ভূমিকা

আমাদের সাহিত্য–সংস্কৃতি গরিব নয়

প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদের জন্মদিন আগামীকাল ২৩ অক্টোবর। মৃত্যুর পর এটি তাঁর প্রথম জন্মদিন। এ উপলক্ষে প্রকাশিত হলো তাঁর অপ্রকাশিত বক্তৃতা। সেই সঙ্গে বাবাকে নিয়ে লিখেছেন ছেলে সৈয়দ নাসিফ মকসুদ

সৈয়দ আবুল মকসুদ (২৩ অক্টোবর ১৯৪৬—২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১)। ছবি: অন্য আলো
সৈয়দ আবুল মকসুদ (২৩ অক্টোবর ১৯৪৬—২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১)। ছবি: অন্য আলো

সৈয়দ আবুল মকসুদ বক্তৃতা দেওয়ার মানসে এই লেখা লিখেছিলেন ১৯৯৫ সালে। ওই বছর সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তাঁকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। সেই পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি এই লিখিত বক্তব্য দেন।

১৯৯৫ সালে দুজন বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন—সৈয়দ আবুল মকসুদ ও শাহরিয়ার কবির। এ সময় পুরস্কারের অর্থমূল্য ছিল ২৫ হাজার। এই টাকা দিয়ে আবুল মকসুদ তাঁর বাবা সৈয়দ আবুল মাহমুদের নামে একটি তহবিল গঠন করেন। আদতে এই বক্তৃতায় একজন নিষ্ঠাবান সাহিত্যিকের আকুতিই ব্যক্ত হয়েছে। সৈয়দ আবুল মকসুদের অপ্রকাশিত বক্তৃতাটি পাওয়া গেছে তাঁর পরিবারের সূত্রে।

ভূমিকা

সৈয়দ আবুল মকসুদ বক্তৃতা দেওয়ার মানসে এই লেখা লিখেছিলেন ১৯৯৫ সালে। ওই বছর সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তাঁকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। সেই পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি এই লিখিত বক্তব্য দেন।

১৯৯৫ সালে দুজন বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন—সৈয়দ আবুল মকসুদ ও শাহরিয়ার কবির। এ সময় পুরস্কারের অর্থমূল্য ছিল ২৫ হাজার। এই টাকা দিয়ে আবুল মকসুদ তাঁর বাবা সৈয়দ আবুল মাহমুদের নামে একটি তহবিল গঠন করেন। আদতে এই বক্তৃতায় একজন নিষ্ঠাবান সাহিত্যিকের আকুতিই ব্যক্ত হয়েছে। সৈয়দ আবুল মকসুদের অপ্রকাশিত বক্তৃতাটি পাওয়া গেছে তাঁর পরিবারের সূত্রে।

বাংলা একাডেমিকে বলা হয় জাতির মেধা ও মননের প্রতীক। এই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যখন কারও কোনো অবদানের জন্য সম্মানিত করা হয়, তখন তার মূল্য অর্থের পরিমাণ দিয়ে করা অসংগত। সে পুরস্কারের পরিমাণ যদি এক টাকাও হয় এবং দেশে যদি লক্ষাধিক টাকার আরও পুরস্কার থাকে, তবু সেগুলোর চেয়ে বাংলা একাডেমি প্রদত্ত এক টাকার পুরস্কারই অধিক সম্মানজনক। আমরা ফরাসি দেশের গোঁকুর্তের পুরস্কারের কথা জানি, যে পুরস্কারের টাকা দিয়ে ভালো একটি শার্টও কেনা যায় না। কিন্তু সেটি ফ্রান্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সুতরাং আজ এই পুরস্কার গ্রহণকালে আমি ভাষা আন্দোলনের শহীদদেরসহ দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দেওয়া সব শহীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

আমরা গর্বিত, কারণ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষা ও সাহিত্যগুলোর একটি। আমাদের দেশ ঔপনিবেশিক ও সামন্তবাদী শাসন–শোষণে গরিব হয়ে পড়েছে বটে, কিন্তু আমাদের সাহিত্য–সংস্কৃতি গরিব নয়, অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ১০০ বছর আগে ১৮৯৬ সালে সমগ্র বাংলার লোকসংখ্যা ছিল তিন কোটির মতো। পূর্ববঙ্গে অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে দেড় কোটির কিছু বেশি। তাদের মধ্যে শিক্ষিতের সংখ্যা ছিল খুবই অল্প। গত ১০০ বছরের কথা বলব না। কারণ, এ সময় বাংলা সাহিত্যে বিপুল কাজ ও ভালো কাজ হয়েছে। তার পূর্ববর্তী ১০০ বছরের বাংলা সাহিত্যের কথা শুধু স্মরণ করতে চাই। ১৮৯৬ সালের আগেই বিদ্যাসাগর, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, মধুসূদন, বঙ্গিমচন্দ্র প্রমুখ বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব পরলোকগমন করেন। ১৮৯৬ সালের আগেই প্রকাশিত হয় মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ–সিন্ধু। রমেশচন্দ্র দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীসহ আমাদের শ্রেষ্ঠ লেখকদের প্রধান গ্রন্থ ১৮৯৬ সালের আগে প্রকাশিত হয়। আজ আমাদের আত্মসমালোচনা করার সময়। কেন এখন আর তাঁদের উচ্চতাসম্পন্ন কবি–সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করছেন না? সেদিন দেড়–দুই কোটি মানুষের মধ্যে বহুসংখ্যক বড় বড় ব্যক্তিত্ব পেয়েছিলাম, আর আজ ১২ কোটি মানুষের মধ্যে তাঁদের মতো ১০–১২ জনও নেই কেন?

সাহিত্যচর্চা আমার পেশা নয়—অর্থ উপার্জনের উপায় নয় (যদিও এতে অর্থও উপার্জন করছি)। তা–ই যদি হতো, তাহলে এমন কিতাব লিখতাম, যাতে চার–পাঁচ বছরেই বিত্তশালী হয়ে যেতাম। তা ছাড়া প্রচুর অর্থ উপার্জনের জন্য আরও অনেক পথ রয়েছে, সেসব পথে যাইনি। যেকোনো শ্রমজীবীর মতো জীবিকার জন্য আমার একটি চাকরি রয়েছে। সাহিত্য কোনো নেশার দ্রব্য নয়, সুতরাং সাহিত্য আমার নেশাও নয়, যা অনেকে বলেন। সাহিত্যচর্চা আমার দায়িত্ব সম্পাদনের উপায়মাত্র। এই সমাজের এক সদস্য হিসেবে আমার কর্তব্য সম্পাদনের জন্য আমি সাহিত্যচর্চা করি। অর্থাৎ এ কাজে যদি সমাজের কিছুটা উপকার হয়ে থাকে, তাহলে আমার শ্রম বিফলে যাবে না। বোধ হয় আমার কাজ ব্যর্থ হয়নি, তাই আপনারা আমাকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছেন।

শৈশবে লেখকজীবনের শুরুতেই আশা পোষণ করতাম, জীবনে আর কিছু নয়, বড় লেখক অথবা ভালো লেখক হব। তবে জন্মগত প্রতিভার ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে, ইচ্ছা করলেই অনেক কিছু হওয়া যায় না। কিন্তু এই সমাজে বড় লেখক হওয়ার পথে বাধা অনেক, তা এখানে আলোচ্য নয়। তবু গত ৩০ বছরের বেশি সময়ে আমি কিছু কাজ করেছি, যা সম্ভবত সমাজের ও সাহিত্যের সামান্য প্রয়োজন মিটিয়েছে।

আমি ভৌগোলিকভাবে বর্তমান বাংলাদেশের লেখক হলেও বাংলা ভাষাভাষী সবার জন্যই আমার সাহিত্যকর্ম। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের সমন্বিত চেষ্টা ও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ছাড়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি সম্ভব নয় বলে আমার ধারণা। দুই অঞ্চলের অবৈধ ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারীদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কিন্তু এই জাতির স্বার্থে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যসাধকদের মধ্যে অবাধ যোগাযোগের সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়।

আমি কোনো বিত্তশালী মানুষ নই। মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। অসচ্ছলতার সঙ্গে পরিচয় আমার শৈশব থেকেই। এই পুরস্কারের সঙ্গে যে অর্থ প্রদত্ত হয়েছে, এই দুর্মূল্যের দিনে তার পরিমাণ প্রচুর না হলেও আমার কাছে কম নয়। আমার পিতাও আজীবন নীরবে কাব্যচর্চা করে বৈষয়িক হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। তবু আমৃত্যু তিনি চাইতেন, তাঁর একমাত্র সন্তান সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত থাক। সমাজ ও রাষ্ট্রের থেকে কোনোকিছু প্রাপ্তির আশা তিনি আমাকে পরিত্যাগ করতে পরামর্শ দিতেন। এই পুরস্কারের অর্থের ৫২ শতাংশ থেকে আট হাজার টাকা দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে আমি ‘সৈয়দ আবুল মাহমুদ তহবিল’ নামে একটি কল্যাণ তহবিল গঠন করতে চাই বাংলা একাডেমিরই তত্ত্বাবধানে, যে টাকার লভ্যাংশ সহায়–সম্বলহীন কবি–সাহিত্যিকদের চিকিৎসার জন্য ব্যয় করা হবে।

অবশিষ্ট অর্থ দিয়ে আমি আরেকটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যার কাজ হবে কুষ্ঠ রোগীদের পুনর্বাসনের সাহায্য করা। গত দুই বছরে নানা কুষ্ঠ নিরাময় কেন্দ্র ও হাসপাতাল আমি ঘুরে দেখেছি। সে এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। বহু রোগী চিকিৎসা শেষে সমাজে ফিরে গিয়ে অবহেলায় সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অনেকে ভিক্ষুকে পরিণত হয়। আরোগ্যের পর চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো থেকে চলে যাওয়ার সময় যদি দরিদ্র রোগীদের কিছু টাকা হাতে দেওয়া হয় ছোটোখাটো ব্যবসা করে স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের জন্য, তা হলে অনেকে উপকৃত হবে। যদি বেঁচে থাকি, তাহলে অল্প দিনের মধ্যেই আমার বয়স অর্ধশতাব্দী হবে। কিন্তু এখন দেখছি সমাজের ও রাষ্ট্রের কোনো মহৎ কাজ আমার দ্বারা হবে না। তাই এই ক্ষুদ্র কাজটুকু করতে চাই।

আগামী শতকে আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতির সমস্যাগুলো দৃঢ় হবে এবং পৃথিবীতে বাংলাদেশ পরিচিত হয়ে উঠবে একটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে, এই আশা ব্যক্ত করে আমি শেষ করছি। আপনাদের ধন্যবাদ।