
তুষারকণা জানালায় মৃদু বাড়ি খাচ্ছিল। আমরা গাড়ির ভেতরে বসে ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম। প্রকৃতির কী বিস্ময়। বরফ পড়ছে, সামনের পাহাড় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলাচ্ছে। তার মধ্যেই আমাদের গাড়ি ওপরের দিকে উঠছে তো উঠছেই। দানব সব পাহাড়ের বুক কেটে বানানো রাস্তা। সে রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছি। অত্যন্ত আনন্দ আর ভালো লাগা নিজেই অনুভব করছিলাম।
হুট করেই চালক বললেন, ‘আমরা এখন প্রায় সাড়ে তিন হাজার মিটার ওপরে। আর এই জায়গার নাম জোজিলা পাস।’
গাড়ি থামাতে বললাম। জোজিলা পাসে থামতেই হবে! গাড়ি থেকে নামলাম। তুষারের মধ্যে ভোঁ–দৌড়। বন্ধুরা পেছনে ডাকতে থাকল। নিজেকে তখন মনে হচ্ছিল মুক্ত পাখি! আকাশের দিকে তাকিয়ে দুহাত মেললাম। তারপর চোখ বন্ধ করে পাহাড়ের ঘ্রাণ নিলাম।
সেদিনের সেই মুহূর্তটার জন্য আমার কয়েক বছর অপেক্ষা। বলা যায় আমার ‘ড্রিম ট্রিপ’ এটা। রোড ট্রিপ টু লেহ-লাদাখ! ঈদুল ফিতরের ছুটিতে ঢাকা থেকে ভারতের দিল্লি গিয়েছিলাম। নানা পথ ঘুরে সেদিন অবশ্য যাত্রা করেছিলাম কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে। গন্তব্য লাদাখ। সঙ্গী আরও তিনজন। সবাই বাংলাদেশি।
পথেই রাত হলো। রাতে থামলাম কারগিলে। পাহাড়ের কোলে সুন্দর একটা হোটেল। সেটাই রাতের ঠিকানা। রাতের অন্ধকারে বাইরের আর কিছু দেখার সুযোগ হলো না। তবে ফিরে গেলাম ইতিহাসের পাতায়। ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পড়া কারগিল যুদ্ধের কথা মনে পড়ল। ১৯৯৯ সালে যে যুদ্ধে ভারত ও পাকিস্তানের শত শত সৈনিক প্রাণ দিয়েছিল। কল্পনার রাজ্যে যখন কারগিল যুদ্ধ, তখনই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সূর্য উঠব উঠব করছে, তখনই আমরাও উঠে পড়ি। ভোরের আলোয় পাহাড় ঝলমল করছে। হোটেল থেকে নিচে তাকিয়ে দেখি পাহাড়ি নদী বয়ে চলেছে। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম লেহ শহরের উদ্দেশে। কারগিল যত ছেড়ে যাচ্ছিলাম, পাহাড়কে ততই রুক্ষ আর পাথুরে মনে হচ্ছিল। গাছপালা সেভাবে আর দেখা যাচ্ছিল না। চালক বললেন, এই তো লাদাখের আসল রূপ। মনে মনে বলি, তবু তো সুন্দর।
পাহাড়ি পথ ততক্ষণে আরও ওপরে উঠেছে। নিচের দিকটা দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। সামনে সিন্ধু-জানসকার নদী একসঙ্গে মিলিত হয়েছে। দুটো নদীর পানি দেখেই আলাদা করা যায়। প্রচণ্ড বাতাস বইছিল। ঘাপটি মেরে অনেকটা সময় তীরে বসে থাকলাম।
লেহ শহরে আমরা দুদিন ছিলাম। বলা যায় পাহাড়ি মুগ্ধতায় বুঁদ হয়ে ছিলাম। আমি এক গোলকধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম। কোনটা বেশি উজ্জ্বল, শহরের মৃদু সূর্যরশ্মি নাকি জ্বলজ্বল করে জ্বলা পাহাড়গুলো? সেখানের মানুষেরা কতটা সহজ-সরল, মায়াবী, ঠিক তা কঠিন পাহাড়ের বিপরীত!
দেশ থেকে একটা শাড়ি ব্যাগে নিয়েছিলাম। শাড়ি পরে শহরের এমাথা-ওমাথা ঘুরে বেড়ালাম। আশ্রম, নদী, ঐতিহ্যবাহী স্কুলে সময় কাটল বন্ধুদের সঙ্গে। সেদিন শাড়ি পরে নিজেকে সত্যিকারের মুক্ত পাখি মনে হচ্ছিল।
আমরা গলা ছেড়ে গাইলাম। প্রাণ খুলে দৌড়ালাম, নাচলাম।
লাদাখে যাওয়া-আসার পথকে বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম চমৎকার রাস্তা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার ফুট ওপরে। মোটরযান চলার উপযোগী এমন পথ পৃথিবীর আর কোথায় আছে! সেই রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি।
লাদাখ থেকে আমাদের গন্তব্য ছিল মানালি। লাদাখ থেকে মানালি যাওয়ার পথ আরও সুন্দর। প্রত্যেকে মোড়ে ‘কী সুন্দর’, ‘কী সুন্দর’ বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলাম। এই পথেই পেয়েছিলাম হিমাচল প্রদেশের বারালাচা লা পাস! পুরোটাই বরফ। বরফ কাটা রাস্তার মধ্য দিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়ি। চোখে অনন্তকালের শুধু সাদা বরফ দেখে যাচ্ছিলাম। জীবনে এত শুভ্র তুষার আর কোথায় দেখেছি!
পাহাড়ের জমে থাকা বরফের উচ্চতা আমার থেকে দ্বিগুণ উঁচু। কিছু বরফ হাতে নিয়ে ধরলাম। কিছু ছুড়ে মারলাম বন্ধুদের গায়ে, কিছু ছুড়ে মারলাম আকাশে। গায়ের শুভ্র ওড়না আকাশে মেলে ধরলাম, পাহাড়ি হাওয়া এসে আমার চুল, ওড়না, আমার মনকে এলোমেলো করে দিচ্ছিল। যেতে যেতে মনে হচ্ছিল, সুন্দর সময়গুলো চোখের পলকে চলে যায় কেন?