
মিরপুর স্টেডিয়ামের সামনে দিয়ে ১০ নম্বর হয়ে অফিসে যাওয়া-আসা করি। পাঁচ-ছয় বছর আগে ছুটির দিনগুলোয় দেখতাম স্টেডিয়াম ও সুইমিংপুলের সামনে ভাঙাচোরা বাস সারাই হচ্ছে। বাসের গায়ে রং ও পুটিং মারা হচ্ছে। সিরিশ ঘষা হচ্ছে। বাসের নাম লেখা হচ্ছে। একদিন অফিস থেকে ফিরছি। একদল রংমিস্ত্রি কাজ করছেন।
প্রত্যেকের মাথায় গামছা বাঁধা। সারা মুখে ও কাপড়ে রং। তাঁদের দেখে আলাদা করে চেনা সম্ভব নয়। একজন দেখি কোমরে হাত দিয়ে আমাকে দেখছেন। একসময় এগিয়ে এসে বললেন, ‘আপনি পত্রিকায় ছবি আঁকেন না? কান্দের ব্যাগটা তো আগের মতোই আছে। আমি রথখোলার শিল্পী আর্টের আসলাম। মনে পড়ছে?’
মনে পড়ে গেল। ১৯৭৮-৭৯–এর সেই সময়টায় আমি চারুকলায় পড়তাম। পাশাপাশি দৈনিক সংবাদ-এর শিশুবিষয়ক ক্রোড়পত্র ‘খেলাঘর’-এর গল্প, কবিতার ছবি আঁকতাম। মঙ্গলবার ‘খেলাঘর’ বের হতো। আগের দিন মেকআপ-পেস্টিং করতাম। কাজ শেষ করে বেরোতে বেরোতে রাত ১০টা বেজে যেত।
সেসব রাতে স্কেচ করতে সদরঘাট যেতাম। বংশাল রোডে নিশাত সিনেমা হলের উল্টো দিকে ছিল সংবাদ। অফিস থেকে বেরিয়ে নবাবপুর রোড দিয়ে কিছু দূর গেলে রথখোলা মোড়। পূর্ব দিকে সোজা টিপু সুলতান রোড। ডান পাশে দুধের আড়ত।
দুধ-পচা একটা গন্ধ নাকে আসত। দক্ষিণ পাশ দিয়ে পশ্চিম দিকে একটা সরু রাস্তা কান্দুপট্টির দিকে গেছে। রাস্তার দুই পাশে চড়া সাজে দাঁড়িয়ে থাকত মেয়েরা। আড়তে ঢুকে ডান পাশে তিনতলা সমান উঁচু স্টুডিও ‘শিল্পী আর্ট’। এখানে কাজ করত সাত-আটজন তরুণ ব্যানারশিল্পী। এর মধ্যে রত্না ও আসলাম ভালো আঁকত। দুজনেই বিহারি সম্প্রদায়ের মানুষ।
ঢাকায় তখন সিনেমার ব্যানার তৈরির ১০-১২টি স্টুডিও ছিল। ঝন্টু আর্ট, শিল্পী আর্ট, রূপায়ণ আর্ট, চিত্রপুরী, মায়া আর্ট—কত বাহারি নাম। এগুলোর বেশির ভাগই ছিল ঠাঁটারীবাজার, ওয়ারীর বনগ্রাম, শাঁখারীবাজার, সিদ্দিক বাজার, বেগম বাজারে।
শাঁখারীবাজারের সিতেশ সুর বলে একটি ছেলে খুব ভালো কাজ করত। পরে সে শাঁখারীবাজারে স্টুডিও করেছিল। আশির দশকের শুরুর দিকে গিরিনবাবু ছিলেন এখানকার প্রধান শিল্পী। পরে তিনি সিদ্দিকবাজার রূপায়ণ আর্টে চলে যান। রূপায়ণ আর্টের মালিক ছিলেন সিনেমা প্রযোজক সুভাষ চক্রবর্তী।
তখন ফোক-ফ্যান্টাসি সিনেমার জয়জয়কার। ইবনে মিজান, এফ কবীর চৌধুরী, ফয়েজ চৌধুরী, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুরা এসব সিনেমা বানাতেন। পাতালপুরীর রাজকন্যা, মালকা বানু, বেদের মেয়ে জোস্না—এসব সিনেমার ব্যানার, পোস্টার তৈরিতে শিল্পী আর্ট, রূপায়ণ আর্ট ছিল সেরা। পাকিস্তানের লাহোরের মানুষ দুলারা লাডলা ছিলেন ব্যানার আর্টিস্টদের মধ্যে অন্যতম শিল্পী। গিরিনদার ওস্তাদ ছিলেন তিনি। বোম্বে গিয়ে কাজ শিখেছিলেন। তাঁর শিষ্যরা পরবর্তীকালে ব্যানারশিল্পের নামকরা শিল্পী হয়েছেন।
গিরিনদার আঁকা দেখার জন্য মাঝেমধ্যেই রথখোলায় তাঁর স্টুডিওতে যেতাম। রাতের পর রাত স্টুডিওতে গিয়েছি। অনেক রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি। কোনো দিন আমাকে বসতে বলেননি। বিশাল হার্ডবোর্ডের কাটআউটে রাজ্জাক-কবরী আঁকাতেন। গিরিনদার চার-পাঁচজন সহকারী ছিলেন। তাঁর নির্দেশমতো আগেই ছবিগুলোর ৬০-৭০ ভাগ এঁকে রাখতেন। টুলের ওপর দাঁড়িয়ে গিরিনদা ছবিগুলোর ফিনিশিং কাজ করতেন। নিচ থেকে সহকারীরা রংতুলি, চা-সিগারেট এগিয়ে দিতেন।
গিরিনদার বাঁ হাতের আঙুলে থাকত তিনটা হকিয়ার ব্রাশ। ডান হাতে ঝড়ের গতিতে চলত ব্রাশ। কখনো কখনো দেখেছি নায়িকার মুখ ছয়-সাত ফুট লম্বা। শুধু লাল-গোলাপি রং দিয়ে আঁকা। ঝড়ের পাখি বলে একটি সিনেমার ব্যানারে নায়ক রাজ্জাকের কাউবয় হ্যাট পরা শুধু মুখের ছবিটা ১০ ফুট সমান উঁচু ছিল। শুধু গ্রিন রঙে আঁকা হয়েছিল। এত বড় একটা মুখ আঁকতে দক্ষতা লাগে। সেটা গিরিনদার মধ্যে দেখেছি।
ছবিটা লাগানো হয়েছিল গুলিস্তান সিনেমা হলে। মতিঝিল ডিআইটি ভবনের সামনে থেকে রাজ্জাককে পরিষ্কার দেখা যেত। বৃহস্পতিবার রাত ১১টার পর ব্যানার, কাটআউট সিনেমা হলের সামনে ওপরের দিকে লাগানো হতো। রিকশাওয়ালারা সেটা দেখার জন্য গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে ভিড় করত।
মার্কিন থান কাপড় দিয়ে তৈরি হতো এসব ব্যানার। অফসাইডের সঙ্গে আইকা গাম বা সিরিশ মিশিয়ে কোটিং মেরে তার ওপর ছবি আঁকা হতো। গ্রাফ করে ছবি আঁকা হতো। এ কাজ করতেন জুনিয়র শিল্পীরা। আরেকটু সিনিয়ররা রং চাপাতেন গ্রাফ করা ছবির ওপর। অফসাইড রঙের সঙ্গে পাওয়ার পাউডার ও প্রেসের কালি মিশিয়ে আঁকা হতো ব্যানার ছবি। চারপাশে থাকত কাঠের শক্ত ফ্রেম।
সত্তর ও আশির দশকে দুই রকমভাবে পোস্টার ডিজাইন হতো সাদা-কালো ছবির ওপর ফুজি ট্রান্সপারেন্সি কালার দিয়ে। আরেকটা হাতে এঁকে। হাতে আঁকা পোস্টার ভালো করতেন গুলফাম, দুলারা লাডলা ও গিরিনবাবু।
নব্বই দশকে এসে ঢাকার সিনেমার রমরমা ভাবটা চলে যায়। ব্যানার আর্টিস্টদের দিন খারাপ হতে থাকে। অনেক স্টুডিও বন্ধ হয়ে যায়। পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা ও স্বপন সাহা আশির দশকের মাঝামাঝি সময় কলকাতা চলে যান। সেখানে সত্তর ও আশির দশকের ঢাকার সিনেমাগুলো রিমেক করতে শুরু করেন (যেমন বেদের মেয়ে জোস্না, সাত ভাই চম্পা)। ঢাকার শিল্পীরা সেখানে কাজ করছিলেন।
ছবিগুলো খুব চলেছিল। ঢাকার নায়ক রাজ্জাকও সেখানে অভিনয় করেছিলেন। গিরিনদাকে ঢাকা থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন নারায়ণ ঘোষ মিতা। কয়েক বছর সেখানে ভালোই কাজ করছিলেন। পরে সেখানে ব্যানার আঁকা বন্ধ হয়ে যায়। গিরিনদা অসুস্থ হয়ে মেয়ের বাড়িতে ছিলেন। সেখানেই মারা গেছেন।