
ছাপচিত্রের একটি সামাজিক চরিত্র আছে। একটি ভাবনা একই সঙ্গে অনেকের কাছে পৌঁছে দিতে ছাপচিত্র যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আবার কোনো মধ্যবিত্তের ইচ্ছা হলেই নিজের সংগ্রহে রাখতে পারেন এ মাধ্যমের একটি শিল্পকর্ম। মোদ্দা কথা, শিল্পকর্মকে জনমানুষের হাতের নাগালে এনে দিতে ছাপচিত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম; এবং এর রয়েছে বিশেষ ভূমিকা।
ধারণা করা হয়, প্রথম ছাপচিত্রের আবির্ভাব ঘটে চীন দেশে—বৌদ্ধধর্ম প্রচারের লক্ষে৵ ভিক্ষুদের একটি ধর্মগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে আধুনকি শিল্প আন্দোলনের সময় এর ব্যাপক বিস্তার দেখা যায়। বাংলাদেশে আধুনিক ছাপচিত্রের পথিকৃৎ শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ। তাঁর হাত ধরেই এ দেশে ছাপচিত্রের প্রসার ঘটে। পরবর্তী সময়ে অনেক বরেণ্য শিল্পীই ছাপচিত্রে উৎসাহী হন এবং এই মাধ্যমে কাজ করেন, তাঁদেরই একজন প্রথিতযশা শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া। বাংলাদেশের শিল্প জগতে আধুনিক চিত্রকলার ক্ষেত্রে মোহাম্মদ কিবরিয়া এক অবিস্মরণীয় নাম। এ দেশে বিমূর্ত চিত্রধারার পথিকৃৎ বলা চলে তাঁকে। ছাপচিত্রের ক্ষেত্রেও এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন তিনি। তাঁর স্মরণে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে স্থাপিত হয় ‘কিবরিয়া প্রিন্টমেকিং স্টুডিও’। দীর্ঘ পাঁচ বছরে দেশ-বিদেশের নানা শিল্পীর আনাগোনা এ স্টুডিওতে, সেটা ছাপচিত্রের সূত্র ধরে। ‘কিবরিয়া প্রিন্টমেকিং স্টুডিও’-এর সংগৃহীত ৭০ জন শিল্পীর ছাপচিত্র নিয়ে গেল ১৫ জানুয়ারি ‘শিল্পাঙ্গন গ্যালারি’তে শুরু হয়েছিল ছাপচিত্র প্রদর্শনী।
বাংলাদেশ ও ভারতের বেশ কয়েকজন শিল্পী অংশ নিয়েছিলেন প্রদর্শনীতে। বাংলাদেশের বরেণ্য শিল্পীদের মধ্যে আছেন মোহাম্মদ কিবরিয়া, মনিরুল ইসলাম, রফিকুন নবী, হামিদুজ্জামান খান, আবুল বার্ক আলভী, বীরেন সোম, শহিদ কবির প্রমুখ। প্রদর্শনীতে খ্যাতিমান শিল্পীদের পাশাপাশি স্থান পেয়েছিল নবীন শিল্পীদের কাজও।
ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন কে জি সুব্রামানিয়ন, সনৎ কর, অজিত শীল, অতনু বসু, নির্মলেন্দু দাস, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
ছাপচিত্রের আদি নিদর্শন হিসেবে অধিক পরিচিত সাদা-কালোয় চিত্রিত কাঠ খোদাই। সেই আদি রূপ যেমন প্রদর্শনীর কোনো কোনো শিল্পীর কাজের মধ্যে পাওয়া যায়, তেমনি ছাপচিত্র ধারায় রঙিন ছাপচিত্র এখন বেশ আলোড়িত। রঙিন ছাপচিত্রের প্রভাবও দেখা গেছে অনেক শিল্পীর কাজে। ভারতীয় শিল্পীদের কাজ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাঁদের চিত্রে সম্পূর্ণ বিমূর্ত ভাবটা কম; এমনকি ছবি ততটা বেশি নিরীক্ষাধর্মীও নয়। এখানে ছাপচিত্রের প্রচলিত ধারা বিদ্যমান। তবে তাতে আছে নান্দনিকতার ছোঁয়া। অন্যদিকে, বাংলাদেশি শিল্পীদের প্রায় অনেকের কাজে বিমূর্ত ভাব লক্ষ্যণীয়; এসব ছবি অনেক বেশি নিরীক্ষাধর্মী এবং নান্দনিকতার ছাপও এখানে সুস্পষ্ট। সব মিলিয়ে প্রদর্শনীটি দেখে বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্পীদের ছাপচিত্রের তুলনামূলক পর্যালোচনা করা সম্ভব।
প্রদর্শনীটি চলেছিল ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত।