পাহাড়ের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা সড়কে বাইক হাঁকানো এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা
পাহাড়ের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা সড়কে বাইক হাঁকানো এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা

বাইক হাঁকিয়ে গিয়েছিলাম দেশের সবচেয়ে উঁচু পাকা সড়কে

পাহাড়ের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা দেশের সবচেয়ে উঁচু থানচি-আলীকদম সড়কে বাইক হাঁকিয়ে কেমন রোমাঞ্চের সন্ধান মিলল? সেই গল্পই শোনাচ্ছেন তৌফিক হাসান

পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়েতে মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। সন্ধ্যারাতের আকাশ আলোকিত করে মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। রেইনকোট নিয়ে বের হইনি, গায়ে উইন্ডচিটার আছে বলে বৃষ্টি এলে খানিকটা হয়তো রক্ষা হবে। অপেক্ষা করছি আরও চার বাইকারের জন্য। বাইক হাঁকিয়ে আমরা দলবলে যাচ্ছি বান্দরবানের থানচির তমা তুঙ্গীতে। জায়গাটা থেকে নাকি তাজিংডং, কেওক্রাডং আর ডিমপাহাড় দেখা যায়।

একে একে সবাই চলে এল। সাড়ে আটটা নাগাদ আমাদের যাত্রা শুরু হলো। কাঁচপুর পার হওয়ার পরই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। আশ্রয় খুঁজে পেতে পেতে কাকভেজা হয়ে গেলাম। বৃষ্টি থামলে বাইক চালিয়ে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে থামলাম। পেট পুরে খিচুড়ি খাওয়ার পর আবার বাইকের চাকা সচল হলো। ফেনীর মহীপালে এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেতুতে নির্ধারিত বিরতি দিয়ে আমরা কক্সবাজার হাইওয়েতে উঠলাম। পটিয়ার পর ফজরের নামাজের বিরতি নিয়েছিলাম। এর সঙ্গে যোগ হলো বৃষ্টি। তাই আরও খানিকক্ষণ বসে থাকতে হলো। হাঁসের দীঘি নামক স্থানে যখন পৌঁছালাম, তখন সকাল। এখান থেকেই থানচির রাস্তা ধরতে হবে। এরই মধ্যে টিমমেট শাকিল, কাজল ও শুভ বেঁকে বসল। রাতে কয়েকবার মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে, এ অবস্থায় পাহাড়ি রাস্তায় বাইক চালাতে সাহস পাচ্ছে না ওরা। কী আর করা। ওরা কক্সবাজারের পথে চলে গেল আর আমি ও বন্ধু মনির থানচির পথে রওনা হলাম। 

পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে থানচি–আলীকদম সড়ক

সমতল থেকে ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠছি। বৃক্ষরাজি ও পাহাড়ঘেরা ছায়া সুনিবিড় রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে বারবার মনে হচ্ছিল, একটু জিরিয়ে নিই। পথে দুই জায়গায় জাতীয় পরিচয়পত্র এবং জরুরি যোগাযোগের নম্বর দিয়ে এগিয়ে চললাম। আলীকদমের পোয়ামুহুরী সীমান্ত সড়ক চেকপোস্ট–সংলগ্ন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যানটিনে চা পানের পর মিয়ানমার সীমান্তের দিকে যাত্রা শুরু হলো। পোয়ামুহুরী খুব সুন্দর রোড, অবারিত সবুজের মধ্যে সর্পিল পথ সীমান্তে গিয়ে ঠেকেছে। এ পথে দৃষ্টিসীমা খুব বেশি দূর যেতে পারে না, রাস্তার পাশে গাছপালা অনেক। পাহাড়ি পাকা সড়ক মাড়িয়ে আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম এ পথের প্রথম ভিউ পয়েন্টে। চেকপোস্ট থেকে এ পর্যন্ত আসার অনুমতিই মিলেছিল। এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম।

আলীকদমে ফিরে এসে আলীকদম-ডিমপাহাড়-থানচি সড়কে প্রবেশ করলাম। এটি দেশের সর্বোচ্চ উঁচু পাকা সড়ক। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে ওপরে উঠছি আর নামছি। পূর্বাচল বা মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে কিংবা মেরিন ড্রাইভ—যে যা–ই বলুক, আমার দৃষ্টিতে দেশের সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা দিয়ে আমি বাইক চালাচ্ছি। পাহাড়ের ওপর যখন উঠছি, দৃশ্যমান হচ্ছে বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা। কী যে সবুজ, কী যে সুন্দর! আকাশের নীল আর পাহাড়ের সবুজের এক আশ্চর্য মেলবন্ধন। বেশ কয়েকটা উঁচু পাহাড় ডিঙিয়ে ১০ কিলোমিটার নামক ভিউ পয়েন্টে বাইক দাঁড় করিয়ে খানিকক্ষণ পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। জায়গাগুলোর প্রতিটি স্টপেজের নাম কিলোমিটার অনুযায়ী। যেমন পরেরবার আমরা থামলাম ১৩ কিলোমিটার নামক জায়গায়।

থানচি-আলীকদম সড়ক

পরবর্তী গন্তব্য ডিমপাহাড়। বাইক নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা যায় না। তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে চূড়াসমেত কিছু ছবি তুলে নিলাম। যাত্রা শুরুর পর পাহাড়ের নিচের দিকে পড়ল থানচি। ওপর থেকে দেখতে কী যে সুন্দর লাগছিল! আরেকটু এগোতেই সেনা চেকপোস্টে নিরাপত্তার আনুষ্ঠানিকতার জন্য আবারও দাঁড়াতে হলো। দেখি, বেশ কিছু বাইকার ও স্থানীয় লোকজন আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছেন। আমাদের দেখে সেনাসদস্যরা খানিকটা অবাক। সাইডলাইনে বসে শুনতে পেলাম, তাঁরা আমাদের বয়স নিয়ে আলোচনা করছেন।

মনিরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমাদের ৫০ ছুঁই ছুঁই বয়সে কি বেশি বুড়ো দেখায়?’

মনির বলল, ‘না তো।’ 

এই বয়সে বাইক নিয়ে এত দূরের পথে আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, এক সেনাসদস্য জিজ্ঞাসাও করলেন।

বললাম, ‘না!’

চেকপোস্টের পর আমাদের খাড়া নামতে হবে। বেশ খানিকটা পথ, একটা বিপজ্জনক টার্নও আছে। সাবধানে বাইক চালাতে হবে। বাইকটি ইঞ্জিন ব্রেকে রেখে ব্রেক অলটারনেট করে সাবধানে চালিয়ে থানচি ব্রিজে এসে দাঁড়ালাম। অনেক বছর আগে একবার এসেছিলাম, তখন এই ব্রিজ ছিল না। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সাঙ্গু নদের সৌন্দর্য খানিকক্ষণ উপভোগ করে সোজা চলে গেলাম তমা তুঙ্গী পর্যটনকেন্দ্রে। 

বাইক হাঁকিয়ে দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়কে

জায়গাটা কৃত্রিমভাবে সাজানো হলেও বেশ সুন্দর। দুই পাহাড়ের ওপর দুটি ভিউ পয়েন্ট, মাঝখান দিয়ে রাস্তা। পর্যটকদের বসার জন্য কাঠ ও কংক্রিটের বেঞ্চের ব্যবস্থা। ভিউ পয়েন্ট থেকে তাজিংডং, কেওক্রাডং আর ডিমপাহাড় দেখা যায়। পাহাড়গুলো পেছনে রেখে ছবি তোলার জন্য তিনটি সুন্দর ইমারত তৈরি করা আছে এবং এগুলোর গায়ে পেছনে কোন পাহাড় দেখা যাচ্ছে, সেটাও লেখা আছে। এখানে বসে শুধু পাহাড় নয়, মেঘমালার খেলা খুব কাছ থেকে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে মেঘ ছুঁয়ে দেখাও সম্ভব। ভিউ পয়েন্ট ২ থেকে সবুজে ঘেরা বিস্তীর্ণ পাহাড়সারি দেখা যায়। সেই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে একটা আঁকাবাঁকা রাস্তা সরাসরি বাকলাইয়ের দিকে চলে গেছে। ভিউ পয়েন্টে ২–এ একটা বড় গাছ না কেটে সংরক্ষণ করা হয়েছে দেখে ভালো লাগল। সুইমিংপুল–সদৃশ একটি জলাধার বানানো আছে দেখলাম। গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো আসনে বসে মেঘের খেলা দেখতে দেখতে চারদিকের আলো কমে এল। খানিকটা ক্লান্তিও বোধ হলো। গত রাত থেকে বাইক চালাচ্ছি, শরীরটাকে এবার একটু বিশ্রাম দিতে হবে। নামতে হবে নিচের দিকে, থানচি বাজারে রাতে থাকার জন্য একটা আশ্রয় খুঁজতে হবে…