কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র

৮৫০ টাকার প্যাকেজে কাপ্তাইয়ের ক্যাম্পসাইটে যে সুবিধাগুলো পেয়েছি

পাহাড়ের গা পেঁচিয়ে ফিতার মতো চলে গেছে মসৃণ উঁচুনিচু সড়কটা। সেই পথ ধরেই সিএনজিচালিত অটোরিকশাটা এসে পৌঁছাল কাপ্তাই প্রশান্তি পার্কের ফটকে। সকাল পেরিয়ে তখন মধ্যদুপুর।

আমরা এখানে এসেছি ক্যাম্পিংয়ে। তাঁবু পাতা হবে বিকেলে, আপাতত বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। ক্যাম্পসাইটে সবার ব্যাগ রাখার জন্য একটা রুম আছে। ব্যাগপত্র রেখে চলে এলাম নদীর তীরে। নদীর পাড়ে পার্ক কর্তৃপক্ষের একটা মাচা ঘর আছে। শণ ও বেত দিয়ে ছাওয়া, মুলিবাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মেঝে। ষোলো ঘণ্টার যাত্রায় ক্লান্ত শরীর। সাত-পাঁচ না ভেবেই মাচায় শুয়ে পড়লাম।

পাহাড়ের কোলে ক্যাম্পসাইট

শীতের দুপুর। শীতল হাওয়া গায়ে মেখে কতক্ষণ শুয়ে ছিলাম ঠিক জানি না, এক কিশোরের ডাকে জেগে উঠলাম। সে জানাল, ঘাটে কায়াক বোট প্রস্তুত। অগত্যা নামতে হলো। চারটি কায়াকে আমরা আটজন কর্ণফুলীর টলমলে পানিতে নেমে পড়ি। একদম প্রথম বোটের সামনে আমি, সঙ্গী সুমন। প্রতিটা বোটের জন্য বরাদ্দ একটা করে বইঠা। বইঠা ঠেলতে ঠেলতে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছিল। বেশ রোমাঞ্চ লাগছিল। পানিতে বইঠার চাপে সামনের দিকে ছুটতে থাকে কায়াক। ভাটির টানে যেতে যেতে আমরা দেখতে থাকি নদীতীরের মানুষের জীবনযাপন। পানিতে হাপুস হুপুস গোসল করছে ছেলেপুলের দল। আরেকটু সামনে যেতেই দেখি জাল থেকে মাছ ধরে খলুইয়ে রাখছে এক জেলে দম্পতি। খেয়াল করলাম, নদীর ঠিক মাঝ বরাবর চলে এসেছি আমরা। আর সেখান থেকে দৃষ্টিসীমায় দৃশ্যমান হয় যে দৃশ্যপট, তা মনোমুগ্ধকর। কিছুটা দূরেই দুই পাড় জুড়ে ঘন অরণ্যের পাহাড়শ্রেণি। নদীর গা–ঘেঁষা সেই পাহাড় পেরিয়ে পেছনে উঁকি দিচ্ছে আরও উঁচু পাহাড়। তারপর আরও উঁচু পাহাড় স্তর।

কাপ্তাই হ্রদে ভেসে ভেসে

গন্তব্য কাপ্তাই হ্রদ

ঘণ্টা খানেক কায়াকিং শেষে পাড়ে আসি। তারপর দুপুরের খাবারের আয়োজন। খাবার খেয়েই গন্তব্য কাপ্তাই হ্রদ।

ঘাটে বাহারি সব নৌকা। দরদাম করে আটজনের জন্য একটা জুতসই নৌকা নিলাম আমরা। এসব নৌকার চালকই গাইড। কাপ্তাই হ্রদের জলরাশিতে আলোড়ন তুলে ছুটে চলল জলযান। দূরে দুটি সাম্পান ভাসতে দেখলাম। আস্তে আস্তে হ্রদের গভীরে যাচ্ছে নৌকা। আর আমরা যেন ক্রমশ প্রবেশ করছি নীলাভ কোনো রাজ্যপাটে! জলরাশির মাঝে সবুজ দ্বীপের মতো জেগে আছে একেকটা টিলা। টিলাগুলোর বেশির ভাগেই জনবসতি নেই। নীল আর সবুজ যেন মিলেমিশে দৃষ্টিতে মুগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দিতে থাকল। মাঝি বলল, ওই দূর পাহাড়ের গহিনে মিজোরাম সীমান্ত। আরও কিছুক্ষণ হ্রদে ভাসার পর মাঝি একটি টিলার পাশে নৌকা ভেড়াল। ওপর থেকে নেমে আসা বাঁধানো ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে বয়সী পাকুড়গাছ। টিলার ওপর বাজার। সবাই নেমে পা বাড়াই সেদিকে।

বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতারা চাকমা। ছোট ছোট দোকান, সাজানো পণ্য ঘিরে ব্যস্ততা। বয়সী কয়েকজন এক জায়গায় জটলা বেঁধে মাতৃভাষায় গল্প জুড়ে দিয়েছে। টিলার ওপর বাজারের শেষ মাথায় অল্পনা চাকমার খাবারের ছোট্ট দোকান। গরম তেলে পিঠা ভাজছিলেন তিনি। নারকেলের টুকরা আর গুড়ের সঙ্গে ময়দার মিশ্রণে বানানো লালচে রঙের সেই পিঠার স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে!

রাঙামাটি সদর উপজেলার মগবান ইউনিয়নে পড়েছে এই বাজার। নাম নতুন বাজার। টিলার অন্য পাশে চাকমাদের পাড়াটার নাম দোখাইয়া পাড়া।

জেনে নিন: কাপ্তাইয়ে বেশ কিছু জায়গায় ক্যাম্পসাইট গড়ে উঠেছে। এসব ক্যাম্পসাইটের পক্ষ থেকে তাঁবুবাসের জন্য বিভিন্ন প্যাকেজ আহ্বান করা হয়। আমরা নিয়েছিলাম ৮৫০ টাকার একটি প্যাকেজ। এই প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত ছিল এক ঘণ্টা কায়াকিং, রাতে বারবিকিউ, সকালের নাশতা আর এক তাঁবুতে দুজন থাকার সুযোগ। বুকিংয়ের আগে ক্যাম্পসাইটের অবস্থান, নিরাপত্তাব্যবস্থা, থাকা-খাওয়ার মান ইত্যাদি জেনে নিন।
কাপ্তাই হ্রদে সন্ধ্যা নামল

রাতে তাঁবুবাস

কাপ্তাই হ্রদ ঘুরে এসে দেখি ক্যাম্পসাইটে তাঁবু পাতা হয়েছে। একটু আগেভাগেই রাতের খাবারের ডাক পড়ল। উদরপূর্তির পর তাঁবুতে ফিরে টের পেলাম হাড় কাঁপানো ঠান্ডা চেপে ধরেছে। মাঘের শীতে কাঁপতে কাঁপতে নদীর পাড়ে বসে কিছুক্ষণ চলল আড্ডা-গল্প। সঙ্গে করে আমরা কিছু ফানুস এনেছিলাম। সেগুলো ওড়াতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হলো। কর্ণফুলী থেকে আসা বাতাসে দেশলাইয়ের কাঠিতে আগুন জ্বালানো যাচ্ছিল না। কয়েকবারের চেষ্টার পর ওড়ানো গেল শেষতক। রঙিন কাপড়ের ভেতর আলোর প্রদীপ জ্বলতে জ্বলতে ওপরে ওঠে যেতে থাকে। ঘাড় পেছনে বাঁকিয়ে একটানা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় তারার ভিড়ে কোনটা ফানুস ঠাহর করতে পারলাম না। রাত বাড়ছে, ক্যাম্পিংয়ে আসা প্রায় সবাই যার যার তাঁবুতে ঢুকে পড়েছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে নদীর অন্য পাশের ঘন বনও যেন ডুবে আছে।

ফানুস ওড়াতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হলো

একজন বন্য প্রাণী–বিশেষজ্ঞের বয়ানে জেনেছিলাম, কাপ্তাইয়ের পাহাড়ি বনভূমিতে বাস করে বিড়াল গোত্রের সুন্দরতম এক সদস্য—মেঘলা চিতা। স্থানীয় বাসিন্দারা যাকে ডাকে লতাবাঘ বা গেছোবাঘ বলে। সারা দিন কোনো গাছের ডালে অলস শুয়ে থেকে নিশ্চয় সময় হয়েছে শিকারের সন্ধানে বের হওয়ার! নদী পাড়ের পাথরের চাতালে থাবার শক্ত নখ গেঁথে কি এই পাড়ের মনুষ্য ক্রিয়াকলাপ দেখতে আসবে! আসুক, আপাতত তাঁবুতে ঢুকে পড়া যাক। বিছানা হিসেবে প্রতিটি তাঁবুর মেঝেতে দেওয়া হয়েছে দুই ফালি করে ককশিট। নিচ থেকে ওঠা ঠান্ডা আটকানোর জন্য যথেষ্ট না হওয়ায় রাফাত তাঁবু থেকে বের হয়ে কোত্থেকে জানি আরও দুই ফালি নিয়ে এল। এবার বিছানাটা মোটামুটি আরামদায়ক হলো। ঝিম ধরে থাকা শীতের রাতে নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে কানে আসছিল তাঁবুর গায়ে আছড়ে পড়া শিশিরের শব্দ। দূর থেকে থেমে থেমে কানে আসছিল একদল শিয়ালের হুক্কাহুয়া। দীর্ঘ যাত্রা আর দিনভর ঘুরে বেড়ানোর ক্লান্তি কখন যেন ঘুম হয়ে নেমে এল।