
নিয়মটা সোজা। ব্যাচে সর্বোচ্চ সিজিপিএ যাঁর, সে-ই পাবে আচার্য স্বর্ণপদক। কিন্তু দুজনের সিজিপিএ যদি এক হয়, এমনকি দুজনেরই ৪-এ ৪, তখন উপায়? বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কর্তৃপক্ষ বোধ হয় এমনই ‘মধুর সমস্যায়’ পড়তে যাচ্ছে।
টানা আট সেমিস্টারে সর্বোচ্চ ফল ধরে রেখে ৪-এ ৪ পাওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়। সেটাই করে দেখিয়েছেন বুয়েটের ২০১৮ শিক্ষাবর্ষের দুজন—আহমদ মাহির সুলতান (রুমী) ও তানযীম আজওয়াদ জামান। দুজনে ভালো বন্ধুও বটে। নটর ডেম কলেজে একসঙ্গে পড়েছেন। পরে স্নাতক করেছেন বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগ থেকে। তাঁরা বলছেন, বুয়েটের ইতিহাসে এমন ঘটনা এবারই প্রথম। অর্থাৎ একই ব্যাচের একই বিভাগের দুই শিক্ষার্থী একসঙ্গে সর্বোচ্চ সিজিপিএ পেয়েছেন, এমন আগে ঘটেনি। যেহেতু সমাবর্তনের সময় আসেনি, তাই আচার্য পদক শেষ পর্যন্ত কে পাবেন, এখনো তা অজানা।
মাহির এখন বুয়েটের সিএসই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যুক্ত আছেন। বুয়েটে খণ্ডকালীন (অ্যাডজাংকট) প্রভাষক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কাজ করেছেন তানযীম। অবশ্য কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে শিগগিরই তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ধরতে হবে।
একটি কোর্সে ৪ ফসকে গেলেই এমন ফল আর দেখা হতো না। কীভাবে পুরো চার বছর মনোযোগ ধরে রেখেছিলেন? মাহির বলেন, ‘সব সময় পড়াশোনাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই অনেক কিছু ত্যাগও করতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভালো ফলের জন্য কৌশল অনুযায়ী পড়া অনেক জরুরি। একটি কোর্সের বিষয় কী, শিক্ষক কে ও বিগত বছরের প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারতাম, কোন দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। পাশাপাশি প্রতিটা পরীক্ষাই সমান গুরুত্বসহ দিয়েছি।’
তানযীমের বক্তব্য, ‘নিয়মিত পড়াশোনা করে চেষ্টা করতাম ক্লাস টেস্টে পূর্ণ নম্বর রাখতে। ফলে টার্ম ফাইনালের ওপর চাপ কম পড়ত। দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা নিয়মিত পড়াশোনাই আমার কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছে। ঘাটতি রাখিনি প্রস্তুতিতে। এ ছাড়া মানসিকভাবে উজ্জীবিত থাকতে খেলাধুলা করেছি।’
দুজনের স্কুল ছিল ভিন্ন। উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়েছেন একজন, অন্যজন সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে। ছোটবেলা থেকেই মাহিরকে টানত জ্যোতির্বিদ্যা ও পদার্থবিজ্ঞান। হতে চাইতেন বিজ্ঞানী। অন্যদিকে তানযীমের পছন্দের বিষয় ছিল গণিত। গণিত ঘিরে একটি ঘটনাকে জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলে মানেন তিনি। বলছিলেন, ‘তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। গণিত অলিম্পিয়াডে জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় স্থান (সজল-কাজল পুরস্কার) অধিকার করায় জাতীয় প্রাইমারি ক্যাম্পে ডাক পাই। ওই সময় ক্যাম্পে গেলে স্কুলের নিয়মিত পরীক্ষা মিস হতো। তাই ক্যাম্পে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তবে আমাদের স্কুলের তৎকালীন অধ্যক্ষ ব্রাদার লিওকে অলিম্পিয়াড কমিটির চিঠিটা পৌঁছে দিই। প্রথমে স্নেহপূর্ণ ভর্ৎসনা করলেও পরে উৎসাহ দিয়ে স্যার বলেছিলেন, “প্রয়োজনে আলাদা প্রশ্ন করে আমার রুমে তোমার পরীক্ষা নেব, কিন্তু ক্যাম্পে শুধু তোমার জন্য নয়, স্কুলের জন্যও তোমাকে যেতেই হবে।”’এভাবেই গণিতের প্রতি তানযীমের আগ্রহ ও ভালোবাসা আরও বাড়ে।
শুধু পড়াশোনা নয়, কলেজজীবনে বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন তাঁরা। মাহির নটর ডেম কলেজের লেখক কুঞ্জের প্রেসিডেন্ট এবং ঢাক-ঢোল ত্রৈমাসিকের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তানযীম স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল দলের প্রতিনিধি ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আন্তহল ফুটবল ও অ্যাথলেটিকসে পরপর দুই বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। অংশ নিয়েছেন জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে। কলেজে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ম্যাথ ক্লাব, সেই সুবাদে ক্লাবের আজীবন সদস্য সম্মাননাও পেয়েছেন।
দুজনই ভায়োলিন বাজাতে ভালোবাসেন। মাহির বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি এসব না করলে শেখাটাই পরিপূর্ণ হয় না। পাশাপাশি নেটওয়ার্কিং বাড়াতেও সাহায্য করে। এসব খুবই দরকারি।’
নটর ডেম কলেজে বন্ধুত্বটা হয়েছিল মূলত দ্বিতীয় বর্ষে। নতুন ব্যাচের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দিয়েছিলেন মাহির ও তানযীম। নির্বাচনী পরীক্ষার পর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সম্পর্কটা জোরালো হলেও দুজনের মধ্যে হৃদ্যতা বাড়ে বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর। বন্ধুত্বের সেরা মুহূর্ত হিসেবে দুজনই সিএসই বিভাগ আয়োজিত উৎসবের (সিএসই ফেস্ট) কথা উল্লেখ করেন। ফেস্টগুলোয় ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন তাঁরা। মিলনায়তনভর্তি শ্রোতার সামনে ভায়োলিন বাজিয়েছিলেন। এ ছাড়া এক ফেস্টে দুই দিন হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর প্রথম ও দ্বিতীয় হওয়াটাও দুই বন্ধুর জন্য স্মরণীয়।
মাহির বলেন, ‘বন্ধুত্বের কারণেই আমাদের মধ্যে ভালো প্রতিযোগিতা ছিল। তবে দুজনই একে অপরকে সাহায্য করতাম। আমাদের বিভাগের সবার মধ্যেই এই গুণ ছিল।’
দুই তরুণ মনে করেন, তাঁদের গড়ে ওঠার পেছনে নটর ডেম কলেজের বিশেষ ভূমিকা আছে। বিশেষ করে শেখার কৌশল ও অনুপ্রেরণা জোগানোর ক্ষেত্রে। তানযীম আজওয়াদ জামান একটি অভিজ্ঞতা শোনালেন, ‘গণিতের শিক্ষক রেজা (রেজাউল করিম) স্যারের ক্লাস আমি নিয়মিত মনোযোগ দিয়েই করতাম। তবে চুপচাপ থাকতাম। একদিন ক্লাসের কাজ করার পর স্যার বলেছিলেন, “মাই বয়, আমি খেয়াল করেছি, তুমি পেছনে বসে নীরবে নিয়মিত ক্লাস করো। নিয়মিত এভাবে কাজ করে গেলে প্রতিদান অবশ্যই পাওয়া যায়।”এই ছোটখাটো বিষয়গুলোই আসলে হাজারো শিক্ষার্থীকে উদ্বুদ্ধ করে।’
নটর ডেমের সেরা শিক্ষার্থী বলে কথা! তাই দুই বন্ধুর বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করার চাপও ছিল। এসব চিন্তা মাথায় না নিয়ে নিজেদের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মাহির-তানযীম। ভালো করতে হলে সব সময় পড়তে হবে বা ক্লাসের সবার থেকে অনেকে এগিয়ে থাকতে হবে, এমনটা মনে করেন না দুই টপার। তাঁদের বক্তব্য, ক্লাসের নিয়মিত গতিতে এগোলেই চলে। তবে পড়ার বিষয়টা বুঝতে হবে গভীরভাবে।
সমস্যা সমাধান, প্রোগ্রামিং, গণিত ইত্যাদির প্রতি আগ্রহ ও ভালোবাসাই তাঁদের কম্পিউটার প্রকৌশলে ভালো করতে সাহায্য করেছে। তাই নতুনদেরও পছন্দের বিষয় বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিলেন দুই তরুণ শিক্ষক।
ভবিষ্যতে তাঁরা দুজনই ‘একাডেমিক দুনিয়া’য় থাকতে চান। যুক্ত থাকতে চান গবেষণায়।
এ দুজনের থিসিস সুপারভাইজার ছিলেন অধ্যাপক মো. সামসুজ্জোহা বায়েজীদ। তিনি বলেন, ‘যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই এ ফলাফল করা কঠিন। বুয়েটের সিএসইর মান বিবেচনায় আট টার্মে এটা ধরে রাখা খুবই কঠিন। ৪-এ ৪ পাওয়ার ঘটনাই বিরল। সেখানে ওরা দুজন একসঙ্গে পেয়েছে। মেধাবী তো বটেই, কিন্তু একদম প্রথম থেকেই খেয়াল করেছি, ওরা নিজেদের কাজের প্রতি আন্তরিক ও কঠোর পরিশ্রমী। গবেষণার ক্ষেত্রেও ওরা অনেক ভালো কাজ করছে।’