মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কবছর ধরে বই আকারে প্রকাশ করছে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী–ভাষ্য’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই উদ্যোগ। জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে একাত্তরের স্মৃতি লিখিতভাবে পাঠায়। ফলে এই কর্মসূচি এক অর্থে বিনিময়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস এবং শিক্ষার্থীরা জোগান দিচ্ছে ইতিহাসের নতুন উপাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠানো এসব ভাষ্য থেকে বাছাই ৩১টি কাহিনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রকাশ করছে প্রথম আলো।
সংগ্রহকারী: তুহিন মিয়া, দশম শ্রেণি, এম এ বারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, চুয়াডাঙ্গা
বর্ণনাকারী: মো. আবু সালেহ, বেলগাছি, চুয়াডাঙ্গা
পারিবারিক চাষাবাদ দেখাশোনা করার জন্য লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলাম না। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম শুধু দেশকে স্বাধীন করার জন্য।
কৃষ্ণনগরের চাপড়ায় ছিল আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। আমাদের ছিল দুটি গ্রুপ, একটার নেতৃত্বে মন্টু, অন্যটার কমান্ডার হাফিজ। মুন্সিগঞ্জে অপারেশনের জন্য ৭ নভেম্বর আমরা ক্যাম্প থেকে রওনা হই। হাফিজ ভাই অসুস্থ থাকার কারণে সেদিন আমাদের গ্রুপের নেতা ছিলেন বিলা ভাই।
আগে মুন্সিগঞ্জের দুই রাজাকার সিদ্দিক মিয়া ও আবুল মিয়াকে মারার জন্য অপারেশন চালানো হলেও সফল হয়নি। তারা তাদের গ্রামে নির্মম অত্যাচার চালায় এবং কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রামে প্রবেশ করতে দেয়নি।
সেদিন আমাদের গ্রুপে ২৪ জন ছিলাম। ৭ নভেম্বর ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে কিছুদিন পর গড়চাপড়া গ্রামে পৌঁছালাম। রাতে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে জানতে পারলাম, এর আগের অপারেশনগুলো রাতে করা হয়েছে, তাই এবার দিনে অপারেশন করা হবে।
দুপুরবেলা বৃষ্টি নামল। আমরা নিজ নিজ রাইফেল পলিথিনে মুড়িয়ে দৌড়ে মুন্সিগঞ্জ বাজারের তেমাথায় পৌঁছালাম। মন্টুর গ্রুপ ওদিক থেকে হামলা করবে আর আমরা এদিক থেকে।
মন্টুর গ্রুপ রেলস্টেশনের পশ্চিম পাশের হাইস্কুলের পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটিতে হামলা চালাল। সঙ্গে সঙ্গে রাজাকাররা এদিকে ছুটে আসতে লাগল। আমরা সুযোগ বুঝে গুলি চালালাম। তারা অস্ত্র ফেলে পালাল। পরে জানতে পারলাম, সিদ্দিক মারা গেছে।
এবার অপারেশন চালালাম আবুল মিয়ার বাড়ি। সে একটা পাকা ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। তাকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বললাম। সে বেরিয়ে না এসে দরজার ফাঁক দিয়ে গুলি ছুড়তে লাগল। অল্পের জন্য মন্টু প্রাণে বেঁচে গেল।
তখন মন্টু রাইফেলের বাঁট দিয়ে জানালা ভেঙে ঘরের ভেতর একটা পিন খোলা গ্রেনেড ছুড়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে। আবুল মারাত্মকভাবে আহত হয়। তারপর সে মারা যায়। ঘরের মধ্যেই পাঁচটা ছোট ছেলেমেয়ে ছিল, যারা সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল।
আমরা সেদিন সন্ধ্যায় পোলতাডাঙ্গা গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে থাকলাম। রাত ১১টার দিকে খবর এল, হানাদার বাহিনী পালানোর সময় তাদের সব অস্ত্রশস্ত্র ফেলে রেখে গেছে। কিন্তু আমরা কিছুই আনতে পারিনি বলে আফসোস হচ্ছিল।
ওই এলাকায় পথঘাট চেনার জন্য কিছু স্থানীয় লোক নিয়ে নতিডাঙ্গার ঘাট পার হয়ে নৌকা ডুবিয়ে দিলাম। আমি সেদিন খুব অসুস্থ ছিলাম। সকালে খেয়েও আসিনি।
সিদ্দিক মিয়া ও আবুল মিয়ার মৃত্যু এবং পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি পাকিস্তানি সেনারা। তারা খেপে যায়। ১০ নভেম্বর মন্টু আমাদের বলল, পাকিস্তানি বাহিনী অনুপনগরের দিকে আসছে।
আমরা ভাবলাম, এখন যদি আমরা পালিয়ে যাই তবে পরে আর এই গ্রামের লোক আমাদের আশ্রয় দেবে না। তাই তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। পাকিস্তানি বাহিনী আসছে পোলতাডাঙ্গা পুড়িয়ে দিতে। আমরা ভাবলাম, ওদের ওপর হামলা চালিয়ে সরে পড়ব।
ওই এলাকায় পথঘাট চেনার জন্য কিছু স্থানীয় লোক নিয়ে নতিডাঙ্গার ঘাট পার হয়ে নৌকা ডুবিয়ে দিলাম। আমি সেদিন খুব অসুস্থ ছিলাম। সকালে খেয়েও আসিনি।
আমরা জানতে পারলাম, পাকিস্তানি সেনারা অনুপনগর ঘাট পার হয়ে চলে এসেছে। মন্টুকে বলা হলো, তুমি সাবধানে ঘাটের কাছে গিয়ে গ্রেনেড চার্জ করো। সে ছিল খুবই সাহসী। সেদিন গ্রুপের ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন অসুস্থ।
তাই ১৮ জন অপারেশনে ছিলাম। আশা সানোয়ার, এবাদুল, খায়রুল, লাল্টু আর সেদিনের গ্রুপ লিডার বিল্লা ভাই। সবার কথা এত দিনে আর মনেও নেই।
মন্টু এর মধ্যে ঘাটের কাছাকাছি গিয়ে গ্রেনেড চার্জ শুরু করল। পাকিস্তানি সেনা এলোমেলো হয়ে গেল। তারা পাশের আখখেতে আশ্রয় নিল। আর কিছু পাকিস্তানি গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমরা ফায়ার শুরু করলে নদীর ওপার থেকে পাকিস্তানি সেনা আমাদের ওপর গুলি করতে শুরু করল।
তখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হলো, পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আমরা দুই দিক থেকে ব্রাশফায়ার করতে লাগলাম আর পিছু হটতে লাগলাম। পাকিস্তানি সেনারা অনবরত গুলিবর্ষণ করছিল।
আমরা গুলি করি আর ১০-২০ গজ করে গড়িয়ে সরতে থাকি। এর মধ্যে কখন যে আমার পায়ে একটা গুলি লেগেছে, বুঝতেই পারিনি। পরে দেখি, পা বেয়ে রক্ত পড়ছে।
দেখতে পাচ্ছি, পাকিস্তানি সেনারা এগিয়ে আসছে। একটু উঁচু হয়ে তাদের লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করছি আর সরে আসছি। এভাবে একবার উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পায়ের শিরা বেরিয়ে গেল; হুঁশ হারিয়ে ফেললাম। একটু পর হুঁশ ফিরলে বিল্লা ভাই বলল, ‘ভয় নেই, তুই গড়িয়ে গড়িয়ে সরে আয়।’
আমার একটা চাদর ছিল, বেয়নেট দিয়ে সেটা ছিঁড়ে পায়ের ক্ষতস্থান বেঁধে ফেললাম। পরে শুনেছি, এলোপাতাড়ি গুলিতে ১১ পাকিস্তানি সেনা মারা গেছে। শেষমেশ ওরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
তারপর খবর পেয়েছিলাম আলমডাঙ্গার দিক থেকে পাকিস্তানি সেনারা এসে আমাদের ঘিরে ফেলবে। কিন্তু এ খবর সত্যি ছিল না। আহত অবস্থায় হাঁটার শক্তি ছিল না।
নদীর কাছাকাছি এসে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। বন্দরভিটা গ্রামে এসে জ্ঞান ফিরে দেখি আমার পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধতেছে। এই দিন শুধু আমিই আহত হয়েছিলাম।