তুষার কর বিংশ শতকের ছয়ের দশকের মধ্যভাগ থেকে মূলত শিশু-কিশোরদের জন্য লেখালেখির জীবন বেছে নেন। তখন থেকে এখন পর্যন্ত মূলত লিখে চলেছেন ছড়া ও কিশোর কবিতা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও নিরেট সত্যটা এই যে আমাদের আলোচ্য মাঠ হারিয়ে যায়সহ এ যাবৎ প্রকাশিত তাঁর স্বরচিত বইয়ের সংখ্যা মাত্র চারটি। হয়তো মফস্বলে থাকেন বলেই কিংবা নিজেকে প্রকাশে নিজের স্বভাবগত সংকোচ তাঁর গ্রন্থসংখ্যাকে এ পর্যায়ে সীমিত রেখেছে। কিন্তু তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা যত কমই হোক না কেন, তাঁর লেখা ছড়া কবিতার মূল্যায়নে ব্রতী হলে একটু নড়েচড়ে বসতেই হবে।
এ বইয়ের নাম কবিতার কথাই ধরা যাক। খেলার মাঠঘাট দখল করে গড়ে উঠছে কেবলই পাকা দালান-বাড়ি, আকাশছোঁয়া অট্টালিকার সারি। তারই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে তুষার কর লিখেছেন, ‘মাঠের ওপর বাড়ির সারি/ খেলব এখন কই?/ মন খারাপের এই বিকেলে/ একলা বসে রই।’ তাঁর এই উচ্চারণ শিশু-কিশোর তো বটেই, আমাদের সবারই মনের কথা হয়ে ওঠে।
মাঠ হারিয়ে যায় তুষার কর প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মাসুক হেলাল l প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা l প্রকাশকাল: মার্চ ২০১৬ l ২৮ পৃষ্ঠা l দাম: ১৫০ টাকা
আদর্শবাদিতা তুষার করের রচনার প্রধান অঙ্গীকার। এই বইয়ের প্রতিটি ছড়া ও পদ্যে কিংবা কিশোর কবিতায় তার স্বাক্ষর বিধৃত। ‘একা আমি বাঁচি না তো’ কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেন, ‘একা আমি বাঁচি না তো/ সবার সাথে বাঁচি/ নাচের ক্লাসে বন্ধু আসে/ হাত ধরে যে নাচি।’ ‘...একা আমি চলি না তো/ কাজ রয়েছে কত/ সব মানুষের পাশে আছি/ আলো হাওয়ার মতো।’ একসঙ্গে সবাইকে নিয়ে বাঁচার আকুতি বা অঙ্গীকার যখন সমাজজীবন থেকে নির্বাসনে যাওয়ার পথে, তখন তুষার করের এই উচ্চারণ সত্যিই মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে যায়।
মোট ২১টি ছড়া-কবিতার এই সংকলনের কোন লেখা ছেড়ে কোন লেখার কথা উল্লেখ করব! চটি এ বইয়ের লেখার ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে পুরো বাংলাদেশ, মা, মহান মুক্তিযুদ্ধ, প্রাণের ভাষার কথা। আছে দেশের অপরূপ প্রকৃতির বর্ণনা, শিশু-কিশোরদের আনন্দ-বেদনার কথা। তাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন-বাসনার কথাও।
সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলেই তুষার লিখতে পারেন ‘স্বাধীনতা’ নামের এমন আশ্চর্য ছড়া, যেখানে তিনি বলেন, ‘আস্তে রাখবে পা/ এখানে বধ্যভূমি/ মনে কি পড়ে না আর/ ভুলে গেছ সবি তুমি?/ এখানে ভায়ের লাশ/ এখানে বোনের চুল/ এখানে মায়ের হাত/ তবু কেন হয় ভুল?/ এখনো যে তারা ডাকে/ শোনো কি তাদের কথা/ তাদেরই রক্তে গড়া/ আমাদের স্বাধীনতা।’ কিংবা ‘কেউ কোরো না ক্ষমা’ লিমেরিকটির পাঠও প্রতিজ্ঞপ্রাণিত করবে যে কাউকে। মাত্র পাঁচটি চরণেই যে ভাবনাকে তুলে ধরেন তিনি, তা সত্যিই চেতনা-উদ্রেকী, হৃদয়স্পর্শী, যেখানে তিনি বলেন, ‘একাত্তরের জল্লাদদের কেউ কোরো না ক্ষমা/ জেল্লা তাদের যতই বাড়ুক, হোক নাকো রমরমা,/ ডাক আসবে যখনই/ লড়তে হবে তখনই/ বুকের ভেতর প্রতিরোধের বারুদ রেখো জমা।’
এ বইতে ননসেন্স জাতীয় কিছু ছড়াও আছে। যেমন ‘ভাইকিং’, ‘ঘুম’, ‘শীতের পাখি’ ইত্যাদি। কিন্তু নিছক ননসেন্স বা আবোল-তাবোল বলতে যা বোঝায়, এসব ছড়া সেই গোত্রের নয়। এগুলোতেও বক্তব্য আছে। ছোটদের মনস্তত্ত্ব-ছোঁয়া ভাব-ভাবনা আছে।
তুষারের ছড়ায় অন্ত্যমিলের বাহাদুরিও বেশ লক্ষ করা যায়। ‘ভাইকিং’ ছড়ার প্রথম স্তবক: ‘উড়ে যায় ভাইকিং/ নাই রাজা নাই কিং/ সাড়ে তিন কোটি দূর মাইলে/ ইচ্ছেটা থাকলে দূরদেশ দেখবার/ যেতে পারে এক্ষুনি চাইলে।’ কিংবা ‘এই যে ছেলে নামটা কী রে?/ নাম নাকি তোর হারাধন/ তোর কথা যে কেউ ভাবে না/ অঢেল জমায় যারা ধন।’
সবকিছু মিলিয়ে তাঁর মাঠ হারিয়ে যায় বইয়ের ২১টি ছড়া-কবিতা বয়স নির্বিশেষে আমাদের সবাইকে এমন এক জগতে নিয়ে যায়, যে জগৎ বাস্তবের, যাকে আমরা অনেকে ভুলে গেলেও নতুন করে জীবন্ত করে তুলেছেন তুষার কর।