নেই, রাত নেই, ঢাকা শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ান, নিজেদের জীবনের গল্প বলেন আর কুকুরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন। দুই মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়ে পর্দায় আকবর হয়ে উঠেছিলেন সেন্টু। সেই প্রথম মুখ্য চরিত্রে অভিনয়। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে সেন্টুর জীবনে ঘটে গেল ‘শুক্লপক্ষ’, ‘পুনর্জন্ম থ্রি’, ‘কারাগার’ আর সর্বশেষ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’-এর মতো কাজ। মাঝে আবার দুটি সিনেমাও করেছেন। দেশের বাইরে একাধিক প্রজেক্ট নিয়েও চলছে আলোচনা।
‘শুক্লপক্ষ’তে অভিনয়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পেয়েছিলেন মাত্র এক দিন। সেই রাতে উত্তেজনায় ঘুমই আসে না। অনেক দেরি করে ঘুমালেন। হুট করেই ঘুম ভেঙে গেল। মাথার ভেতর ক্রমিক খুনির চরিত্রটাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে উঠে থাই গ্লাসে নিজেকে দেখে সেন্টু ওই হাসিটা ‘অনুশীলন’ করলেন, যে হাসি দেখলে দর্শকের ভেতরটা অজানা অঘটনের আশঙ্কায় মোচড় দিয়ে ওঠে, শীতল ভয়ে শূন্য শূন্য লাগে।
‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’-এ জাদু একটা দৃশ্যে গ্রামে বাবার কবর খুঁড়ছিল। পরদিন যখন সেন্টু ওই গ্রামে গেলেন, তখন গ্রামের সব ‘ইয়াং পোলাপাইন’ ‘জাদু জাদু’ বলে মিছিল করছিল। এ ঘটনার অনেক আগে একদিন অভিনেতা হতে চান বলে সেন্টুর আশপাশের মানুষেরা ‘কালো, বেঁটে, বিচ্ছিরি চেহারা নিয়ে কীভাবে অভিনয় করবে’ বলে হাসাহাসি করেছিলেন। সেদিনকার সেই তাচ্ছিল্যের হাসি যেন এই হাসির মুখোমুখি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
আপনি কি ছোটবেলা থেকে অভিনয়ই করতে চেয়েছেন? প্রশ্নটা যেন কমন পড়ল। বললেন, ‘অবশ্যই। আমার বাবা নাকি যাত্রাপালায় অভিনয় করত। আমার দাদি গ্রামের মাজারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাওয়ালি-মারফতি গান গাইত। সাড়ে তিন থেকে সাড়ে ছয়—এই তিন বছর আমিও দাদির সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় গান গাইতে যাইতাম। অভিনয় যে আমি করব, এটা বোধ হয় কেউ একজন বহু আগে ঠিক করে রেখেছিলেন।’
সে কারণেই হয়তো গ্রামের লোকজন যখন সেন্টুর মাকে ‘নায়কের মা, নায়কের মা’ বলে ডাকেন, তখন আনন্দাশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আসে তাঁর দৃষ্টি।