
সদ্যই বাবাকে হারিয়েছেন কেউ, কেউবা সেই শৈশবে, কারও বাবা আছেন বৃক্ষের মতো ছায়া হয়ে। তবে সবার বেড়ে ওঠায় মিশে আছে বাবার আদর, শাসন, অনুপ্রেরণা। প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার পালিত হয় বাবা দিবস। সেই হিসাবে কাল বাবা দিবস। দিনটি উপলক্ষে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে ছাপা হয়েছে বাবাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কয়েকজন সন্তানের লেখা। এখানে তেমনই একটি লেখা।
জীবনের নতুন এক অধ্যায় শুরু করতে আফগানিস্তানের কাবুল ছেড়ে কেনিয়ার মোম্বাসা শহরে পাড়ি জমাব। বহুদিন বাবার সঙ্গে দেখা নেই, মনে হলো মাঝে বাবার সঙ্গে একবার দেখা হওয়া দরকার। সংযুক্ত আরব আমিরাতে সেই সময় সুযোগ হলো। আমি কাবুল থেকে আর আব্বু ঢাকা থেকে দুবাইয়ে এলেন। কয়েকটা দিন দারুণ কাটল। এই কয়েক দিনের ভ্রমণ বাবা-মেয়ের পুরোনো স্মৃতিগুলোকে যেন আবার নতুন করে জাগিয়ে তুলল। আমার ভ্রমণপ্রীতির বীজটা বাবার হাতেই বোনা। তাঁর হাত ধরেই এই বিশাল জগৎকে প্রথমবার চিনেছি, নতুন কিছু জানার কৌতূহল জেগেছে।
আমার শৈশবের ধূসর ক্যানভাসে বাবা ছিলেন এক রহস্যময় জাদুকর। শাসনের কঠোরতা নয়, তাঁর স্পর্শে মিশে থাকত অপার স্নেহ আর অফুরন্ত আবদার পূরণের অদ্ভুত ক্ষমতা। ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে, তাঁর ব্যবসার গণ্ডি পেরিয়ে আব্বু খুঁজে ফিরতেন মুক্তির স্বাদ। পথই ছিল তাঁর আসল সঙ্গী। আমাদের কাছে ডিসেম্বর মাসটা শুধু স্কুলের ছুটি ছিল না, ছিল যেন ঈদের আনন্দ। ছুটির ঘণ্টা বাজলেই শুরু হতো আমাদের মহাযাত্রা। লম্বা গাড়ির বহর নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়তাম; আব্বুর সঙ্গে যুক্ত হতেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও তাঁদের পরিবার-পরিজন। গাড়িগুলো যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা, ছুটে চলত দেশের কোনো এক প্রান্তে। এভাবে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটেছি। সাগরের বিশালতা, চা-বাগানের সবুজ রহস্য, জাফলং-তামাবিলের পাথুরে সৌন্দর্য, সুন্দরবনের কুমিরের আদিম চাহনি বা রানি ভবানীর পুরোনো প্রাসাদ—সবকিছুই আমার ছোট্ট মনে গভীরভাবে দাগ কাটত। মনে হতো, পৃথিবীটা এক স্বপ্নপুরী, যেখানে প্রতিটি মোড়েই লুকিয়ে আছে নতুন নতুন বিস্ময়।
ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে দার্জিলিংয়ের টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখাটা ছিল আমার জীবনের এক নতুন শুরু, এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন। সেই যাত্রা থেকে আমার মনে এক অদম্য স্বপ্ন গেঁথে যায়—এই দেশেই পড়াশোনা করব। ভারতের কার্শিয়াংয়ের সেই নামী স্কুলে ভর্তি হতে চাইলেও বাবা ভর্তি করাননি। কারণ, তিনি তাঁর ছোট মেয়েকে দূরে পাঠাতে চাননি। একটু বড় হলে বাবাই হাতটা ধরে বেঙ্গালুরু নিয়ে গেলেন। সেখানে ভর্তি করালেন। সেই পড়তে যাওয়া ছিল আমার জীবনের আরেকটি বড় অভিযান। দূর দেশে তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে একা পথ চলতে হয়, আর কীভাবে ডিঙাতে হয় বড় বড় বাধা। সেই শিক্ষা আজও আমাকে পথ দেখায়।
সেই অদম্য পথচলার ধারা আজও আমার জীবনে বয়ে চলেছে, আমার জীবনসঙ্গীর হাত ধরে। গাড়ি নিয়ে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ঘুরে বেড়াই আমরা।
ঘোরাঘুরি ছাড়াও গান শোনা, ছবি তোলা আর ভিডিওগ্রাফি করতে ভীষণ ভালোবাসতেন আব্বু। এখন মাঝেমধ্যে ভাবি, সেই দিনগুলো কি কেবলই স্মৃতি হয়ে আছে? নাকি সেই স্বপ্ন আর সুরের জাদু আজও আমার বর্তমানকে কোনো এক অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে রেখেছে?