ভ্যান গঘের আঁকা সেই গির্জা আর তাঁর ছবি
ভ্যান গঘের আঁকা সেই গির্জা আর তাঁর ছবি

ভ্যান গঘের সমাধিতে

মৃত্যুর পর তাঁর সৃষ্টিকর্ম তাঁকে দিয়েছে অমরত্ব। বিশ্বখ্যাত শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৮৯০ সালের এই দিনে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মারা যান চিরদুঃখী এই শিল্পী। প্যারিস থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে 'ওভে সুর ওয়াজ’-এ চিরঘুমে শায়িত আছেন ভিনসেন্ট। পাশেই প্রিয় ভাই থিও'র সমাধি। জীবনের শেষ দিনগুলো এই ছোট্ট উপশহরেই কাটিয়েছেন ভিনসেন্ট। করোনাকালীন নতুন স্বাভাবিকে ফেরা ফ্রান্স ভ্রমণের ফাঁকে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের সেই উপশহর আর সমাধি ঘুরে এসে লিখেছেন পার্থ সনজয়


একে অপরকে জড়িয়ে থাকা গভীর সবুজ পাতার আইভি যেন আজও বলছে দুই ভাইয়ের গভীর ভালোবাসার কথা। পাশাপাশি কবরে ঘুমিয়ে আছেন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ আর থিও ভ্যান গঘ। ভিনসেন্ট মারা যাওয়ার ছয় মাস পর মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে মারা যান ভাই থিও। নেদারল্যান্ডসের ইওট্রেক্টে শায়িত থিওর মরদেহ পরে উভে সুর ওয়াজে ভিনসেন্টের সমাধির পাশেই সমাহিত করা হয়। ইচ্ছে, মাটির বন্ধনে আজীবন আবদ্ধ থাকুক দুই সহোদর।

ভ্যান গঘ ও থিওর সমাধিক্ষেত্রে লেখক (বাঁ থেকে তৃতীয় ও তাঁর বন্ধুরা)

থিওর স্ত্রী ইয়নস দুই ভাইয়ের সমাধিতে লাগিয়ে ছিলেন আইভি। যেসব লতাগুল্ম খুব সহজে এঁকেছিলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ, তারই একটি আইভি। এই ছোট্ট উপশহর ‘উভে সুর ওয়াজে’ই শেষ দিনগুলো কেটেছিল ভ্যান গঘের।

গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে গিয়েছিলাম কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৪তম আসর কভার করতে। উৎসব শেষে প্যারিস হয়ে দেশের ফিরতি টিকিট। একটা পুরো দিন সময় আছে। কোথায় যাওয়া যায়? তথ্যচিত্র নির্মাতা প্রকাশ রয়ের বাসায় নিয়েছিলাম আতিথেয়তা। পরিকল্পনাটা আগের দিনই নেওয়া। বিকেলে শিল্পী দম্পতি আরিফ রানা আর তাঁর স্ত্রী কুমকুম এলেন গাড়ি নিয়ে। তার আগেই বাসায় এলেন ফ্রান্স উদীচী সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হাওলাদার।

এ পথেই সমাধি ভ্যান গঘের
ভ্যান গঘের স্মৃতিময় চারপাশ

সব মিলিয়ে পাঁচজন আমরা। গাড়ি ছুটল শহর ছাড়িয়ে। দিনটি ছুটির পর সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস। নতুন স্বাভাবিকে মানিয়ে নেওয়া প্যারিসে ট্রাফিক অনেক। গরমও পড়ছে। তবু কে জানত, গন্তব্য এত প্রশান্তিময় হবে?

উভে সুর ওয়াজের রেলস্টেশনের পাশেই গাড়ি পার্ক করলাম আমরা। কেমন উত্তেজনা বোধ করছিলাম। বিশ্বাসই হচ্ছিল না, প্রিয় ভ্যান গঘ এখানেই! এখানেই শুয়ে আছেন। উঁচু পাহাড় কেটে তৈরি পথ। ছুটলাম পথ নির্দেশ অনুয়ায়ী। দ্রুত চলতে তাগাদা দিলেন রানা ভাই। বন্ধ হয়ে যেতে পারে ‘গ্রেইভ ইয়ার্ড’। ছুটে গেলাম। এত এত সমাধি। কোথায় খুঁজব ভ্যান গঘকে? আবারও রানা ভাইয়ের নির্দেশনা। অবশেষে পেলাম, আইভি পাতায় ঢাকা দুই ভাইয়ের সমাধি।

নিজের চিকিৎসক ড. গ্যাসের প্রতিকৃতিও এঁকেছিলেন ভ্যান গঘ

খুব বেশি পর্যটক নেই। তবু ব্রিটিশ এক জুটির দেখা মিলল। করোনাকালেও তাঁদের ছুটে আসার কারণটা শুধুই ভিনসেন্টের প্রতি ভালোবাসা।

দুই মাসের বেশি প্রায় ৭০ দিনের বসবাসকালে ভ্যান গঘ প্রায় প্রতিদিনই ছবি এঁকেছেন। প্রায় ৮০টি ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি এই উপশহরকে।

টাউন হল এখন মেয়রের বাসভবন; পাশে পুরনো টাউন হলের ছবি

শহরের গির্জার সেই বিখ্যাত ছবি কিংবা টাউন হল, যার রেপ্লিকা আজও শোভা পায়, হলটির প্রবেশেপথের মুখে কিংবা 'হুইট ফিল্ড উইথ ক্রৌজ' সবই ভিনসেন্টের ওভরে সুর ওয়াজের স্মৃতি। ঘুরে ঘুরে সেই গমখেত দেখা হলো। তার পাশেই রাখা হয়েছে আঁকা ছবির রেপ্লিকা। গির্জার সামনে যখন এলাম তখন সূর্যটা ঘাড় বাঁকিয়েছে। নতুন করে তৈরি টাউন হলটা ঠায় দাঁড়িয়ে। এর প্রবেশমুখেই ভ্যান গঘের আঁকা টাউন হলের রেপ্লিকা।

সেই গির্জা

ড. গ্যাসে, ভ্যান গঘের চিকিৎসক। পরে যাঁর প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন ভ্যান গঘ, সেই গ্যাসেই এই শহরে নিয়ে এসেছিলেন ভ্যান গঘকে। সেই প্রতিকৃতি ১৯৯০ সালে বিক্রি হয়েছিল ৮০ মিলিয়ন ডলারে।

এই শহরেই ঠাঁই হয়েছিল পল সেজানসহ আরও কত শিল্পীর। এখানেই 'ওবেরজ রাভো' বাড়িটির ওপরের তলায় থাকতেন ভিনসেন্ট। বাড়িটি এখন 'দ্য ইনস্টিটিউট অব ভ্যান গঘের তত্ত্বাবধানে।

ওবেরজ রাভো নামের সেই বাড়ি ও নাম লেখা ফলক

মেঘলা আকাশ, ঝোড়ো হাওয়া, উড়ে বেড়ানো কাক আর একাকী সোনালি হলুদ গমখেত, ক্যানভাসের মাঝ দিয়ে চলে গেছে লালচে রাস্তা, যার ধারগুলোতে সবুজ ঘাস। এই উপশহরের আঁকা বিখ্যাত গমখেতের ছবি তাঁকে দিয়েছিল মৃত্যুর ঘ্রাণ। যখন কৃষকেরা খেত থেকে কেটে নিয়েছিলেন গম, তখন প্রিয় থিওকে লিখেছিলেন চিঠি। তাতে লেখা ছিল, বিরান খেত তাঁর কাছে যেন মৃত্যুর ঘ্রাণ পাঠিয়েছে!

ভ্যান গঘকে এই থিও ছাড়া আর কেউ বোঝেনি। যাকে যাকে কাছে পেতে চেয়েছেন, সেই হারিয়ে গেছে বা সরে গেছে তাঁর জীবন থেকে।

গম খেত, পাশে ভ্যন গঘের আঁকা ছবির প্রিন্ট

১৮৯০ সালের ২৭ জুলাই। এই ঘরেই একা একা হাঁটলেন দীর্ঘক্ষণ ভ্যান গঘ। রাতে বিছানায় শুয়ে নিজের বুকে নিজেই গুলি করলেন তিনি। কিন্তু তাঁর মৃত্যু তখনই হয়নি। গুলি চালানোর পর ঘরে গিয়ে দিব্যি ধূমপান করলেন, কিন্তু ৩০ ঘণ্টার মাথায় পাড়ি জমালেন পরপারে। ঘুণাক্ষরেও জানলেন না, মৃত্যুর পর অমরত্বে ঠাঁই হবে তাঁর নাম!

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, একাত্তর টেলিভিশন

ছবি: লেখক ও সাখাওয়াত হোসেন হাওলাদার