দেশে গ্যাসের চাহিদা ক্রমাগত বাড়লেও রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলো উত্তোলন বাড়াতে পারছে না। এমনকি তারা উত্তোলন করছে নির্ধারিত ক্ষমতার চেয়েও কম। ফলে গ্যাস উত্তোলনে বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরতা বেড়ে চলেছে। কিন্তু চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান কমছে না।জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার সূত্রগুলো জানায়, গত পাঁচ-ছয় বছরে রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর গ্যাস উত্তোলন দেশের মোট উত্তোলনের ৫৫ শতাংশ থেকে কমে ৪৫ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু একই সময়ে বিদেশি কোম্পানিগুলোর উত্তোলন ৪৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৫ শতাংশে উঠেছে। ফলে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কেনার জন্য সরকারের ব্যয় গত ছয় বছরে বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ।সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কিনতে সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় তিন হাজার ১৮ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা চার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।সূত্রগুলো জানায়, আগামী এক বছরে বিদেশি কোম্পানিগুলোর গ্যাস উত্তোলনের হার আরও বাড়বে। রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোও তাদের পরিকল্পনা ও নির্ধারিত ক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন বাড়াতে পারলে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান কমানো যেত। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর উত্তোলন বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর উত্তোলন: রাষ্ট্রীয় তিনটি কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বড় বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (বিজিএফসিএল)। এর আওতায় রয়েছে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র—তিতাস, বাখরাবাদ, হবিগঞ্জ, নরসিংদী ও মেঘনা। এসব ক্ষেত্রের মোট ৩২টি কূপ থেকে বর্তমানে দৈনিক ৭৬ কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাস তোলা হচ্ছে। কিন্তু এগুলোর মোট উৎপাদনক্ষমতা প্রতিদিন ৭৮ কোটি ঘনফুটের বেশি।দ্বিতীয় বৃহত্তম কোম্পানি সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিএফএল) আওতাধীন পাঁচটি ক্ষেত্র হলো সিলেট, কৈলাসটিলা-১, কৈলাসটিলা-২, রশিদপুর ও বিয়ানীবাজার। এগুলোর মোট ১৪টি কূপের গ্যাস উত্তোলনক্ষমতা প্রতিদিন প্রায় ১৬ কোটি ঘনফুট। কিন্তু তোলা হচ্ছে ১৫ কোটি ঘনফুটের মতো।রাষ্ট্রীয় অপর কোম্পানি বাপেক্স গ্যাস উত্তোলনের পাশাপাশি অনুসন্ধানও করে। বাপেক্সের আওতাধীন ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে সালদা, সেমুতাং, ফেঞ্চুগঞ্জ, শাহবাজপুর, সুন্দলপুর ও শ্রীকাইল। এই ক্ষেত্রগুলোর বিদ্যমান ১১টি কূপের মোট উৎপাদনক্ষমতা প্রতিদিন প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ ঘনফুট। তোলা হচ্ছে এক কোটি ১০ লাখ ঘনফুটের মতো।বিদেশি কোম্পানির উত্তোলন: উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তির (পিএসসি) মাধ্যমে এ দেশে কর্মরত সবচেয়ে বড় বিদেশি কোম্পানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন। এই কোম্পানি বৃহত্তর সিলেটের তিনটি ক্ষেত্র—বিবিয়ানা, জালালাবাদ ও মৌলভীবাজারের ২০টি কূপ থেকে প্রতিদিন প্রায় ১১৬ কোটি ৪০ লাখ ঘনফুট গ্যাস তুলছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী কোম্পানিটি আরও কূপ করছে, যার মাধ্যমে আগামী বছরের জুলাই নাগাদ তারা অন্তত ১২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করবে।এ ছাড়া আইরিশ কোম্পানি টাল্লো কুমিল্লার বাঙ্গুরায় চারটি কূপ থেকে দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক ১০ কোটি ঘনফুট করে গ্যাস তুলছিল। এখন তুলছে সাড়ে ছয় কোটি ঘনফুটের মতো। অস্ট্রেলীয় কোম্পানি স্যান্তোস দেশের একমাত্র সাগরবক্ষীয় ক্ষেত্র সাঙ্গুর একটি কূপ থেকে দৈনিক ৪০ থেকে ৪৫ লাখ ঘনফুট গ্যাস তুলছে। তবে গ্যাসশূন্য হয়ে পড়ায় ক্ষেত্রটি যেকোনো সময় পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হবে। এ ছাড়া ফেনী গ্যাসক্ষেত্রে নাইকোর একটি কূপ বন্ধ হয়ে আছে। মামলার কারণে নাইকো সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে না।উত্তোলন বাড়ানোর উদ্যোগ: সরকারের চাহিদা অনুযায়ী শেভরন উত্তোলন বাড়ানোর কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর কাজ এগোচ্ছে না।বাপেক্স একের পর এক পুরোনো কূপের সংস্কার (ওয়ার্কওভার) এবং নতুন কূপ খননের কাজ চালাচ্ছে। তবে তা চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি রাশিয়ার কোম্পানি গাজপ্রমের সঙ্গে সরকার চুক্তি করেছে ১০টি কূপ খনন করে দেওয়ার জন্য।চুক্তি ও কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি জুলাই মাসের মধ্যে গাজপ্রমের তিনটি কূপ খনন সম্পন্ন করার কথা। কিন্তু তারা একটি কূপ (শ্রীকাইল-৩) খনন সম্পন্ন করেছে। এ ছাড়া তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে গাজপ্রমের একটি এবং বাপেক্সের একটি খনন করা কূপ থেকে গ্যাসের সঙ্গে পানি আসছে। এ সমস্যা সমাধানে আরও সময় লাগবে।জানতে চাইলে বিজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুর রহমান বলেন, জুলাইয়ের মধ্যে ওই দুটির একটি কূপ থেকেও গ্যাস উত্তোলন শুরু করা সম্ভব হবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।পেট্রোবাংলার সূত্র জানায়, গাজপ্রম কূপ খননের কাজে একটি উজবেক কোম্পানিকে উপ-ঠিকাদার নিয়োগ করেছে। কিন্তু কোম্পানিটি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। বাপেক্সের খনন করা কূপটির সিমেন্টিংয়ে সমস্যা হয়েছে।সমীক্ষার সুপারিশ উপেক্ষিত: রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর আওতাধীন ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর জন্য একটি সমীক্ষার সুপারিশ উপেক্ষা করা হয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় ফরাসি কোম্পানি স্ল্যাম বার্জার দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এই সমীক্ষা চালায়।পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্রের ৫৯টি কূপে সমীক্ষার পর সুপারিশে বলা হয়েছিল, ওই কূপগুলোর কিছু সংস্কার এবং সাধারণ কারিগরি কার্যক্রম চালানো হলে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু ওই সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার কোনো আগ্রহ দেখায়নি।ওই সমীক্ষা দলের পরামর্শক ছিলেন পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালক মকবুল-ই ইলাহী। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো সমস্যাই ছিল না। বাস্তবায়ন করলে নিশ্চিত ভালো ফল পাওয়া যেত। এমনকি এখনো তা বাস্তবায়নের সুযোগ আছে। তাতে কম সময়ে ও স্বল্প ব্যয়ে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।অন্যান্য সূত্র জানায়, রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর উত্তোলন বাড়ানোর গতি শ্লথ। অপরদিকে বিদেশি কোম্পানি, বিশেষ করে শেভরনের উন্নয়ন কার্যক্রম এগিয়ে চলায় আগামী বছর গ্যাস উত্তোলনে বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরতা আরও বাড়বে। চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধান মেটানোও সম্ভব হবে না। একেক সময় একেক খাতে গ্যাস-সংকট চলতে থাকবে।