অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

ভূতের আস্তানা

লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের অতৃপ্ত আত্মারা ১

যে শহরের বয়স মাত্র দুই হাজার বছর, সেই শহরের নুড়িপাথরেও ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য আর চাঞ্চল্যকর ঘটনার সংযোগ থাকবে, সেটা বলাই বাহুল্য। শহরটার আধুনিক নাম লন্ডন। গ্রেট ব্রিটেনের রাজধানী। আয়তন ১ হাজার ৫৭২ স্কয়ার কিলোমিটার। স্রোতস্বিনী টেমস নদীর পাড়ে তেতাল্লিশ সালে ইউরোপের সবচেয়ে বৃহৎ শহরের গোড়াপত্তন করেছিল রোমানরা। এই তেতাল্লিশের আগে আর কিছু নেই। অর্থাৎ যিশুখ্রিষ্টের মৃত্যুর তেতাল্লিশ বছর পরই এই শহরের যাত্রা শুরু হয়। ওই সময় ইংরেজি ভাষা বলে কিছু ছিল না। ছিল ইংরেজি ভাষার আদিরূপ, যা ক্যালটিক ভাষা নামে পরিচিত। ক্যালটিক ভাষায় আজকের ঝাঁ–চকচকে লন্ডনের নাম ছিল লন্ডনিয়াম।

ট্রাফালগার স্কোয়ার
ছবি: জি আর সোহেল

লন্ডন শহরের যাত্রা শুরু হওয়ার ঠিক বিশ বছর পর ৬১ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনিয়াম বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে রোমানরা আবার নতুন করে নির্মাণ করে লন্ডন শহর। দুই হাজার বছর পর আজও অনেক রোমান স্থাপনা বাঁচিয়ে রেখেছে ব্রিটিশ হেরিটেজ ট্রাস্ট। অথচ আমরা অযত্নে অবহেলায় মাত্র কয়েক শ বছরের স্থাপনা বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি।

গত দুই হাজার বছরে লন্ডন শহর দেখেছে কত উত্থান–পতন। আক্রান্ত হয়েছে বারবার। সেই সঙ্গে ক্লান্তিহীনভাবে নতুন করে নিজেকে গড়ে তুলেছে সময়োপযোগী করে। লন্ডনের সৌন্দর্য, বিশ্ব অর্থনীতিতে লন্ডনের প্রভাবসহ হাজারো জটিল ও নান্দনিক বিষয় নিয়ে কয়েক হাজার পাতার বই লেখা যাবে। তবে লন্ডনের সব জৌলুশময় স্থাপনা আর ঐতিহ্যের মধ্যে আমার কাছে এক মহাবিস্ময়ের নাম লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড রেললাইন, যা টিউব নামেও পরিচিত। ১৮৬৩ সালে যাত্রা শুরু হয় লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের। মাটির প্রায় ৫৮ মিটার, অর্থাৎ ১৯০ ফিট নিচে প্রায় ১২ ফিট টানেল তৈরি করে সেই টানেলে সেন্ট্রাল লন্ডনের গভীর পাতালে চলছে দ্রুতগামী সেন্ট্রাল লাইন। ভাবা যায়? সেই সঙ্গে মাটির গভীরে রয়েছে আরও ১১টি রেললাইন এবং ২৭০টি স্টেশন।

মহাবিস্ময়ের নাম লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড রেললাইন

১৫০ বছরের পুরোনো এই আন্ডারগ্রাউন্ডের যেমন রয়েছে বিস্ময়কর ঐতিহ্য, তেমনি রয়েছে দাসপ্রথার কালো ছায়া। কারণ, তৎকালে প্রযুক্তির এত উত্তরণ ছিল না, তাই আফ্রিকান ক্রীতদাসদের ব্যবহার করা হতো পাতালরেলের পরিখা খননে। ইতিহাসবিদদের ভাষায় লন্ডন পাতালরেল তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ দাসদের অস্থি, মজ্জা, রক্ত আর জীবনের দামে। সেই বিষাদময় কালো অধ্যায়ের গল্প না হয় করব অন্য কোথাও অন্য কোনো সময়ে।

লন্ডনের দুই হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে আরও একটি বিষয় জড়িত, তা হলো ভূত বা প্রেতের ইতিহাস। কথায় আছে, যে শহরের বয়স যত বেশি, সেই শহরের ভূতেদের শানশওকত ও জৌলুশ ততটাই আকর্ষণীয়। সংগত কারণে শুধু লন্ডন নয়, ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে ভূতের চিহ্নিত আস্তানা রয়েছে; যা হন্টেড বা ভুতুড়ে জায়গা হিসেবে ন্যাশনাল ট্রাস্টে রেজিস্টার্ড। এই ভুতুড়ে জায়গার তালিকায় রয়েছে হাজার বছরের পুরোনো ক্যাসেল, গির্জা, কবরস্থান ও মাটির গভীরে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের স্টেশনের নাম। আজকে লিখব লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড রেলস্টেশনের তালিকাভুক্ত ভুতুড়ে জায়গাগুলো নিয়ে।

বেথনাল গ্রিন

বেথনাল গ্রিন টিউব স্টেশন

আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের নাম বেথনাল গ্রিন। পূর্ব লন্ডনে বাঙালি পাড়ার একেবারেই মাঝখানে এর অবস্থান। লন্ডনের প্রাচীন পাতালরেল স্টেশনগুলোর একটি বেথনাল গ্রিন স্টেশন; নির্মাণকাল ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ। এই স্টেশনে মাত্র একটি ট্রেন চলাচল করে, যার নাম সেন্ট্রাল লাইন। এই সেন্ট্রাল লাইন লন্ডনের পূর্ব ও পশ্চিম দুই প্রান্তকে বেঁধেছে একই সুতায়। আর মাঝখানে লকেটের মতো ঝুলে আছে সেন্ট্রাল লন্ডন। স্টেশনটির উদ্বোধন হয় ১৯৪০ সালে। ইতিমধ্যে পৃথিবীজুড়ে শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তাই আরও অনেক স্টেশন ও বাঙ্কারের মতো নতুন ভূগর্ভস্থ বেথনাল গ্রিন স্টেশনকে নাৎসি বাহিনীর এয়ার রেইড শেল্টার, অর্থাৎ নাৎসি বাহিনীর বিমান আক্রমণ থেকে বাঁচার আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়; কারণ, আকাশে বোমারু বিমানের গুরুগুরু শব্দ শুনলেই লোকজন যাতে দ্রুত মাটির নিচের এই আশ্রয়কেন্দ্রে ঢুকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। স্টেশনের ধারণক্ষমতা ছিল সাত হাজার।

আশ্রয়কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে

সাল ১৯৪৩। ৩ মার্চ। লন্ডনে ঘটে গেল নারকীয় বোমা হামলা। প্রাণপণে মানুষ ছুটল পূর্বঘোষিত আশ্রয়কেন্দ্রে। বাকি আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে কোনো সমস্যা না হলেও বেথনাল গ্রিন স্টেশনে ঘটল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম ধ্বংসযজ্ঞ। নাৎসি বাহিনীর বিমান আক্রমণের খবর শুনেই হন্তদন্ত মানুষের দল ঢুকতে লাগল স্টেশনের মধ্যে। দুপুরের মধ্যেই স্টেশনে অবস্থান করছিল ৫০০ মানুষ। বিকেলের মধ্যে ঢুকল আরও ১ হাজার ৫০০ জন। মার্চ মাসে বিলেতে শীতের প্রকোপ থাকে। সেই সঙ্গে থাকে বৃষ্টি ও পথঘাটে জমে থাকা জলে বরফের আস্তরণ। মানুষের পায়ে–পায়ে পথে জমে থাকা জলে সিঁড়িগুলো ছিল জবজবে। রাত তখন নয়টা। চারপাশে শোনা গেল বোমারু বিমানের আওয়াজ আর বোমা বিস্ফোরণের তীব্র আওয়াজ। যাঁরা তখন পর্যন্ত নিজের ঘরে অবস্থান করছিলেন, তাঁরা সবাই সদলবল বেথনাল গ্রিন স্টেশনের স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ি বেয়ে ঢুকতে থাকলেন নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। গাদাগাদি করা হাজারো মানুষের ভিড়ে পা পিছলে দু–চারজন ভূপাতিত হয়ে মারা গেলেন। আর বাকি ১৭৩ জন মারা গেলেন এসফিক্সিয়েশন বা অক্সিজেনের ঘাটতিতে। সেই রাতে যাঁরা মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিল ২৭ জন পুরুষ, ৮৪ জন নারী ও ৬২ জন শিশু।

এরপর কেটে গেছে বহু বছর। কিন্তু সেই ভয়াল রাতের ছায়া আজও রয়ে গেছে বেথনাল গ্রিন স্টেশনে। একদিন মধ্যরাত। এর মধ্যে রাতের শেষ ট্রেনও চলে গেছে। অর্থাৎ রাত ১২টা বাজে। দু–একজন প্যাসেঞ্জার স্টেশনে নেমে বেরিয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন অন্যসব কর্মীও। এরপরই রাতের নিস্তব্ধতা। নৈঃশব্দ আর গা–ছমছমে রাতে স্টেশনে শুধু রইলেন একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

বেথনাল গ্রিন স্টেশন ন্যাশনাল ট্রাস্টে রেজিস্টার্ড হয় হন্টেড বা ভৌতিক স্টেশন হিসেবে

তিনি অন্য সব বাতি বন্ধ করে দিনের শেষ পেপারওয়ার্ক করার জন্য প্ল্যাটফর্ম থেকে অফিসরুমে রওয়ানা দেওয়ার সময় শুনতে পান এক শিশুর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ। প্রথমে শোনার ভুল বা ভ্রম ভেবে তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। এর একটু পরেই তিনি শুনতে পান এক নারীর আর্তচিৎকার। সেই সঙ্গে আরও মানুষের সন্ত্রস্ত আওয়াজ। তিনি দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে এসে টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়ানোর পরেই ভূগর্ভস্থ প্ল্যাটফর্ম থেকে ভেসে আসছিল আর্তচিৎকার, যা চলে ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত। এরপরে আরও বহুবার গভীর রাতে এ রকম অদৃশ্য আওয়াজ শুনেছেন স্টেশনের বহু কর্মী এবং শেষ ট্রেনের যাত্রীরা। সেই থেকে বেথনাল গ্রিন স্টেশন ন্যাশনাল ট্রাস্টে রেজিস্টার্ড হয় হন্টেড বা ভৌতিক স্টেশন হিসেবে।

লেখক: পিএইডি গবেষক ও প্রভাষক, ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, এংলিয়া রাসকিন ইউনিভার্সিটি, কেমব্রিজ