
মকবুলার রহমান সরকারি কলেজের মূল ফটক পার হয়ে একটু এগোলেই বাঁ দিকে নামফলক। ডানে শহীদ মিনার। আর সোজা এগোলে প্রশাসনিক ভবন। চাইলে সরু পাকা সড়কটা ধরে এখান থেকেই পুরো ক্যাম্পাসটা একচক্কর ঘুরে দেখতে পারেন। খোলা মাঠটার চারদিকে সবুজ গাছ, উচ্ছল শিক্ষার্থীদের উদ্দীপ্ত চোখ-মুখ মন ভালো করে দেবে। উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পাঠদানের জন্য পঞ্চগড় অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির বেশ সুনাম আছে।
বিজ্ঞান ভবনের সামনের বটগাছটি কলেজের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। নবীনবরণ, বর্ষবরণ, পিঠা উৎসব—এই গাছকে ঘিরেই হয় নানা আয়োজন। এ ছাড়া কাঁঠালতলা, লিচুতলাসহ বেশ কিছু জায়গা শিক্ষার্থীদের প্রিয়। জায়গাগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা হলো। জানলাম, ২০২৪ সালে কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ৫৬৯ জন শিক্ষার্থী। পাস করেছেন ৪৮৬ জন। তার মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১২৪ জন।
আর ২০২৩–এ এইচএসসি পরীক্ষায় মোট ৫২৯ জন অংশ নিয়ে পাস করেছিলেন ৪২১ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ৫৩ জন। ওই বছর উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ জনসহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৫০ জন ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন। এ ছাড়া ডেন্টালে ৩ জন আর বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন একজন। এ বছরও উচ্চমাধ্যমিক পেরোনোরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন পুরোদমে। এবার আরও ভালো ফল আসবে, নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরও বেশি অ্যালামনাই জায়গা করে নেবে, এমনটাই আশা করছেন কলেজ–সংশ্লিষ্টরা।
১৯৬৫ সালে স্থানীয় কয়েকজন শিক্ষানুরাগীকে নিয়ে এই বিদ্যাপীঠটি স্থাপন করেন শিল্পপতি মকবুলার রহমান। শহরের ডোকরোপাড়া এলাকায় ৯ দশমিক ১৬ একর জমিতে গড়ে ওঠে মকবুলার রহমান কলেজ। ১৯৮৩ সালের ১ মে কলেজটি জাতীয়করণ হয়। ১৯৭০ সালে পাস কোর্স, আর ১৯৯৮-৯৯ সালে ছয়টি বিষয়ে চালু হয় স্নাতক (সম্মান)। স্নাতকোত্তর চালু হয় ২০১৩ সাল থেকে।
কলেজে বর্তমানে শিক্ষার্থী আছেন ৭ হাজার ১৬৮ জন। ৮০ আসনের একটি ছাত্র হোস্টেল ও ১০০ আসনের একটি ছাত্রী হোস্টেলও আছে। পুরোনো প্রশাসনিক ভবনে আছে একটি গ্রন্থাগার। ৪৫ জন শিক্ষকের পদ থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন ৩১ জন। পড়ালেখার পাশাপাশি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা, সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্যও এই কলেজ শিক্ষার্থীদের সুনাম আছে। এখানে এখন ৯টি বিষয়ে অনার্স, ছয়টি বিষয়ে মাস্টার্স, বিএ (পাস কোর্স), বিএসসি ও এইচএসসি চালু আছে।
প্রায় পাঁচ যুগের পুরোনো এই শিক্ষাঙ্গনের অ্যালামনাইরা বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন। কলেজের এইচএসসি ১৯৮৫ ব্যাচে ছিলেন দেলওয়ার হোসেন প্রধান। বর্তমানে তিনি দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সচিব। মকবুলার রহমান সরকারি কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেছেন। বলছিলেন, ‘নিজের কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হয়েছে। ২০১৫ সালে কলেজের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমরা একটা পুনর্মিলনী করেছিলাম। সেখানে সবাইকে এক সঙ্গে পেয়ে এত ভালো লেগেছিল! আমাদের কলেজের বহু ছাত্র এখন ভালো অবস্থানে আছেন। এই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিচারপতি, পুলিশের ডিআইজি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রশাসনের কর্মকর্তা, সংসদ সদস্য, ব্যাংকারসহ অনেকেই আছেন।’
মকবুলার রহমান সরকারি কলেজ থেকে ২০০৩ সালে এইচএসসি পাস করেছিলেন আল ইমরান রাসেল। ৩৬তম বিসিএসে (শিক্ষা) উত্তীর্ণ হয়ে এখন তিনি পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক। তিনি বলেন, ‘কলেজজীবনের সেই দিনগুলো এখনো মনে পড়ে। শিক্ষকেরা অনেক আন্তরিকতা নিয়ে আমাদের পড়াতেন। সেই শিক্ষকদের কথা মনে রেখেই নিজেও এখন আন্তরিকতার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর চেষ্টা করি। এই কলেজ থেকে বের হয়ে যাঁরা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের অনুসরণ করে অনুজেরাও আগামী দিনে এগিয়ে যাবেন বলে আশা রাখি।’
কলেজের সুনাম আরও ছড়িয়ে পড়ুক—বর্তমান শিক্ষার্থীদেরও এমনটাই চাওয়া। হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র রনি রায়হান বললেন, ‘বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ না পাওয়ায় কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল। তবে এখানে ভর্তি হওয়ার পর সেই আফসোস আর নেই। শিক্ষকেরা আন্তরিকতা নিয়ে পড়ান। পড়াশোনার পাশাপাশি এখানকার বিশাল মাঠে খেলাধুলার সুযোগ পাই। কলেজের মনোরম পরিবেশ আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি জাগায়। তবে কিছুটা শিক্ষকসংকট আছে। সেটা কেটে গেলে আর কর্তৃপক্ষের এমন আন্তরিকতা অব্যাহত থাকলে হয়তো আমরা সঠিক গন্তব্যে পৌঁছতে পারব।’
ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নওরীন জাহান বলেন, ‘বাড়ির কাছেই এমন মনোরম পরিবেশে পড়াশোনা করতে পারছি, এটা একটা বড় পাওয়া।’
উত্তরের সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ের এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে আমার যোগদানের মাত্র দুই মাস হলো। তবে ৫৯ বছর বয়সী কলেজটি উত্তর জনপদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানকার বহু শিক্ষার্থী সাহিত্য, সংস্কৃতি, ব্যবসা, রাজনীতি ও চাকরিতে বিশেষ স্থান করে নিয়েছেন। আমরা সব সময়ই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে পাঠদান করতে চাই। এই কলেজকে দেশের অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। যার উদ্যোগ আমরা ইতিমধ্যে নিয়েছি। তবে এখানে কিছুটা শিক্ষকসংকট আছে, সেটা দূরীকরণে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। আশা করছি খুব দ্রুত এই সংকট কেটে যাবে।মো. জাহাঙ্গীর আলম, অধ্যক্ষ, মকবুলার রহমান সরকারি কলেজ