মোহিনী তিন্দু
মোহিনী তিন্দু

তিন্দুর মেঘ আর বড়পাথরের র‌্যাফটিং

সাংগুর অদ্ভুত অদ্ভুত সব রোমাঞ্চ শেষ করে, যখন তিন্দুর দেখা পাওয়া গেল তখন বৃষ্টি কিছুটা কমলেও গুঁড়ি গুঁড়ি করে ঝরছিল। দুই পাশে বিশাল বিশাল সবুজ পাহাড়ের ঠিক মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে সাংগুর জলধারা। তিন্দুতে বলতে গেলে চারদিকেই পাহাড় ঘেরা, আসলে পুরোপুরি পাহাড় ঘেরা এই গ্রাম বা পাড়া। পাহাড়, নদী, কুমারী নামে এক ঝরনা, চারদিকে সবুজ দিয়ে ঘেরা অপূর্ব গ্রাম তিন্দু। তবে আমার কাছে এসবের চেয়েও বেশি ভালো লেগেছে, তিন্দুতে বেড়াতে আসা সাময়িক এক অতিথিকে। হ্যাঁ, তাকে আমার তিন্দুর অতিথি বলেই মনে হয়েছে।

উত্তাল ঢেউয়ের পারে অপরূপ তিন্দু

যাওয়া আর ফিরে আসা মিলে দুবার বেশ কিছুটা সময় তিন্দুতে ছিলাম। পাহাড়ের ঢাল আর নদীর তীর—এই দুয়ের সম্মিলনে তিন্দুতে ঠিক সমতল নয়, কিছুটা ঢেউ খেলানো ভূমিতে আছে বিজিবির ক্যাম্প। সেখানে যাওয়া বা আসা—দুই সময়ই নামতে হয় বা বোট থামিয়ে কথা বলে যাওয়া–আসার ব্যাপারে তথ্য দিতে হয়। কখনো কখনো বিজিবি এখানে ব্যাকপ্যাক চেক করেও থাকে নিরাপত্তার খাতিরে।

এখানে পাহাড়, নদী, অরণ্য, সবুজে ঘেরা চারপাশ—এই সবকিছু একই রকম। সবকিছু একই রকম হলেও তিন্দুর আকাশ সময়ে সময়ে, প্রকৃতি আর ঋতুভেদে রং বদলে ফেলে। কখনো নীল, কখনো ধূসর, কখনো মেঘে ঢাকা, কখনো কালো, বিকেলে হলুদ, সন্ধ্যায় সে সোনালি আর রাতে সে সাধারণত তারার নিয়ন আলোয় রুপালি রং ধারণ করে। এই রং বদলের কালেই আসে তার অতিথি।

তিন্দুর জুমবাড়ি

পাহাড়ে পাহাড়ে, সবুজ অরণ্যে আর কখনো কখনো নদীর মাঝে সে বেড়াতে আসে, ভেসে বেড়ায়, উড়ে উড়ে এখানে–ওখানে ছুটে বেড়ায়, কখনো কখনো চুপ করে ঠায় বসে রয় কোনো পাহাড়ের ভাঁজে। পাহাড় অরণ্যের খাঁজে, কোনো জুম ঘরের বারান্দায়, আবার কখনো সে থামকে দাঁড়ায় পাহাড় নদীর বাঁকে। তিন্দুর সে অতিথির নাম মেঘ। সাদা, ধূসর, কালচে, নরম, কোমল আর তুলতুলে, আদরের, আহ্লাদের আর আবেশের! হ্যাঁ, তিন্দুর মেঘ, যে শুধু বৃষ্টি হলে, বৃষ্টি থেমে গেলে তিন্দুতে বেড়াতে আসে, অতিথি হয়ে। কিছুটা অলস অবসর কাটাতে আসে তিন্দুর পাহাড়ে, সবুজ অরণ্যে, বয়ে চলা নদীতে।

যতক্ষণ তিন্দুতে ছিলাম, শুধু তাকিয়ে ছিলাম, অবাক আনন্দে অদ্ভুত এক সুখ সুখ অনুভূতিতে আচ্ছন্ন ছিলাম, বেড়াতে আসা তিন্দুর মেঘ দেখে, তাদের আলতো পরশ পেয়ে কোমল স্পর্শে শিহরিত হয়েছিলাম। আদুরে, তুলতুলে মেঘ দেখে একটু আগের ভয়াবহ আর রোমাঞ্চকর সাংগুর কথা বেমালুম ভুলে অপলক চোখে মেঘেদের দেখেছিলাম। পাহাড়, নদী, ঝরনা, অরণ্য যদি হয় অপরূপ তিন্দুর সৌন্দর্যের আধার, তবে মেঘ হলো তিন্দুর অলংকার! এই অলংকার সব সময় তিন্দুর অঙ্গে থাকে না, বিশেষ বিশেষ সময় আর উপলক্ষে সে তিন্দুর রূপ বাড়িয়ে দিতে বেড়াতে আসে, অলংকার হয়ে তাকে অপরূপা করে তোলে! বিশেষ করে বৃষ্টির পরে বা খুব সকালে। আমি তাকে দেখেছিলাম এক বিকেলের বৃষ্টি শেষে।

তিন্দু, যেখানে বেড়াতে আসে মেঘ

বৃষ্টি শেষের বেড়াতে আসা মেঘ, তিন্দুকে অপরূপা করে তোলা অবাক অলংকার! যে তিন্দুতে থাকে না, যে মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে আসে আর ঘুরে যায়, আবার নিজের ইচ্ছে হলেই হারিয়ে যায়। তিন্দুকে দিয়ে যায় অপরূপা হয়ে ওঠা অনুষঙ্গ, হয়ে যায় তিন্দুর অহংকার, তিন্দুর অলংকার, যেদিকে তাকিয়ে থেকে থেকে, নৌকায় ভেসে যেতে যেতে মনে হয়, নৌকায় নয়, বুঝি ভেসে চলেছি তিন্দুর অতিথি হয়ে আসা অবাক মেঘেদের সঙ্গে, পাহাড়ে, অরণ্যে, জুম ঘরের বাঁশের বারান্দায়। আর মাঝে মাঝে থমকে যাই কোনো এক সবুজ পাহাড় চূড়ায়!

তিন্দু থেকে অল্প বিরতি দিয়ে, বিজিবির সঙ্গে সাক্ষাৎ সেরে আমরা রেমাক্রির দিকে বোট চালাতে শুরু করলাম। তিন্দু থেকে যখন এগিয়ে যেতে শুরু করেছি, তখন এদিকে সাংগু কিছুটা চওড়া বলে অন্যান্য জায়গার মতো খুব বেশি স্রোত ছিল না। তাই ভেবেছিলাম, সামনের পথটুকু খুব সহজেই হেলেদুলে পাহাড় আর অরণ্য দেখতে দেখতে ভেসে চলে যেতে পারব। তখন বৃষ্টিও প্রায় কমে গেছে। তিন্দু থেকে রেমাক্রি প্রায় আধা ঘণ্টার পথ। নদীর স্রোত, বাতাস আর বৃষ্টির ওপর নির্ভর করবে কতটা কম সময়ে মূল গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যাবে। যেহেতু বৃষ্টি নেই, নদী শান্ত, তাই গায়ের পলিথিন খুলে রেখে বেশ আয়েশ করেই বসেছিলাম হাত পা ছড়িয়ে। কিন্তু খুব বেশি নয়, মাত্র ১০ মিনিট পরেই পেছনে ফেলে আসা স্রোত, নদীর গতি, পাহাড়ি বাঁক, উত্তাল ঢেউ, আর উঁচু–নিচু নদীপথের চেয়েও যে অদ্ভুত রোমাঞ্চকর কিছু সামনে এসে যাবে, সেটা একদমই ভাবতে পারিনি। শুধু নদী, স্রোত বা ঢেউ এর সঙ্গে কিছুটা তাল মেলাতে পারলেও এমন কিছুর সঙ্গে কোনো রকম তাল মেলানো মুশকিল।

পাথরের ঘরবাড়ি, তিন্দু

বেশ দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল নদীর মাঝে, আশপাশে, নদীর তীরে নানা আকারের পাথর পড়ে আছে। এই জায়গার নাম আগে শুনেছি, ছবি দেখেছি। আমাদের গাইড কাম মাঝি আবার আমাদের মনে করিয়ে দিল, এটা বড়পাথর এলাকা। নাম শুনে আগে দেখা ছবিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল। কিন্তু আমাদের বোট যত এগিয়ে যেতে থাকল, তত অবাক হওয়া বাড়তে লাগল। এত বিশাল বিশাল পাথর, তা–ও এমন নদীর মধ্যে আগে কোথাও কোনো দিন দেখিনি। এতই বিশাল একেকটা পাথর যে অনায়াসে সেসব পাথরে তাবু খাটিয়ে ক্যাম্পিং করা যাবে! কোনো কোনোটায় রান্নার আয়োজন করে, একেকটা পাথরে তাঁবু খাটিয়ে নদী বুকের ওপরেই দিব্যি একটা নতুন অ্যাডভেঞ্চার স্পট গড়ে তোলা যাবে।

একেকটা ঘর বাড়ির সমান প্রকাণ্ড পাথরকে বেশ সতর্কতার সঙ্গে আমাদের বোট এড়িয়ে যায়, তো আর একটা তার চেয়েও প্রকাণ্ড পাথর বোটের সামনে এসে পড়ে! যেখানে ধাক্কা লাগলে যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সেই সঙ্গে সাংগুর ভয়াবহ ঢেউ আর উত্তাল স্রোত তো আছেই। সব মিলিয়ে এক অবাক আর অদ্ভুত রোমাঞ্চকর সেই এগিয়ে চলা। এত বড় বড় পাথর কোথা থেকে এল, ভাবতে ভাবতে পাহাড় ছাড়িয়ে ওপরের আকাশের দিকে তাকাতেই মনে হলো, এমন একটা পাথর যদি ওপরে রাক্ষসের মতো হাঁ করে থাকা পাহাড় থেকে গড়িয়ে বা উড়ে আসে, তো কী অবস্থা হবে!

পাথর বাঁচিয়ে চলা

এসব ভীতিকর ভাবনা যখন মন আর মাথায় খেলা করছে, তখনই শুনি আমাদের বোটচালক নির্দেশ দিলেন, কেউ নড়াচড়া করবেন না, যে যেভাবে আছেন একদম চুপ করে বসে থাকেন! দেখলাম, সামনে এই রকম ঘরবাড়ির সমান কয়েকটা পাথর তাদের সংসার সাজিয়ে নদীর মাঝে বসে আছে যত্রতত্র। আর একই সঙ্গে ভীষণ স্রোত পাথরে বাধা পেয়ে বিশাল আর ভয়ানক ঢেউ তৈরি করেছে। সবাই শক্ত হয়ে বসে থেকেও অনেক সতর্ক থেকেও বোটকে বিশাল পাথরে ঘষা খাওয়ার হাত থেকে বাঁচানো গেল না। পাথরের ধাক্কা, স্রোত আর ঢেউয়ে নৌকা কাত হয়ে, দুলে উঠে আমাদের নতুন করে সাংগুর জলে স্নান করিয়ে দিল!

কিছুটা আতঙ্কিত হলেও নিদারুণ উপভোগ্য ছিল উত্তাল উন্মাদ নদীতে বিশাল পাথর, ঢেউ আর স্রোতে একটা প্রাকৃতিক র‍্যাফটিং রোমাঞ্চ উপভোগ করার এই অংশটুকু। উত্তাল উন্মাদ সাংগু নদে, বিস্ময়কর বড় পাথর এলাকা পাড়ি দিতে দিতে আমার হিমাচলের কুলুতে বিয়াসের এবং কালিম্পংয়ের তিস্তায় বহুদিন আগের র‍্যাফটিংয়ের স্মৃতি মনে পড়ে গিয়েছিল।