
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই পৃথিবীর অষ্টম উঁচু পর্বত মানাসলু জয় করেছেন বাবর আলী। ‘ছুটির দিনে’র পাঠকদের সঙ্গে সেই অভিজ্ঞতাই ভাগ করে নিলেন এই এভারেস্টজয়ী।
২০–২৫ ধাপ চড়াই উঠি আর অপেক্ষা করি। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষা। ওই ক্ষণটুকুতে মনে হয় আমার ফুসফুস, শ্বাসনালি আর নাকের দুটি ফুটো ছাড়া আর জগতে কিছুর অস্তিত্ব নেই। হাড়ে হাড়ে টের পাই, বুক ভরে বাতাস নেওয়ার মতো আনন্দের আর কিছুই নেই। কিন্তু জানি, পরের কুড়ি কিংবা পঁচিশ পা ফেলেই আবার থামতে হবে। আর এই কাজ চালিয়ে যেতে হবে চূড়ায় পৌঁছা অবধি। কৃত্রিম অক্সিজেনের অভাবে বায়ুথলি দুটি ওভারটাইম খেটে নিস্তেজ না হয়ে গেলেই হলো! মাঝেমধ্যে জমাট অন্ধকার ভেদ করে হেডল্যাম্পের আলো ফেলে চারপাশ দেখি! ভ্রম হয়, এ কোথায় এলাম!
শুভ্র বরফের প্রাণহীন এই রাজ্যে আসার জন্যই কি তবে এত কষ্ট, এত আয়োজন? বদ্বীপে আমার যাপিত জীবনের সঙ্গে যে এর কোনো মিল নেই! ফের মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ খেলে যায়। একঘেয়েমির দিনগুলোর কথা কে ভাবতে চায়? প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণের ভাষায়, ছাদের আলসের চৌরস একখানা টালি হয়ে অনড় অবস্থায় জীবন কাটাতে তো চাইনি। আমাকে বাঁচিয়ে রাখে তো আকাশে পেরেকের মতো ঝুলে থাকা এই সুবিশাল পর্বতগুলোর স্বপ্ন। ওদের শুভ্র গাত্রই আমাকে এই গহনলোকে পা বাড়াতে বারবার প্রলুব্ধ করে। সেই কবে বান্দরবান গিয়ে অনেক উঁচু থেকে বাকি দুনিয়া দেখেই উচ্চতার প্রেমে পড়া। সেদিন থেকেই যেন চারপাশের দুনিয়া পালটে গেল একটু একটু করে। আর উচ্চতার এই সংস্রব তো খারাপ না। এরা বিপথগামী করে না; ধীরে ধীরে নিয়ে যায় আরও উঁচু কিংবা বৃহৎ কিছুর দিকে।
বিশ্বের অষ্টম উচ্চতম পর্বত মানাসলুর (৮ হাজার ১৬৩ মিটার) গা ধরে আরোহণ করছি। অতি উচ্চতা আর নিম্ন তাপমাত্রার সঙ্গে শরীরকে খাপ খাইয়ে নিতে এই পর্বতের অন্দর-কন্দর বেয়ে আসা-যাওয়া করেছি গত কিছুদিন। এবার মূল পরীক্ষা। এবারের আরোহণটা সংগত কারণেই আমার কাছে কিছুটা হলেও আলাদা। দুনিয়াতে আট হাজার মিটারের (৮ হাজার ১৬৩ মিটার) অধিক উচ্চতার পর্বত আছে সাকল্যে ১৪টি। ইতিমধ্যে এর তিনটি আরোহণ করলেও কৃত্রিম অক্সিজেনবিহীন আরোহণ এই প্রথম। পাতলা বাতাসের এই রাজ্যে পর্বতারোহীদের পরম সঙ্গী কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়া আমার শরীর কেমন করে সেটা জানতে উন্মুখ হয়ে আছি।
২৫ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ৪০ নাগাদ ধড়াচূড়া পরে বেরিয়ে পড়েছি। কথাটা যত সহজে বলা গেল, কাজটা ততটাই কঠিন। এই উচ্চতায় জুতার ফিতা বাঁধা কিংবা ব্যাকপ্যাক থেকে পানি বের করে খাওয়ার মতো মামুলি কাজও কঠিন পরীক্ষায় ফেলে। হিমজব্দ আঙুলে এসব কাজ সারা রীতিমতো বিভীষিকা! অন্যদের চেয়ে আমি মিনিট দশেক আগে বেরোলাম। দলের অন্য সবার সঙ্গেই কৃত্রিম অক্সিজেন আছে। আমার দীর্ঘদিনের পর্বত-সাথি বীরে তামাংয়ের সঙ্গেও তা-ই। কৃত্রিম অক্সিজেনের সাহচর্য না নেওয়ায় আমার গতি অন্যদের চেয়ে কম থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে খুব বেশি পিছিয়ে যাতে না পড়ি, সেদিকে আমার পূর্ণ মনোযোগ। হেডল্যাম্পের বৃত্তাকার আলো পথ দেখাচ্ছে। সামনে যেন বরফের বুনো সাগর। প্রথম দিকের ঢাল খুব বেশি নয়। শক্ত বরফকে ক্র্যাম্পনের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত করে চলা। অবশ্য নতুন পড়া তুষার এসব ক্ষতকে সারিয়ে তোলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই আমার আরেক সঙ্গী তানভীর (আহমেদ) ভাই নাগাল পেয়ে গেল। খানিক পরে বীরেও। তানভীর ভাইয়ের গতি আজ ভালো হওয়ায় উনি এগিয়ে গেলেন। আমি চলছি বীরের সঙ্গে। ক্রিস আর গেসমেনকে দেখা যাচ্ছে অনেক পেছনে। তাদের পেছনে চার নম্বর ক্যাম্পে রীতিমতো কবরের নিস্তব্ধতা।
মিনিট ত্রিশেক এগোতেই ঢাল আরও খাঁড়া হয়ে উঠল। শ্বাসপ্রশ্বাসের মাত্রা বাড়ল আরও। আমার গতি যথেষ্ট ভালো জেনেও মনের মধ্যে সন্দেহ, পর্বতের শীর্ষবিন্দুতে ঠিকঠাক পৌঁছাতে পারব তো? নাকি পাতলা বাতাসের রাজ্যে দূরে দূরে ছড়িয়ে থাকা অক্সিজেন কণারা পালিয়ে পালিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দেবে? নিজের শঙ্কা আর সন্দেহকে সঙ্গী করেই চড়াই ভাঙা; সাদা বরফের এই জঙ্গলে পথ করে নেওয়া। তবে আশার ব্যাপার হলো, আজকে রাতের আবহাওয়া বেশ ভালো। হাওয়ার কামড়টা অনুপস্থিত। তা সত্ত্বেও শরীরে বেশ ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে; অক্সিজেনের অভাবেই মূলত। অক্সিজেন যে এই উচ্চতায় উষ্ণতারও জোগানদার।
শরীরের প্রতিটা কোষেরই লাগে তিনটি প্রয়োজনীয় উপাদান—গ্লুকোজ, পানি আর অক্সিজেন। সত্যি বলতে সামিট পুশের দিন প্রথম দুটোর দিকে নজর দেওয়ার সময় থাকে না খুব একটা। অতি ভালো থার্মোসের পানিও জমে যায় পর্বতের অতীব নিম্ন তাপমাত্রায়। এবার সঙ্গে তৃতীয় লাইফলাইন অক্সিজেনও নেই! বদলে আছে অপরিসীম উৎসাহ, পরিশ্রম করার ক্ষমতা আর গত কয়েক মাসের প্রস্তুতি।
একটা প্রাণান্তকর ঢাল বেয়ে উঠছি। ছন্দপতন হওয়ার শঙ্কায় খুব বেশি থামছিও না। পাহাড়ের কাঁধের মতো অংশ দেখা যাচ্ছে একটা। মাথায় আপাতত ওটাকেই গন্তব্য ঠিক করে রেখেছি। ওখানে গিয়েই জিরিয়ে নেব। সময় বয়ে যাচ্ছে। টানা চড়াই ভেঙে হাঁপ ধরা বুকে পাহাড়ের কাঁধে উঠে আবিষ্কার করলাম চূড়ার একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। গলায় পানি ঢালতেই খানিকটা দূর থেকে তানভীর ভাইয়ের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘আই ডিড ইট, বাবর!’ নিজে চূড়ার এত কাছে জেনেও আনন্দটুকু তানভীর ভাইয়ের জন্যই বেশি হলো। আত্মার শিখর নামেও পরিচিত মানাসলু তাঁর প্রথম আট হাজার মিটার পর্বত চূড়ায় আরোহণ। বোহিমিয়ান আমার তুলনায় তানভীর ভাই পুরোদস্তুর সংসারী মানুষ! করপোরেট জগতের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েও নিজের স্বপ্নের অভিযানের আগে দিনরাত এক করে প্রস্তুতি নিয়েছেন। আলিঙ্গনে বাঁধলাম তাঁকে। চূড়া এখান থেকে আর মিনিট দশেকের পথ। তবে জায়গাটা বিপৎসংকুল। অল্প এই পথটুকুর আকৃতি-প্রকৃতি বোঝা মুশকিল। এই জায়গায় সর্বদা থাকতে হয় সাবধানী আর উৎকর্ণ। মুহূর্তের অসাবধানতা ডেকে আনতে পারে সমূহ বিপদ।
অতীব সাবধানতার সঙ্গে বাকি পথটুকু পাড়ি দিয়ে চূড়ায় উঠে এলাম। একঝটকায় এতক্ষণ মনের মধ্যে দানা বেঁধে থাকা শঙ্কা, সন্দেহ দূর হয়ে গেল! ঘড়িতে তখন ভোর ৪টা ৩৫ মিনিট। চরাচর আঁধারে ঢাকা। হেডল্যাম্পের আলোর বাইরে কিছুই ঠাহর করা যায় না! দ্রুত ব্যাকপ্যাক থেকে জাতীয় পতাকা বের করলাম। লাল-সবুজ পতাকাটা হাতে নেওয়ার উচ্ছ্বাসের সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা হয় না। শৃঙ্গে কিছু ছবি তুলেই বেজক্যাম্পের পথ ধরলাম।