সকাল সাড়ে ছয়টায় চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট মোড়ে পৌঁছে দেখি সঙ্গী দুজন তখনো এসে পৌঁছায়নি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সাকিব ও রাশিক চলে আসতেই সেদিনকার মতো যাত্রা শুরু-গন্তব্য কুমিল্লা। মোটামুটি দীর্ঘ পথ আজ। অন্যদিন যে রকমভাবে সকালের নরম আলোতে অনেক দূর চালিয়ে তারপর নাশতা করতাম, আজ সেটার দরকার পড়ল না। এই ভোরেও সবাই বাসা থেকে খেয়েই বেরিয়েছে।
চট্টগ্রাম শহরের সিটি গেটের কাছে নেমে ছবি তুলে আবার চলতে শুরু করলাম। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সাইকেল চালাতে দারুণ লাগছিল। এই মহাসড়ক চার লেন হওয়াতে দুর্ঘটনার হার কমে গেছে অনেকটাই। এত মসৃণ রাস্তা পেয়ে আমরা তিনজনই সমানে প্যাডলিং অব্যাহত রাখলাম। এ দিকের রাস্তায় একসময় বড় বড় গাছ থাকলেও রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে তার অনেকগুলোই কাটা পড়েছে। তাই ছায়া মিলছিল না খুব একটা। তবে মসৃণ রাস্তার জন্য সেটা অনুভূতও হচ্ছিল না খুব একটা।
ভাটিয়ারি, কুমিরা, সীতাকুণ্ড পেরিয়ে বারইয়ারহাটে কিছুক্ষণের জন্য থামলাম রাশিক আর আমি। সাকিবের দেখা নেই। এমনিতে আমরা তিনজন একসঙ্গে চালালেও আজ মাখনের মতো রাস্তা পেয়ে তিনজন একটু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নিজস্ব গতিতেই চালাচ্ছিলাম। এরই ফাঁকে সাকিব কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। তবে অল্পক্ষণ পরেই দেখা মিলল ওর। একটা মালবাহী ট্রাকের পেছনে ড্রাফটিং করে শাঁই করে বেরিয়ে গেল আমাদের চোখের সামনে দিয়ে। আমরাও রওনা হয়ে গেলাম। ঘণ্টা দেড়েক চালিয়ে মহিপালের কাছে পৌঁছাতেই আমাদের থামাল সাকিব। কুমিল্লা থেকে রওনা দিয়ে ততক্ষণে মহিপালে এসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন ইফাজ ভাই। আজ রাতে কুমিল্লায় তাঁর বাড়িতেই আমাদের থাকার আয়োজন। আমাদের এগিয়ে নিতেই তিনি কুমিল্লা থেকে রওনা দিয়ে এতটা পথে চলে এসেছেন।
আরেকবার চা পান করে রওনা দিলাম কুমিল্লার উদ্দেশে। পথে চৌদ্দগ্রাম বাজারে সারলাম দুপুরের খাবার। খেয়ে রওনা হয়ে মীরের বাজারের কিছুটা পরেই একটা বিকল্প সড়ক ধরলাম আমরা। এই রাস্তা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। গুগল ম্যাপকে সরিয়ে কুমিল্লার অধিবাসী ইফাজ ভাই এবার আমাদের পথপ্রদর্শকের ভূমিকায়। রাস্তাটা নির্জন। খানিকক্ষণ পরপর এক-দুটি গাড়ির দেখা মিলছিল। বিকেলের মরা আলোতে দুই পাশের ধানখেত দেখতে দেখতে চলতে ভালোই লাগছিল। বেশ কয়েকটা বাজার পেরিয়ে কুমিল্লা শহরে যখন পৌঁছালাম, তখন রাস্তার স্ট্রিট ল্যাম্পগুলো সবে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। এবার এসে কুমিল্লা শহরটিকে আগের চেয়ে খানিকটা ঘিঞ্জি বলেই মনে হলো।
অনেকগুলো সিএনজি-রিকশাকে পাশ কাটিয়ে ধর্মসাগরের পাড়ে গিয়ে বসতেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে গেল। জায়গাটা বেশ জমজমাট। ধর্মসাগরের এপাড়-ওপাড়জুড়ে আড্ডাবাজদের ভিড়। কেউবা চুটিয়ে প্রেম করছে আর কেউবা ব্যস্ত সান্ধ্যভ্রমণে। আমাদের আসার সংবাদ শুনে ওখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন কুমিল্লার চার-পাঁচজন পরিচিত। তাঁদের সঙ্গে আমাদের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে করতেই আরেক দফা পেটপূজা চলতে লাগল।
ঘণ্টাখানেক আড্ডার পর ইফাজ ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার পালা। তাঁর বাড়ি শহর থেকে কিছুটা দূরে। শাসনগাছার কাছে আসতেই রনি ভাই ফোন করে থামালেন। তাঁর পীড়াপীড়িতে ভরা পেটেও আবার খেতে হলো। রওনা দেওয়ার সময়ে তিনি তিন ধরনের ফল কিনে দিলেন যাত্রাপথে খাওয়ার জন্য। যখন ইফাজ ভাইয়ের বাড়িতে পৌঁছালাম, তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় ১০টা ছুঁই ছুঁই। সাকিবের এন্ডমন্ডো অ্যাপ বলছে, আমরা পুরো দিনে সাইকেল চালিয়েছি ১৮৫ কিলোমিটার। ইফাজ ভাইদের বিশাল উঠোনে সাইকেলগুলো রেখে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসতেই দেখি বিশাল আয়োজন। টেবিলের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত উঁকি দিচ্ছে বিভিন্ন আইটেম। সন্ধ্যা থেকেই এটা-সেটা খেয়ে আমরা মোটামুটি ভরপেট। ইফাজ ভাইয়ের চাপাচাপিতে তাতেও রেহাই মিলল না।
কাল রাতের আঁধারে এখানে এসে পৌঁছেছি বলে চারপাশটা খুব একটা ভালো করে দেখা হয়নি। সকালের কুয়াশা ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে এক সারিতে লাগানো অগণিত গাছ। দারুণ সুন্দর পরিবেশ। ইফাজ ভাইয়ের নাশতার অনুরোধ উপেক্ষা করে যখন রওনা হচ্ছি, তখনো হালকা কুয়াশার চাদরে মোড়া চারদিক। গোমতী নদীর পার ঘেঁষে চলছি আমরা। সঙ্গী হিসেবে আছেন ইফাজ ভাই। পথে এক জায়গায় থেমে মাত্রই গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস পান করা হলো। কিলোমিটার তিনেক চালাতেই পৌঁছে গেলাম ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে। দারুণ সাজানো-গোছানো চারপাশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ৭৩৭ জন সৈনিক শায়িত আছেন এখানে। এখান থেকেই ইফাজ ভাইকে বিদায় দিয়ে আমরা চললাম ঢাকার উদ্দেশে।
আবার যাত্রা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে। মসৃণ সেই রাস্তা ধরে একটানা চালিয়ে চান্দিনা। অপেক্ষারত করিম ভাই আর আকাশ ভাইয়ের সঙ্গে পাশের এক খাবার হোটেলে সারলাম সকালের নাশতা। আজ অন্যদিনের তুলনায় খুব একটা বেশি দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে না বলে তাড়াও কম। মাধাইয়া বাজার, কুটুম্বপুর নামের বেশ কয়েকটা ছোট ছোট বাজার পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম দাউদকান্দি। দাউদকান্দি সেতুর এ পারে চট্টগ্রাম বিভাগ আর অপর পারে ঢাকা বিভাগ। এ সেতুতে সাইকেল নিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ নেই। নির্বিঘ্নে সেতু পার হয়ে প্রবেশ করলাম মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায়। গজারিয়া পেরিয়ে কিছু দূর এগোতেই মেঘনা সেতু। এরপরই দুই পাশের দৃশ্যপট পাল্টে গেল।
এতক্ষণ রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট বাজার, হরেক রকমের গাছপালা চোখে পড়লেও এবার তার জায়গা নিল বিশাল সব শিল্পকারখানা। পথে এক জায়গায় এক খাবার হোটেলের সামনে অনেকগুলো ট্রাকের ভিড় দেখে আমরাও থেমে গেলাম সেখানে। পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে, ট্রাক ড্রাইভাররা যাত্রাপথের সবচেয়ে ভালো খাবার হোটেলগুলোর সন্ধান জানেন। এতগুলো ট্রাক যেহেতু এখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেহেতু এখানকার খাবার ভালো হওয়ারই কথা। খেতে বসে আমাদের পূর্বানুমান দারুণভাবে মিলে গেল।
দুপুরের খাবার সেরে মোগড়াপাড়ায় মুস্তাক ভাইকে খুঁজে পেতে দেরি হলো না। তিনি সোনারগাঁয়ের স্থানীয়। পেশায় শিক্ষক। তাঁর পিছু পিছু চলতে শুরু করে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে গিয়ে থামলাম। সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় জাদুঘর সেদিন বন্ধ। আমরা ছুটলাম পানাম নগরীর দিকে। ঘণ্টাখানেক ধরে পানাম নগরীতে চক্কর দিয়ে আবার হাইওয়েতে। পথে মদনপুরা বাসস্ট্যান্ডে দেখা মুন্না আর তন্ময় ভাইয়ের সঙ্গে। ছোট্ট আড্ডা সেরে তারাবোর পরে ধরলাম স্টাফ কোয়ার্টারের রাস্তা। ঢাকার বিখ্যাত জ্যাম অনেকটাই এড়ানো সম্ভব এ পথে গেলে। রওনা হতেই রাস্তার দুই পাশ আমাদের মুগ্ধ করতে থাকল। ঢাকার এত কাছেই এত সবুজে ঘেরা জায়গা আছে, আমার জানাই ছিল না। খিলগাঁওয়ে অপেক্ষা করছিলেন জামিল ভাই। চা-পানির পর্ব শেষে পা বাড়ালাম বাড্ডার দিকে।
ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় দেখা হলো অনেকের সঙ্গে। বাড্ডার কাছে আশরাফুল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হতেই জোর করে নিয়ে গেলেন পাশের এক রেস্টুরেন্টে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটাতে বিরিয়ানি অর্ডার করাতে আমরা হইহই করে উঠলাম। প্রত্যুত্তরে জানালেন, না খাইয়ে ছাড়ছেন না। বিরিয়ানিটা খেতে অসাধারণ ছিল বিধায় সন্ধ্যাতেই চেটেপুটে খেলাম। বিদায় নিয়ে চললাম নিকুঞ্জের দিকে। রানা ভাইয়ের নিকুঞ্জের বাসাতেই আজ রাত্রিযাপন।
আগের রাতে দেরিতে ঘুমানোয় ঘুম ভাঙতেও একটু দেরি হয়ে গেল। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এয়ারপোর্ট পেরোতেই সাকিবের চাকা ফেটে গেল। সাকিব প্রথমবারের মতো ট্রিপে টুল কিট ব্যবহার করতে হবে দেখে খুশিই হলো। তাড়াতাড়ি লিক সারিয়ে আমরা রওনা হলাম। আজকের গন্তব্য সিরাজগঞ্জ। আজমপুর থেকে সেক্টর-১১–এর ভেতরের রাস্তা ধরে আশুলিয়া ব্রিজ। জিরাবো পার হয়ে নাশতা সারলাম এক ঝুপড়িতে। দোকানের ক্যাশে বসে থাকা ঘোলাটে চশমা চোখে আঁটা বৃদ্ধটি আমাদের উদ্দেশ্য জানতে পেরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। যুবক বয়সে তাঁরও শখ ছিল দেশ দেখার। আর্থিক সংকট, সংসার, দোকান ইত্যাদির চক্করে পড়ে সে স্বপ্ন আর বাস্তবে রূপ নেয়নি।
বিকেএসপি পার হওয়ার সময় থামলাম। আমার জনা তিনেক বন্ধু পড়ার সুযোগ পেয়েছিল এই ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে। বেশ কিছুক্ষণ বন্ধুদের নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভুগে আবারও পথে। নন্দন পার্ককে হাতের বাঁয়ে রেখে কিছু দূর এগোতেই চন্দ্রা। রাস্তার কাজ চলছে বলে এদিকের রাস্তার অবস্থা বেশ নাজুক। কুমুদিনী মেডিকেলে কর্মরত লিয়াকে ফোন দিয়ে জানলাম রাস্তার অবস্থা। উত্তর শুনে বুঝলাম, ধুলায় ধূসরিত হয়েই সিরাজগঞ্জ শহরে ঢুকতে হবে। কালিয়াকৈর পেরিয়ে কিলোমিটার দশেক গেলেই মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ফটক। ওখানে কিছু সময় কাটিয়ে আবার সাইকেলে। রাস্তার অবস্থা তথৈবচ। মনে হচ্ছিল, মরুঝড়ের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছি। এই রাস্তায় সাইকেল চালানোটা মোটেও সুখকর কোনো অভিজ্ঞতা নয়।
ধুলার সাগর পাড়ি দিয়ে একসময় এসে পড়লাম টাঙ্গাইল বাইপাসে। টাঙ্গাইল শহরে না ঢুকে বাইপাস দিয়েই এলেঙ্গার পথ ধরলাম। এবার সাইকেল চালানোর সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার বাঁ দিকে রাখছি তীক্ষ্ণ নজর। উদ্দেশ্য জয় মা দুর্গা মিষ্টান্ন ভান্ডার খুঁজে বের করা। আগেরবার রাস্তার পাশের এই মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি খেয়ে আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দুই দিন ধরে সে গল্পই চলছিল রাশিককে উদ্দেশ্য করে। জয় মা দুর্গা মিষ্টান্ন ভান্ডার দৃষ্টিগোচর হতেই এক নিমেষে নিজেদের আবিষ্কার করলাম দোকানের বেঞ্চিতে। ভরদুপুরে ভরপেট চমচম আর দই খেয়ে তবেই নিস্তার। মাত্রাতিরিক্ত মিষ্টি খেয়ে মাত্রার নিচের গতিতে প্যাডেল ঘুরিয়ে চলে এলাম এলেঙ্গার কাছাকাছি। এদিকের পুরো রাস্তায় একটুও গাছের ছায়া মেলেনি। ধূলিধূসর এই প্রান্তরে নিজেদের বাইসাইকেল আরোহীর চেয়ে মরুভূমির উট পালকই বেশি মনে হচ্ছিল। এলেঙ্গা রিসোর্ট পেরিয়ে কিছু দূর আসতেই সবুজ বনানীর দেখা মিলল। ভরদুপুরের টানা রোদে চালিয়ে ক্লান্ত আমরা একটা বড় গাছের নিচে আশ্রয় নিলাম। খানিক জিরিয়ে আবার চলা শুরু।
বঙ্গবন্ধু সেতুর কাছে থামতে হলো। আগে থেকেই জানা ছিল এ সেতুর ওপরে সাইকেল চালানো নিষেধ। জনপ্রতি বিশ টাকার বিনিময়ে সাইকেল বাসের ছাদে চড়িয়ে দিয়ে সেতু পার হয়ে টোল প্লাজার পরেই নেমে পড়লাম রাস্তায়। এ পাশে গড়ে তোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ইকো পার্ক। বেশ গোছানো জায়গাটা। আবার পথ চলতে শুরু করে মুলিবাড়ি মোড়ে এসে হাটিকুমরুলের সড়ক ছেড়ে সিরাজগঞ্জ শহরগামী ছোট সড়ক ধরলাম। পথে ছোট ছোট বাজার পেরিয়ে যাচ্ছি। ছয়-সাতটা দোকান নিয়েই এদিকের বাজারগুলো। বাজার ছাড়াও পাড়ার গলির মুখে চোখে পড়ছিল বেশ কিছু ভাজাপোড়ার দোকান।
আরও কিছুটা এগিয়ে এমনই একটা ভাজাপোড়ার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা। গরম গরম পেঁয়াজু-বেগুনি দিয়ে বৈকালিক আহার শেষ করে পাশের দোকান থেকে এক প্রস্থ ফুচকা-চটপটিও সাঁটানো হলো। পাশেই শীর্ণকায় ধারার একটা খাল বয়ে চলেছে। তার পাড়ে বসে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে যখন সিরাজগঞ্জ শহরে ঢুকলাম, ততক্ষণে সন্ধ্যা জমাট বেঁধে গেছে। এখানে এসে উঠলাম পূর্বপরিচিত হোটেল আল-হামরায়। ফ্রেশ হয়ে শহীদ মিনারের সামনের চত্বরে বসে বেশ কিছুক্ষণ জমাটি গল্প-গুজব করে হোটেলে যখন ফিরছি, ততক্ষণে আশপাশের সব দোকানের ঝাঁপ পড়ে গিয়েছে।
রাত পেরিয়ে সকাল। আজকের গন্তব্য গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী। সকালে যখন প্যাডেল ঘোরাতে শুরু করলাম, তখনো প্রকৃতি কুয়াশার চাদরে নিজেকে রেখেছে আবৃত। তিনজনই এক সমান্তরালে চলেছি। সাইকেল চালানোর উপযুক্ত সময় এই শীতের সকাল। শিয়ালকোল বাজার হয়ে নলকার কাছাকাছি এক ঝুপড়িতে সারা হলো প্রাতরাশ। অল্প এগিয়েই মহাসড়ক। ফুলজোড় নদীর ওপর নির্মিত সেতু ছাড়িয়ে খানিক এগিয়েই হাটিকুমরুল। বেশ জমজমাট জায়গাটা। এখান থেকে সোজা রাস্তাটা এগিয়েছে নাটোরের বনপাড়া বাইপাসের দিকে। আর আমরা ধরলাম হাতের ডানের ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক, তথা এন-৫। এ রাস্তাই বগুড়া হয়ে পৌঁছে দেবে আমাদের আজকের গন্তব্য গাইবান্ধার পলাশবাড়ী।
তিনজনই চলছিলাম নিজস্ব গতিতে। রাস্তা বেশ মসৃণ। মহাসড়কের ধারের গাছগুলোর ঠাসবুননির পাতার ফাঁক চিরে তেরচা আলো পড়তে শুরু করেছে রাস্তায়। বেশ খানিকটা পথ চলার পর বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলা। খানিক জিরিয়ে এক টানে গিয়ে থামলাম বগুড়া বাইপাসের কিছুটা আগে। গুগল ম্যাপে চোখ বুলাচ্ছিলাম রাস্তার খোঁজে। এর মধ্যেই দুজন সাইকেল আরোহী কথা বলতে এল। আমরা ক্রস কান্ট্রি রাইডে বেরিয়েছি শুনেই এদিক-সেদিক ফোন করে মিনিট দশেকের মধ্যেই আরও জনা পাঁচেক হাজির। বাইপাস হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও সাইক্লিস্টদের অনুরোধে ওদের পেছনেই প্যাডেল ঘোরালাম।
প্রথমেই গেলাম বগুড়া সাইক্লিস্টের পরিচিত মুখ ডলার ভাইয়ের অফিসে। পঞ্চাশের ওপরে বয়স তাঁর। কয়েক দিন আগেই সাইকেল চালিয়ে বগুড়া থেকে এক দিনে ঢাকা চলে গিয়েছেন। স্থানীয় একটা পত্রিকা অফিসে নিয়ে গেলেন ডলার ভাই। ততক্ষণে হাজির আসিব ও ওয়াসিফ। এশিয়া সুইটসে সম্ভব সব রকম মিষ্টি চেখে রওনা দিলাম বেহুলার বাসরঘরের উদ্দেশে। বগুড়া শহরটা বিভাগীয় শহর না হলেও প্রচুর ভিড়। রাস্তায় মানুষে গিজগিজ করছে। তবে এ শহরের অন্যতম আকর্ষণীয় জায়গাটা সাতমাথা। সাত দিক থেকে সাতটা রাস্তা এসে মিশেছে এই জায়গাতে। ডলার ভাই আগে আগে চলছেন পথপ্রদর্শকের ভূমিকায়।
আমরা তিনজন ছাড়াও সঙ্গী আরও দুজন। আসিব আর ওয়াসিফ। কিছু দূর এগিয়ে মহাসড়ক ছেড়ে ভেতরের রাস্তা ধরলাম। সঙ্গে স্থানীয় লোকজন থাকায় ম্যাপের ওপর চোখ না বুলিয়েই চলছি। রাস্তার দুই পাশ দেখতে দেখতে সামনে এগোচ্ছি। গাড়ির কর্কশ হর্নের শব্দ ছাপিয়ে পাখির কুজনও কানে এল বারকয়েক। গ্রামের ছোট রাস্তা ধরার এই এক সুবিধা। বেহুলার বাসরঘরে ওয়াসিফের জিম্মায় সাইকেল রেখে পুরো জায়গাটা এক চক্কর দিলাম। বগুড়ার দামাল সাইক্লিস্টদের সঙ্গে ফটোসেশন শেষে আবার দ্বিচক্রযানে। মহাসড়কে তুলে দিয়ে তাঁরা যখন বিদায় জানালেন, তখন বিকেলের নরম আলো গায়ে অল্প হলেও উষ্ণতা জাগাচ্ছে।
বাকি পথটুকু মহাসড়ক ধরেই। সন্ধ্যা হতে খুব বেশি সময় বাকি নেই। জোরে প্যাডেল ঘোরালাম আমরা। মোকামতলা থেকে কিছুটা সামনে এগোতেই ঢুকে পড়লাম গাইবান্ধা জেলার সীমানায়। একই সঙ্গে প্রবেশ করলাম রংপুর বিভাগে। মসৃণ রাস্তা ধরে একটানা চালিয়ে গোবিন্দগঞ্জ। হাঁকডাকে মুখর এই বাজার চরম ব্যস্ত। বেশ কয়েকটা অটোরিকশাস্ট্যান্ড পেরিয়ে বাজারের শেষ মাথায় ছোট্ট একটা চা–বিরতি। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে পৌঁছে গেলাম আজকের গন্তব্য পলাশবাড়ীতে। থামলাম মহাসড়ক লাগোয়া শিল্পী হোটেলে। এই এলাকার বেশ বিখ্যাত হোটেল কাম রেস্টুরেন্ট। বেশ ভিড় লোকজনের। হোটেলে কথা বলতে বলতেই ছাদের ওপর সদ্য নির্মাণ সমাপ্ত হওয়া একটা রুম বরাদ্দ হলো আমাদের জন্য। হোটেলের লোকজন দয়াপরবশ হয়ে পাশের একটা কক্ষ খুলে দিলেন আমাদের সাইকেলগুলো রাখার জন্য। রাতের খাবারটা সেরে হোটেলের ওয়েটারের পীড়াপীড়িতে মিষ্টি চাখলাম।
হোটেলের ছাদ থেকে যখন সাইকেল নামিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছি, তখনো ফজরের নামাজ শেষে মুসল্লিরা মসজিদ থেকে বেরোয়নি। এত ভোরে বেরোবার একটাই কারণ, আজকের পথটা তুলনামূলকভাবে গত দুই দিনের চেয়ে বেশি। সময়টা জানুয়ারির শেষ হলেও খুব একটা শীত নেই। ঢাকায় দু–তিনজন বন্ধু উত্তরবঙ্গের এই বছরের শীত নিয়ে এমন সব ভয় দেখিয়েছিল, সেসব চিন্তা করেই এখন হাসি পাচ্ছে। আলো-আঁধারির মধ্যে ঘুরছে সাইকেলের চাকা। এই ভোরের সময়টা আমরা সবাই কেমন জানি নিশ্চুপ হয়েই সাইকেল চালাই। হয়তোবা নিজের সঙ্গটাই ভালো লাগে এই লগ্নে। দুই পাশে দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত দেখতে মৃদু আলোতে কেমন অদ্ভুতুড়ে লাগছে। রাস্তায় স্থানে স্থানে খানিকটা খানাখন্দ। একটা দুর্ঘটনাকবলিত ট্রাক পাশের ধানখেতে উবু হয়ে পড়ে আছে। পীরগঞ্জে এসে ইতি-উতি খুঁজতে লাগলাম খাবারের দোকান। নাশতা শেষে পাশের একটা দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে এল রাশিক। আরেক দফা পরোটা চেয়ে নিয়ে মিষ্টি খাওয়া হলো পরোটাসমেত। মিষ্টির কেসে সাকিব বরাবরই দর্শক।
দিনের বড় একটা অংশই আজ চালাতে হবে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক ধরে। এই সকালবেলায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছেড়ে আসা রংপুরগামী বাসগুলো কানের পাশ দিয়ে তীব্র হাওয়ার ঝাপটা তুলে ছুটে যাচ্ছে গন্তব্যের পানে। মহাসড়কের একদম কিনার ধরে এক লাইনে চলেছি আমরা। বেশ কিছু জায়গায় দেখা মিলছে সবুজাভ কাণ্ডে হলুদ টোপর মাথায় নিয়ে দাঁড়ানো শর্ষেখেতের। শঠিবাড়ি পার হতেই বেশ মসৃণ রাস্তা পেয়ে গেলাম। পায়রাবন্দ হয়ে রংপুরের মডার্ন মোড়ে পৌঁছে গেলাম রোদ চনমনিয়ে ওঠার কিছুক্ষণ বাদেই। কী এক কাজে রংপুর এসেছিলেন রাকা আপু। আমরা এই রাস্তা ধরেই যাব শুনে টমটমে চেপে মোড়ের কাছেই এক টংদোকানে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। বেশ খানিকক্ষণ গল্পগুজব করে আমরা উঠলাম সাইকেলে আর আপু টমটমে। মেডিকেল মোড়, উত্তম বাজার পার হয়ে পাগলাপীর।
ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক ছেড়ে ধরলাম রংপুর-জলঢাকার রাস্তা। গঞ্জিপুর বাজার থেকে হাতের বাঁয়ের রাস্তা ধরে কিছু দূর এগোলেই রংপুরের অন্যতম জনপ্রিয় বিনোদনকেন্দ্র ভিন্নজগৎ। সাইকেলগুলো নিরাপত্তারক্ষীর জিম্মায় রেখে একটা চক্কর কাটলাম পার্কের ভেতর। আবার গঞ্জিপুর এসে রংপুর-জলঢাকার রাস্তায়। এ রাস্তায় নতুন পিচ করা হয়েছে। চওড়ায় খুব একটা প্রশস্ত নয়। যানবাহনের চাপ নেই বললেই চলে। উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত ভ্যানই বেশি। এদিকে ধান কাটা আগেই শেষ হয়েছে। ধানের জায়গা নিয়েছে মূলত শর্ষেখেত। মৃদুমন্দ বাতাস শর্ষেগাছের হলুদাভ অংশকে দুলিয়ে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। রাস্তার দুই পাশের দৃশ্যের কারণেই রাস্তার চেয়ে পাশের বিলগুলোতে মনোযোগ বেশি। খেতে প্রাত্যহিক কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে সাইকেল আরোহী তিন যুবকের দিকে অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকাচ্ছে লোকজন। চন্দনের হাট হয়ে বড়ভিটা।
দুপুরের আগে আগেই জলঢাকা। জলঢাকা ছোট্ট, ছিমছাম একটা জায়গা। বাসস্ট্যান্ডের মসজিদ লাগোয়া একটা হোটেলে সারলাম দুপুরের খাবার। খাবার পর মিষ্টির খোঁজে এদিক-সেদিক ঘুরে আবার প্যাডেল ঘোরালাম। এ রাস্তাটায় চালাতে দারুণ লাগছিল। মহাসড়কের মতো একদম সরল বিস্তৃতির রাস্তা না যদিও। কিছু দূর পরপরই ছোটখাটো বাঁক। মহাসড়কের ব্যস্ততাটা নেই বলেই আরও বেশি উপভোগ করছিলাম। আর উপরি হিসেবে শীতের উত্তরবঙ্গের আমেজ তো আছেই। এক ঘণ্টার কিছুটা বেশি চালিয়ে সাইকেল থামালাম একটা সুন্দর ভাস্কর্যের ঠিক সামনে। ডোমারের স্কুলসংলগ্ন এই ভাস্কর্যের নাম ‘হৃদয়ে স্বাধীনতা’। সুন্দর একটা লাভ সাইন আছে ভালোবাসার কেন্দ্রে।
ডোমার থেকে প্যাডেল ঘুরিয়ে দেবীগঞ্জ। ব্যস্তসমস্ত দেবীগঞ্জ পার হতেই বদলে গেল রাস্তার দুই পাশ। রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত চওড়া। বেশ অনেকক্ষণ পরপর দেখা মিলে এক-দুটো ভ্যানের। গাছপালা খুব একটা নেই। মূল রাস্তা থেকে যেসব শাখা রাস্তা বেরিয়েছে সেসবের দুই ধারে অবশ্য আকাশমণি আর ইউক্যালিপটাসের প্রাচুর্য। বেশ কিছু গ্রাম্য হাট পেরিয়ে শেষ বিকেল নাগাদ ১৫০ কিলোমিটার চালিয়ে পৌঁছে গেলাম পঞ্চগড়ের বোদায়। বোদায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা ইমরান ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে। ইমরান ভাই সাকিবের পূর্বপরিচিত। বোদায় পৌঁছে শ্বশুর সাহেবকে ফোন দিতেই তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী একেবারে বাড়ির সামনে এসে থামলাম। ইমরান ভাইয়ের শ্বশুর পূর্বে কর্মরত ছিলেন সেনাবাহিনীতে। বর্তমানে অবসরজীবন যাপন করছেন। ফ্রেশ হয়ে বেরোলাম তাঁর সঙ্গে। রাশিক আর সাকিব ঘুমাবে বলে আর বেরোল না। আঙ্কেল বাজারের এদিক-সেদিক ঘোরালেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে।
এত দিনের কাঙ্ক্ষিত এই ভ্রমণের আজ শেষ দিন। শেষ করার আনন্দটা ছাপিয়েও এ রকম একটা যাত্রা শেষ হয়ে যাওয়ার বেদনাটাই প্রকট হয়ে উঠেছে। ঠিক এক সপ্তাহ আগে আমরা শুরু করেছিলাম দেশের সর্ব দক্ষিণ প্রান্তের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে। সপ্তাহ ঘুরতেই আমরা দেশের সর্ব উত্তর প্রান্তের একেবারে দ্বারপ্রান্তে।
গত দিন পাগলাপীর থেকে হাতের ডানে বাঁক নিয়ে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক ছেড়েছিলাম। আজ চলতে শুরু করার মিনিট দু-একের মধ্যেই সেই মহাসড়কেই উঠে পড়লাম। বোদা থেকে পঞ্চগড় সদরের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা চরাচরের নীরবতা ভাঙল রাশিকের ফোনের রিংটোনে। সাইকেল চালানোরত অবস্থায় সেই ফোন ধরতে গিয়ে রাস্তার একদম মাঝখানেই পপাতঃধরণীতল। টেনে তোলার আগে সাকিব আর আমি একচোট হেসে নিলাম। ময়দানদিঘি বাজার পেরিয়ে কিছু দূর যেতেই দেখা মিলল পঞ্চগড় সুগার মিলের। বিশাল এলাকাজুড়ে এই সুগার মিল। রাস্তার বাঁ দিকটায় সুগার মিলের বিশাল টিনের তৈরি প্রাচীন কাঠামো। আর ডান দিকে সুসজ্জিত কোয়ার্টার।
ধাক্কামারার মোড়ে গিয়ে ফোন দিলাম সাকিবকে। ও খানিকটা পেছনে পড়েছে। আমাদের বাসস্ট্যান্ডের কাছেই অপেক্ষা করতে বলে দিল সে। সাকিব আসার ফাঁকেই আমরা আমাদের ফিরতি যাত্রার চট্টগ্রাম অভিমুখী বাসের টিকিট করে নিলাম। বিকেল চারটায় বাস। এখনো হাতে অনেক সময়। এর মধ্যেই বাংলাবান্ধা গিয়ে আরামেই ফিরে আসা যাবে। সাকিব আসতেই আবার সাইকেলে। পঞ্চগড় শহর ছাড়াতেই লোকালয়ের দেখা মিলছে বেশ কিছুক্ষণ পরপর। প্রশস্ত এই রাস্তা দারুণ নজরকাড়া। সাইক্লিস্টদের ভাষায়, ‘এক্কেবারে মাখন রাস্তা, মাম্মা!’ শেষ দিন বলে কয়েক জায়গায় থেমে নিজেদের ছবিও তুললাম। জগদল পার হয়ে বোর্ড অফিস হাট। টানা আরও কিছুক্ষণ প্যাডেল মেরে দশমাইল বাজার। ভজনপুর ছাড়াতেই দেখা মিলছিল চা–বাগানের। সুদৃশ্য সব চা–বাগান পেরিয়ে তেঁতুলিয়া।
তেঁতুলিয়া জায়গাটা আমার বেশ পছন্দের। আগেও আসা হয়েছে এখানে। চৌরাস্তা বাজার থেকে কিছুটা এগিয়ে মহানন্দা পারের জেলা পরিষদের ডাকবাংলোটা দেখে বরাবরের মতো লোভ হলো। মনকে বাড়ি ফেরার তাগাদা দিয়ে সামনের দিকে ছুটে চলা। বাঁ দিকে অল্প দূরেই দেখা যাচ্ছে মহানন্দার পাড় ঘেঁষেই ভারত-বাংলাদেশ সীমানা। ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দিচ্ছে কাঁটাতারের বেড়া। যত লক্ষ্যের পানে এগোচ্ছি, ততই কমে আসছে জনপদের সংখ্যা। এই রাস্তা একদম সরল বিস্তৃতির। শেষ হয়েছে একদম বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে গিয়ে। পায়ে ব্যথার কারণে সাকিব কিছুটা পিছিয়ে।
বাংলাবান্ধার একদম কাছাকাছি আসায় আমি আর রাশিক গতি কিছুটা কমিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম সাকিবের জন্য। এক সঙ্গে জিরো পয়েন্টে প্রবেশ করলাম তিনজনই। শুরুর মতো শেষেও ছবি তুলে দিলেন একজন বিজিবি সৈনিক। একজন আরেকজনকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে শেষ হলো আমাদের আট দিনের যাত্রা।
এবার ফেরার পালা। পঞ্চগড়গামী বাসের ছাদে উঠে পড়লাম তিনজনই। পঞ্চগড় বাসস্ট্যান্ডের কাছেই অপেক্ষা করছিলেন জুয়েল ভাই। তিনি অভিনন্দন জানিয়ে নিয়ে গেলেন পাশের রেস্টুরেন্টে। খাওয়ালেন দুপুরের খাবার। বাস ছাড়ার তখনো ঘণ্টাখানেক দেরি। জুয়েল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা অনেক দিন পর। তিনি চট্টগ্রামের বাসিন্দা হলেও ব্যবসার কাজে প্রায়ই আসেন পঞ্চগড়ে।
কাউন্টারে পৌঁছে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে সাইকেলের বাঁধা-ছাদা শেষ করলাম। আমাদের তিনজনেরই সিট বাসের একেবারে শেষ সারিতে। রোলার কোস্টার রাইডের প্রস্তুতি নিয়ে খানিক বাদেই বাকি দুজন বেঘোর ঘুমে।
ঘুমটা ভাঙল ভয়াবহ একটা ঝাঁকুনিতে। ফেনীর কাছাকাছি নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের কাছে একটা লরির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটল আমাদের বহনকারী বাসটির। আমার কাঁধ আর ঠোঁটে তীব্র ব্যথা। পাশের সিটে বসা সাকিবের থুতনি থেকে রক্ত ঝরছে অঝরে। রাশিক জেগে ছিল বিধায় শেষ মুহূর্তে সামলে নিতে পেরেছিল। ভাগ্যবশত ওর তেমন কিছুই হয়নি। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় কোনোমতে আহত অবস্থাতেই পৌঁছলাম চট্টগ্রামে। তারপর চিকিৎসা। খুব বেশি কিছু হয়নি। পুরো রাইড শেষ করতে পেরে এ অবস্থাতেই মনটা ফুরফুরে।