কিংবদন্তি উর্দু কথাশিল্পী সাদত হাসান মান্টোর মৃত্যুদিন আজ। এ লেখায় ধরা আছে তাঁর অন্তিমযাত্রার মুহূর্তগুলি।

অনলাইনের যুগে এখন অনেক কিছুই সহজ। তত্ত্ব-তথ্য তালাশ বা সুলুক সন্ধান করা খুব কঠিন কোনো কাজ নয়। তা সে যে বিষয়েই হোক। যেমন একটা লাতিন কথা ভালো লাগল বলে অর্থ সন্ধান করার চেষ্টা এবং অনায়াসে খুঁজে পাওয়া।
ইন ভিনো ভেরিতাস (In vino veritas)। ইংরেজিতে কথাটির অর্থ in wine there is truth; people speak the truth when they are drunk। কখনো কখনো আমার মনে হয়, এ রকম মদ্যপ নেশাগ্রস্ত মানুষেরা অনেকাংশে সৎ আর খোলা মনের মানুষ। এটা বির্তকের বিষয় নয়, এটা সাধারণ একটা ভাবনা। আমার অনুভূতি হলফ করে বলা যাবে না। বিউকোফোস্কি মনে হয় এ রকম কিছু বলতেন।
কথাটা বলার চেষ্টা করছি কিংবদন্তি উর্দু কথাশিল্পী সাদত হাসান মান্টোকে মাথায় রেখে। একটা তুলনামূলক ছোট ৪২ বছর ৮ মাস ৪ দিনের ঝোড়ো জীবন ছিল তাঁর, ছিল ঝঞ্ঝাটের জীবন।
ছোটবেলায় অমৃতসরের পথঘাটে, কবরস্থানে ঘুরেফিরে বেড়ানো, জালিয়ানওয়ালাবাগের কোনো গাছের নিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা, গুরু বারী আলিগের সম্মোহনে হাসান আব্বাস, কুরেশিদের সঙ্গে নানান অভিযান কখনো ঘরের ‘লাল দুর্গে’ (সাদত মান্টোর ঘরটার সাংকেতিক নাম), কখনো কোনো হোটেলে ‘অবেলায়’ ‘জিন’ খাওয়া, সঙ্গে সাহিত্যচর্চা, বাবার স্নেহবঞ্চনা, উর্দুতে ফেল করা, বম্বে (এখন মুম্বাই) চলচ্চিত্রজগতে বিচরণ, ভালো অর্থ উপার্জন আর নানাভাবে বেহিসাবি চলা, বম্বে চিত্রজগতের সাময়িক ধসে ধ্বস্ত, বুকের পাঁজর ভেঙে দেওয়া দেশভাগের নিরন্তর দাপানি, নতুন দেশে উপার্জনের ক্রমাবনতি, লাগামহীন ধারদেনা, পরিবারের প্রতি নিখাদ ভালোবাসার পরও মদিরার গভীর ধ্বংসাত্মক নেশায় জীবনের ঔদার্যে আর লেখনীতে সততার চরম পরাকাষ্ঠা সাদত হাসান মান্টো। তিনি মনে করতেন, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তাঁর মাথা খোলে। অবশ্য মান্টোর ভাগ্নে হামিদ জালাল দেখেছেন, তাঁর এই দাবির ভিত্তি নেই। তিনি বরং আরও ভালো লেখেন যখন নেশার ঘোর থাকে না।
১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি সকালে লিভার সিরোসিসের কঠিন ধকলে কঙ্কালসার দেহে সাদত মান্টো তাঁর স্ত্রীকে জানান পেটের সীমাহীন যন্ত্রণার কথা। মান্টো বুঝতে পারছিলেন এবার তাঁর অন্তিম মুহূর্ত সাঙ্গ হতে চলেছে। তবে হাসপাতালে যেতে তিনি রাজি হলেন না। মদ এখন বিষ জেনেও বারবার মরার আগে শয্যায় সুধা পানের জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করলেন মান্টো। তাঁকে থামাতে অবশেষে দেওয়া হলো মদিরার কয়েক ফোঁটা। তবে সেই ফোঁটা ভেতরে গেল না, মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলো।
ঠিক করা হলো, বিকেল চারটের মধ্যে মান্টোর দাফনকাজ শেষ হবে। পরে মৃতদেহের অবস্থা বিবেচনা করে বেলা সাড়ে তিনটার মধ্যে সব কাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত হলো।মান্টো মারা যাওয়ার পর রেডিও লাহোর থেকে বারবার তাঁর মৃত্যুর সংবাদ প্রচারিত হয়, যেখানে তাঁর প্রবেশ বেঁচে থাকতে একরকম প্রায় নিষেধই ছিল। মান্টোর জানাজায় বহু মানুষের সমাবেশ হয়েছিল। তাঁকে শেষবারের দেখা দেখতে লাহোরের ৩১ লক্ষ্মী ম্যানসনে হাজির হওয়া মানুষজনের মধ্যে ছিল বেশির ভাগ তরুণ, ছাত্র-শিক্ষক, আমজনতা এমনকি অনেক বোরকা পরা নারী, যাঁদের সম্পর্কে অনুমান করা হয়, তাঁরা সমাজ পরিত্যক্ত পেশাজীবী, যাঁদের জীবনের কঠিন প্রতিচ্ছবি মান্টো দরদে এঁকেছিলেন গল্পে।
হাসপাতালে পৌঁছানোর পর অ্যাম্বুলেন্সে বসে ডাক্তার পরীক্ষা করে জানালেন মান্টোর প্রাণবায়ু এর মধ্যেই চলে গেছে। সময় তখন পাক্কা সকাল সাড়ে দশটা।
ওই দিনই ঠিক করা হলো, বিকেল চারটের মধ্যে মান্টোর দাফনকাজ শেষ হবে। পরে মৃতদেহের অবস্থা বিবেচনা করে বেলা সাড়ে তিনটার মধ্যে সব কাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত হলো।
মান্টো মারা যাওয়ার পর রেডিও লাহোর থেকে বারবার তাঁর মৃত্যুর সংবাদ প্রচারিত হয়, যেখানে তাঁর প্রবেশ বেঁচে থাকতে একরকম প্রায় নিষেধই ছিল। মান্টোর জানাজায় বহু মানুষের সমাবেশ হয়েছিল। তাঁকে শেষবারের দেখা দেখতে লাহোরের ৩১ লক্ষ্মী ম্যানসনে হাজির হওয়া মানুষজনের মধ্যে ছিল বেশির ভাগ তরুণ, ছাত্র-শিক্ষক, আমজনতা এমনকি অনেক বোরকা পরা নারী, যাঁদের সম্পর্কে অনুমান করা হয়, তাঁরা সমাজ পরিত্যক্ত পেশাজীবী, যাঁদের জীবনের কঠিন প্রতিচ্ছবি মান্টো দরদে এঁকেছিলেন গল্পে। দুঃখ কি দুর্ভাগ্য—দুজন বাদে তাঁর অতি পরিচিত বন্ধু, যাঁদের সঙ্গে সময় কাটত নানান আলোচনার মুখরতায়, তাঁদের আর দেখা যায়নি শেষবেলায়।
মান্টোর জানাজায় ইমামতি করেন এক তরুণ ইমাম। তিনি প্রথমেই নিজের দাড়ি টানতে শুরু করেন আর টুপি খুলে নামাজের জন্য প্রস্তুত হন। স্বাভাবিকভাবে হইচই শুরু হলে ইমাম তাঁদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বলেন, তিনি নিজেই মান্টোর ‘সাহেব ই কারামত’ গল্প থেকে উঠে আসা এক প্রতারক মোল্লা যার খায়েস জোব্বার আড়ালে আদিম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা। অতএব ইমামের কাজ হলো, প্রথমে এই মুখোশ খুলে জানাজায় ইমামতি করা। ভন্ড ইমামের পেছনে কেউ দাঁড়াবেন না বলে আবারও হইচই শুরু হলে ইমাম সবাইকে ঠান্ডা হওয়ার অনুরোধ করে বলেন, সাদত হাসান মান্টো কখনো কারও মধ্যে আদি-অকৃত্রিম শুদ্ধতার খোঁজ করেননি। তিনি মনে করতেন, ভিন্ন পথে চলে যাওয়া বহু মানুষও অনন্য, অসাধারণ ভালো কাজ করতে পারে। জমায়েত থেকে শোর উঠল, এসব নিজের মতো বলা চলবে না। ইমাম আবার বললেন, শরীয়তের আইনে এক তালাকপ্রাপ্ত নারী তাঁর আগের স্বামীকে বিয়ে করতে পারে না যতক্ষণ না সে অন্য কোনো পুরুষের দ্বার পরিগ্রহ করে।
আজ তিনি যে কাজ করছেন, সেটা হলো ওই নারীকে বিয়ের রাতে তালাক দিয়ে তাঁর আগের স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার মতো পুণ্যের কাজ। এর সঙ্গে তাঁর ইমামতির বয়স—তিনি তরুণ কি বয়সী, অথবা তাঁর দাড়ি আছে কি নাই, তার কোনো সম্পর্ক নেই। এরপর আর কথা বাড়েনি। জানাজা শেষে লাহোরের মিয়ানি সাহেব কবরস্থানে চিরদিনের মতো শায়িত হলেন সাদত হোসেন মান্টো।
মারা যাওয়ার প্রায় ছয় মাস আগে ১৮ আগস্ট ১৯৫৪ সালে লিখেছিলেন তাঁর এপিটাফ, ‘এখানে শায়িত সাদত হাসান মান্টো। তাঁর সঙ্গে সমাহিত ছোটগল্প লেখার সব শৈলী আর রহস্য। মাটির গভীরে শুয়ে তিনি ভাবছেন, ছোটগল্পের বড় লেখক কে, তিনি না খোদা?’ তাঁর এই এপিটাফ কবরে খোদিত হয়নি। এ কথা কবরে খোদাই করলে ঝামেলা শুরু হতে পারে আশঙ্কায় মান্টোর সহোদরা সবাইকে বিরত করেন। তাঁর বদলে গালিবের পঙ্ক্তির অনুপ্রেরণায় মান্টোরই লেখা আরেকটা এপিটাফ লাগানো হয়।
‘এই হলো সাদত হাসান মান্টোর সমাধি, যিনি আজও ভাবেন সময়ের ফলকে তাঁর নাম বারবার আর উচ্চারিত হয়ে ফেরে না।’
হামিদ জালালের মেয়ে আয়েশা জালাল শেষ লাইন আরেকটু পাল্টে পড়তে চেয়েছেন, ‘এখানে শায়িত মান্টো। এখনো তিনি ভাবছেন, তিনি ভুলে যাওয়া কোনো বড় মাপের গল্পকার বা ইতিহাসবিদের তুলনায় স্মৃতির সার্থক সন্ধানী কি না...।’