ঈদের ছুটিতে চলুন উত্তরবঙ্গে
পবিত্র ঈদুল আজহার দীর্ঘ ছুটিতে কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন সবাই নিজের মতো করে। বিদেশে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁরা তো পরিকল্পনা করেই ফেলেছেন। কিন্তু যাঁরা দেশে থাকছেন বা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরতে আগ্রহী, তাঁদের জন্য আমাদের এই আয়োজন। আজকে থাকছে দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু নান্দনিক জায়গায় ভ্রমণের প্রাথমিক তথ্য। পরিবার-পরিজন নিয়ে এসব জায়গা থেকে অল্প সময়ে ঘুরে আসতে পারেন যেকোনো সময়।
চলনবিল
উত্তরবঙ্গে প্রবেশের শুরুতেই দেখা হয়ে যায় চলনবিলের সঙ্গে। নাটোর রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ এবং পাবনা জেলাজুড়ে বিস্তৃত এই বিলের সঙ্গে যুক্ত আছে ১৪টি নদী। খাল বা নদী ছাড়াও এই বিলের বুকে জেগে রয়েছে কয়েক শ গ্রাম। এখানে শুকনো মৌসুমেও নৌকায় ভেসে বেড়ানোর মতো পানি থাকে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে। আর এই ভরা বর্ষায় তো কথাই নেই। এই বর্ষায় পুরো চলনবিল যেন একটা সমুদ্র! উন্মুক্ত বিলের মাতাল হাওয়ায় বিশাল বিশাল ঢেউয়ের দোলায় নৌকায় করে বিলে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ উপভোগ করার চমৎকার একটা মৌসুম চলছে এখন। আর চলনবিলে একটা বিকেল ঘুরে বেড়িয়ে বাড়ি ফেরার পথে কিনে নিতে পারেন একদম তরতাজা মাছ, নিজের পছন্দমতো। যে তাজা মাছের স্বাদ এই ইট–পাথরের শহরে পাওয়া সম্ভব নয় কিছুতেই।
চলনবিলে রয়েছে বাংলাদেশের বড় গ্রামগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘কলম’ নামের গ্রামটি। প্রবাদ আছে ‘বিল দেখতে চলন/ আর গ্রাম দেখতে কলম’। এই কলম গ্রাম নাটোরের সিংড়া উপজেলার ৪ নম্বর কলম ইউনিয়নে পড়েছে। মূলত কলম গ্রামের নাম থেকেই ইউনিয়নের নামকরণ করা হয়েছে।
নাটোর রাজবাড়ি
ক্রিকেটের জন্য বাঙালি দুজন মানুষের কাছে চিরকাল ঋণী থাকবে। একজন সারদারঞ্জন রায়। অন্যজন অবিভক্ত বাংলার প্রথম বাঙালি ক্রিকেট সংগঠক জগদিন্দ্র নাথ রায়। এই জগদিন্দ্র নাথ রায় ছিলেন নাটোর রাজবাড়ির মানুষ। রানি ভবানীর বংশধর এই ক্রিকেটপাগল মানুষটি সারদারঞ্জন রায়কে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন নিজে ক্রিকেট স্টেডিয়াম বানিয়ে, ‘নাটোর ইলেভেন’ নামে একটি পেশাদার ক্রিকেট টিম তৈরি করে। নাটোর রাজবাড়ি গিয়ে মাশরাফি-সাকিবদের পূর্বসূরি এই বাঙালি মানুষটিকে একবার শ্রদ্ধা জানিয়ে আসতেই পারেন আপনি।
নাটোর থেকে চলার পথে রাজশাহীর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হাতের ডান দিকে পড়বে রানি ভবানী এবং জগদিন্দ্র নাথ রায়ের স্মৃতিবিজড়িত এই রাজবাড়িটি। ‘নাটোর রাজবাড়ি’ নামে পরিচিত এই রাজবাড়িটি এখন উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত। অনেকে একে রানি ভবানীর রাজবাড়ি নামেও চিনে থাকে। এখনো যে রাজবাড়ি তার ঐতিহ্য আর আভিজাত্য ধরে রেখেছে আগের মতোই। রাজবাড়ির ভেতরে প্রবেশের আগে আপনাকে অনুমতি নিতে হবে। নাটোর গেলে অবশ্যই নাটোরের কাঁচাগোল্লা খাবেন। কারণ, উৎকৃষ্ট কাঁচাগোল্লা নাটোর ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। এখান থেকে চলনবিলের নাটোরের অংশেও যেতে পারেন ঘুরতে।
পুঠিয়া রাজবাড়ি
রাজশাহী শহরের প্রায় ২০ কিলোমিটার আগে পথে পড়বে পুঠিয়া বাজার। এই বাজারে বাস থেকে নেমে রিকশা নিয়ে বাঁ দিকে একটু এগিয়ে গেলেই পাবেন পুঠিয়া রাজবাড়ি। এখানে আপনি পাবেন টেরাকোটার মন্দির। এটিই বাংলাদেশের একমাত্র জায়গা, যেখানে একসঙ্গে অনেকগুলো টেরাকোটার মন্দির দেখতে পাওয়া যায়। পুরো রাজবাড়িটি একটি পরিখা বা ক্যানেল দিয়ে ঘেরা। রাজবাড়িতে প্রবেশের আগে হাতের বাঁ দিকে পাবেন পুঠিয়া শিবমন্দির। এটি বাংলাদেশের পুরোনো এবং বড় শিবমন্দিরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ডান দিকে পাবেন টেরাকোটাশোভিত মন্দির। এখান থেকে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেই বিশাল মাঠ। এই মাঠের প্রান্তে রয়েছে বিশাল রাজবাড়িটি, যেটি পুঠিয়া রাজবাড়ি হিসেবে পরিচিত। যদিও এখন এই রাজবাড়িটি ব্যবহৃত হচ্ছে লস্করপুর ডিগ্রি কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক ভবন হিসেবে। রাজবাড়ির পাশে যে বাজার আছে সেখানে পাওয়া যায় আমিত্তি, খেতে ভুলবেন না কিন্তু।
রাজসিক রাজশাহী
ঢোপকল দেখেছেন কখনো? এই উপমহাদেশের প্রথম দিকের পানীয়জল সাপ্লাইয়ের জন্য বসানো হয়েছিল এই ঢোপকলগুলো। বাংলাদেশের অন্য কোনো শহরে এর চিহ্ন এখন আর পাবেন না। কিন্তু পুরোনো ও রাজসিক শহর রাজশাহীতে এখনো কিছু ঢোপকলের অস্তিত্ব রয়েছে। শুধু ঢোপকলই নয়। এখানে রয়েছে ওলন্দাজ বা ডাচ্দের ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে নির্মাণ করা বড়কুঠি। এটি সতেরো শতকের স্থাপনা বলে ধারণা করা হয়। রয়েছে রেশম উন্নয়ন কেন্দ্র। রয়েছে বাংলাদেশের প্রথম ও পুরো বিশ্বে সুপরিচিত বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আর আছে পদ্মা নদী। যদিও এখন আর সেই ভরা যৌবনা পদ্মা নেই। তবু এই বর্ষাকালে পদ্মা নদী ঠিকই তার পুরোনো রূপে ফিরে আসে।
যেতে পারেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাবুডাইং। এখানে পাবেন বন আর প্রাণীবৈচিত্র্যের অপার জগৎ। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাঝামাঝিতে পাবেন বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচুনিচু লালমাটির বৈচিত্র্যময় ভূমিরূপ। যাওয়া–আসার পথে গাড়ি থেকে নেমে বা গাড়ি থামিয়ে দেখতে পারেন।
রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ গেলে অবশ্যই কালাইয়ের রুটি খেয়ে আসবেন। হাঁসের মাংস বা প্রচুর মরিচ-পেঁয়াজ-সরিষার তেল দিয়ে বানানো চাটনি আর বেগুন ভর্তা দিয়ে খেতে পারেন কালাইর রুটি।
রাজশাহী শহর ছাড়িয়ে গেলে দেখা মিলবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিস্তৃত আমবাগানের। পাশেই নওগাঁ জেলা। প্রাচীন এই জনপদে দেখা মিলবে আলতাদিঘি, কুসুম্বা মসজিদ, দিবর দিঘি, বর্তমানের তালগাছের সারি দিয়ে ঘেরা জনপ্রিয়তম গ্রাম ঘুঘু ডাঙা, রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি পতিসর, ব্রিটিশ আমলের গা শিউরে ওঠা ইতিহাসের রক্তদহর বিল। এ ছাড়া নওগাঁ আর জয়পুরহাটের ঠিক মাঝখানে আছে এক জীবন্ত ইতিহাস-পাহাড়পুর। একসঙ্গে এতগুলো ঐতিহাসিক জায়গা এবং স্থাপত্য দেখতে আপনাকে উত্তরবঙ্গে যেতেই হবে।
রঙিন রংপুর
রাজশাহীকে পাশে রেখে চলে যেতে পারেন রংপুর অঞ্চলে। নতুন রংপুর বিভাগে দেখার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। রংপুর শহরে আছে তাজহাট জমিদারবাড়ি। আছে কারমাইকেল কলেজ, আছে মাইলের পর মাইল সবুজ ধানখেত। রংপুর বিভাগ নতুন হলেও শহরটি অনেক প্রাচীন। এ শহরে গেলেই প্রাচীন একটা স্বাদ পাবেন। রংপুরকে পেছনে রেখে যেতে পারেন দিনাজপুর। এখানে আছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় টেরাকোটাশোভিত কান্তজীউ মন্দির। তার পাশেই পাবেন টেরাকোটাশোভিত নয়াবাদ মসজিদ। সেখান থেকে একটু উত্তরে গেলেই পাবেন সিংড়া ফরেস্ট, এটি উত্তরবঙ্গের একমাত্র বন। এরপরেই আছে বিখ্যাত পঞ্চগড় জেলা। এই জেলায় আছে সমতলের চা–বাগান, মহানন্দা নদীর উত্তাল জলরাশি, দূরে হিমালয়ের মাতাল বাতাস। আকাশে মেঘ না থাকলে পঞ্চগড়ের যেকোনো জায়গা থেকেই দেখতে পারবেন হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা চূড়া।
উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরবেন বগুড়া হয়ে। বগুড়া শহর ঘুরে চলে আসবেন করতোয়া নদীর তীরের প্রাচীন মহাস্থানগড়ে। এখানে আপনি খুঁজে দেখতে পারেন বেহুলাকে। তারপর ফিরতে পারেন আপন নিবাসে। তবে মহাস্থানগড় গেলে বেহুলাকে পান আর না পান কটকটি খেয়ে আসবেন। এটা মহাস্থানগড় এলাকার জনপ্রিয় খাবার।
উত্তরবঙ্গ দেখতে হবে সময় নিয়ে। চলনবিল দিয়ে শুরু করে রাজশাহী-নওগাঁ হয়ে রংপুর- দিনাজপুর-পঞ্চগড় যেতে পারেন বাসে বা ট্রেনে। অথবা রংপুর গিয়ে সেখান থেকে দিনাজপুর- পঞ্চগড় ঘুরে সৈয়দপুর থেকে ট্রেনে যেতে পারেন রাজশাহী। আবার প্লেনে সরাসরি রাজশাহী অথবা সৈয়দপুরও যেতে পারেন। তারপর সেখান থেকে বাসে বা ভাড়া গাড়িতে বিভিন্ন জায়গায়ও যাওয়া যায়। দেশের অন্যান্য এলাকায় ঘুরতে যা খরচ হবে, তার চেয়ে কম খরচ হবে উত্তরবঙ্গ ঘুরতে।