জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধা

জয়নুলের দায়বোধ

বাংলাদেশে চারুকলাচর্চার ভিত্তি নির্মাণ করেছেন তিনি। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মেলবন্ধনে তাঁর চিত্রকলা মানবতার আর্তি ও সম্পদে বাঙ্ময়। তাঁর ক্যানভাসে অসামান্য হয়ে আছে বাংলার মানুষের মুখ। একদিকে শিল্প-বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠা, অন্যদিকে বাংলার আবহমান লোকশিল্পের সংরক্ষণ—শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন দুই ক্ষেত্রেই পথিকৃৎ। তাঁর জন্মশতবর্ষে বিশেষ আয়োজন

জয়নুল আবেদিন (২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪—২৮ মে ১৯৭৬), প্রতিকৃতি: কাইয়ুম চৌধুরী
জয়নুল আবেদিন (২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪—২৮ মে ১৯৭৬), প্রতিকৃতি: কাইয়ুম চৌধুরী

জন্মশতবর্ষে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে (১৯১৪—৭৬) স্মরণ করার সময় তাঁর অনেকগুলো অবদানকে মনে হয় অনন্য। এর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য, ঢাকায় চারুকলাবিষয়ক শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা। প্রকৃতি ও জনজীবন পর্যবেক্ষণে তাঁর পরম সূক্ষ্ম ও নিগূঢ় অবলোকনশক্তি, দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালায় ব্যক্ত তাঁর বাস্তবতাবোধ ও অপরিমেয় মানবমমতা, পঞ্চাশের দশকে সৃষ্ট নারী-চিত্রমালায় লোকজ ঐতিহ্য-চেতনার সঙ্গে কিউবিজম-উদ্ভূত জ্যামিতিক ফর্মের সমন্বয়সাধন, দীর্ঘ দুটি স্ক্রোলচিত্রে দেশাত্মবোধের অভিপ্রকাশ, লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় কর্তব্য সম্পাদন প্রভৃতি বহন করছে তাঁর অতুলনীয় কর্মযজ্ঞের সাক্ষ্য। তবে এ সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয় বাংলাদেশে চারুশিল্পের জনক হিসেবে তাঁর অমূল্য অবদানকে। ঢাকায় শিল্প-শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠার (১৯৪৮) মাধ্যমে তিনি চারুশিল্প চর্চার যে সুযোগ সৃষ্টি করলেন, আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে তা এক ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। এই প্রতিষ্ঠান শুধু চারুশিল্পী সৃষ্টির মাধ্যমে সুন্দরের পথে সমাজকে অগ্রসর করে নিয়ে যায়নি, আমাদের সমগ্র সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে প্রগতির ধারায় ও অসাম্প্রদয়িক ভাবনায় উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রেও রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
এরূপ জাতীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁকে বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে; বিসর্জন দিতে হয়েছে শিল্পী হিসেবে নিজের চর্চা, বিকাশ, সমৃদ্ধি ও খ্যাতির আকাঙ্ক্ষাকে; এবং সেই সঙ্গে জয় করতে হয়েছে বৈষয়িক উন্নতিসাধনের প্রলোভনকে। অন্তর্গত কোন শক্তি তাঁকে এমন পরার্থপরতায় নিয়োজিত করল, ব্যক্তিস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সমষ্টির স্বার্থে আত্মনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করল, তার স্বরূপ বিশ্লেষণ আবশ্যক।
স্মরণীয় যে, জয়নুল জন্মাননি কোনো বিত্তবান পরিবারে কিংবা উন্নত সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোয়। শিল্পশিক্ষার জন্য তাঁকে শুরু থেকেই নিয়োজিত হতে হয়েছে অস্তিত্ব রক্ষার এক কঠিন আর্থিক সংগ্রামে। তাঁর মানসগঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে শৈশব ও কৈশোরে দেখা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের নিসর্গ ও জীবনবৈভব। ব্রহ্মপুত্র নদ এবং এর দু-তীরের নিম্নবর্গীয় প্রান্তিক মানুষের জঙ্গম জীবন ও তাঁদের সংগ্রামশীলতা জয়নুলের চেতনাজগৎকে যেমন সমৃদ্ধ ও মানবিক করেছে, তেমনি তাঁর কল্পনাশক্তিকেও করেছে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। জীবনের বৈচিত্র্য অনুসন্ধানে নিবিড় পর্যবেক্ষণ তাঁর জীবনদৃষ্টিতে এনেছে স্বাতন্ত্র্যদীপ্ত স্বচ্ছতা।
ময়মনসিংহের মতো মফস্বল শহর থেকে তিনি তখনকার বাংলার রাজধানী কলকাতায় গিয়েছিলেন শিল্পশিক্ষার জন্য। এটি আসলে তাঁর গ্রাম থেকে নগরে যাওয়ার সঙ্গেই তুল্য। ওই সময়ে ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাধীন। এই শাসন-শোষণকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে উপনিবেশবাদীরা অনেকগুলো কৌশল ও ধারণার উদ্ভব ঘটিয়েছিল। কেন্দ্র ও প্রান্তের ধারণা তার মধ্যে অন্যতম। কেন্দ্র ব্রিটেন আর ভারতবর্ষ প্রান্ত। ভারতবর্ষের ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মনকে করে তোলা হয়েছিল কেন্দ্রমুখী। বাংলার পটভূমিতে কেন্দ্র ছিল কলকাতা, বাকি অংশ প্রান্ত। সুতরাং ১৯৩২ সালে জয়নুলের কলকাতা-যাত্রা প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে যাওয়ার সঙ্গেও তুল্য। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে এমন যাত্রায় যে পরিবর্তন ছিল অনিবার্য, অর্থাৎ গ্রামকে অবজ্ঞা করে নাগরিক মনমানসিকতায় আচ্ছন্ন হওয়া, তা সত্য হয়নি জয়নুলের ক্ষেত্রে। জীবনবোধের প্রশ্নে জয়নুল প্রান্ত থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হননি, আকৃষ্ট হননি নাগরিক আভিজাত্যে। জন্মভূমি ময়মনসিংহের জনজীবন ও প্রকৃতির প্রতি, অসচ্ছল বৃহত্তর পারিবারিক পরিবেশের প্রতি তিনি ছিলেন আত্মিকভাবে ঘনিষ্ঠ ও শ্রদ্ধাশীল। তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে অধ্যক্ষ মুকুল দে-এর পরামর্শ সত্ত্বেও ইন্ডিয়ান আর্ট বিভাগে ভর্তি না হয়ে পাশ্চাত্যের অ্যাকাডেমিক শিক্ষায় নিজেকে সমৃদ্ধ করলেও শিল্পের বিষয় আহরণ ও ভাষা নির্মাণে বরাবর সংলগ্ন ছিলেন নিজ ভূমি ময়মনসিংহের স্থানিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি। এ ক্ষেত্রে সব সময় তিনি পরিহার করেছেন ইউরোকেন্দ্রিক মানসিকতা।
১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষে যখন গ্রাম থেকে কলকাতায় যাওয়া অনাহারি মানুষগুলোর দুর্দশা ও মৃত্যুকে তিনি দেখলেন, তখন তাঁর আত্মার মধ্যে এ কারণেই বেজে উঠল মহা হাহাকার। তিনি উপলব্ধি করলেন বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাসহ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের ভয়ংকর নিষ্ঠুরতাকে। মৃত্যুতাড়িত মানুষগুলোর প্রতি অনুভব করলেন গভীর ঐকাত্মবোধ। এসব চিত্রে কলকাতার রাজপথের ঘটনা দৃশ্যায়িত হলেও চিত্রের মানুষগুলো নগরকেন্দ্রের সুবিধাভোগী শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত নন, গ্রামপ্রান্ত থেকে কেবল খাদ্যের অন্বেষণে সাময়িকভাবে তাঁরা আগত। নিজে প্রান্তের মানুষ হিসেবে জয়নুল তাই একাত্মতাবোধ করেছেন এদের সঙ্গে। দুর্ভিক্ষ-চিত্র অঙ্কনে তাঁর যে শ্রেষ্ঠত্ব তার মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এই ঐকাত্মচেতনাই।
মন্বন্তর নিয়ে চিত্ররচনাসূত্রে তিনি সম্মুখীন হলেন নতুন এক পরিস্থিতির, নতুন বাস্তবতার। এক অনিবার্য প্রক্রিয়ায় তিনি সংশ্লিষ্ট হলেন এ দেশের প্রগতির ধারার সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সামষ্টিক কার্যক্রমের সঙ্গে। এই যুক্ততার মাধ্যমে তিনি উপলব্ধি করলেন, যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক চেতনার দৈন্য ও সংকট আমাদের অগ্রগতির পথে দুস্তর বাধা, তাকে দূর করতে হলে ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন শিল্পচর্চাই যথেষ্ট নয়; সামাজিক ও সামষ্টিক শৈল্পিক কর্মচাঞ্চল্যই এ ক্ষেত্রে হতে পারে অপরিহার্য ও কার্যকর মীমাংসা। গ্রামসীয় পরিভাষায় তিনি হয়ে ওঠেন ‘অর্গ্যানিক বুদ্ধিজীবী’। জয়নুলের এই দায়বোধ ১৯৪৭-উত্তরকালে এক নতুন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে আরও পরিপক্বতা লাভ করে। ব্যক্তিচিন্তা থেকে সমষ্টিচিন্তাই তাঁর কাছে হয়ে ওঠে মুখ্য। একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, যার মাধ্যমে সমগ্র জাতির মধ্যে শিল্পের প্রসার ঘটানো সম্ভব, সেটিই আচ্ছন্ন করে তাঁর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুকে।
১৯৪৭-এ পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ঢাকা পূর্ববাংলার রাজধানী হিসেবে এক ধরনের কেন্দ্রে পরিণত হলেও সমগ্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ববাংলা মূলত প্রান্ত হিসেবেই বিবেচিত ছিল। কেন্দ্র ছিল করাচি-রাওয়ালপিন্ডি। পাকিস্তানের আধা-উপনিবেশবাদী শাসক-শোষকশক্তির কাছে জয়নুলের অবস্থান অবশ্য দুর্বল ছিল না। পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান শিল্পী হিসেবে তিনি রাষ্ট্রের অধিপতিদের কাছে আদৃত ছিলেন। কিন্তু কখনো কেন্দ্রের মানসিকতা দ্বারা আচ্ছন্ন হননি। তাঁর মনোযোগ ও দৃষ্টি সব সময়ই কেন্দ্রীভূত ছিল প্রান্ত পূর্ববাংলার প্রতি। এই প্রান্তে চারুকলা শিক্ষার পথ প্রশস্ত করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, নানা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে স্থাপন করেছেন প্রান্ত-অনুরাগের দৃষ্টান্ত। পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে যে রক্ষণশীলতা ছিল তাঁর পিচ্ছিল পথ বেয়েই জন্ম নিয়েছিল জাতিগত বৈষম্যের এক অসুস্থ প্রবণতা। বাঙালির বিরুদ্ধে পরিচালিত এই বৈষম্য সম্পর্কে তাঁর সচেতন অবস্থানের মধ্যেই ছিল প্রতিবাদের সুর। এই প্রতিবাদ সরব ছিল না; কিন্তু তিনি তাঁর সব শৈল্পিক কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ও জনগণের কাছে এই বার্তাই পৌঁছে দিয়েছিলেন যে ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে সাংস্কৃতিক চেতনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ। নানা প্রদর্শনীর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের লোকশিল্পের সমৃদ্ধ ভান্ডারকে উপস্থাপন করে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উচ্চতার স্বরূপ উন্মোচন করেন।
দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালার পরে জয়নুলের শিল্পীসত্তার সবচেয়ে আলোকিত উদ্ভাসন আমরা লক্ষ করি পঞ্চাশের দশকে রচিত নারী-চিত্রমালায়। এসব চিত্র দেখলে মনে হয়, কেবল নারী-সৌন্দর্যই তাঁর অন্বিষ্ট নয়, দেশমাতৃকার রূপান্বেষার আন্তর্গরজও এ ক্ষেত্রে সক্রিয়। পাকিস্তানি শাসকচক্রের রক্ষণশীল ও শোষণমূলক মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চাশের দশকে প্রাগ্রসর বাঙালি মানসে জাতিসত্তা সন্ধানের যে সুগভীর আগ্রহ জাগ্রত হয় জয়নুলও তা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। অবশ্য কোনো একটি সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে জয়নুলের এ পর্বের চিত্রকর্মের বৈশিষ্ট্য অনুধাবন সহজ হবে না। এর রয়েছে বিচিত্র মাত্রা। ময়মনসিংহের গীতিকাসমূহে নারীর যে বিশিষ্ট জীবনদীপ্ত রূপ আমরা দেখি, তা থেকে অনুমান করি ওই অঞ্চলে দীর্ঘকাল মাতৃতান্ত্রিক সমাজবৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন ছিল। জয়নুলের পারিবারিক পরিবেশে যে মাতৃপ্রাধান্য ছিল, তা একটি তথ্য থেকে স্পষ্ট হয়। জয়নুলের ভাইবোনদের সবার নামের আদ্যাক্ষর তাঁর মায়ের নামের আদ্যাক্ষরকে অনুসরণ করেছে। এসবের ফলে তাঁর চেতনার গভীরে এক আর্কিটাইপাল নারীরূপ যে অস্তিত্বময় হয়েছিল, তা বোঝা যায়।
নারীর প্রতি শিল্পীর শ্রদ্ধাশীল মনোভাব ছাড়াও এসব চিত্রের অন্যতর আধুনিক বৈশিষ্ট্য স্মরণীয়। লোকশিল্প থেকে উপাদান গ্রহণ করে তাকে আধুনিক স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করার যে আদর্শ দ্বারা চালিত ছিলেন জয়নুল, এ চিত্রসমূহ তারও বাস্তব দৃষ্টান্ত। তা ছাড়া বিশ শতকের শুরু থেকে কিউবিস্টদের হাতে অবয়বের ভাঙচুরের যে প্রক্রিয়া শুরু হয় তার দ্বারাও প্রভাবিত হয়ে জয়নুল এ কালের চিত্রকে নতুন রূপ দান করেন। নারীর অবয়ব সংস্থান কৌশলে তিনি নিয়ে আসেন জ্যামিতিক ফর্মের ভারসাম্যপূর্ণ বিন্যাস। বাঙালি নারীর চলন ও উপবেশনের নানা ভঙ্গিমাকে তিনি জ্যামিতিক নানা ফর্মের আদলে বিন্যাসের মাধ্যমে পরিস্ফুটিত করেন এর সৌন্দর্যকে। এই প্রক্রিয়ায় তিনি উপস্থাপন করেন নকশা গুণেরও অসামান্য দীপ্তি। এসব চিত্র কম্পোজিশনের চমৎকারিত্বেও হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ। বিচিত্ররূপী অবয়বের এই চিত্রগুচ্ছের শিল্পভাষাও স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল।
অবয়বের এই ভাঙচুরের প্রক্রিয়াটি শেষ পর্যন্ত বিমূর্তায়নে পর্যবসিত হতো কি না, সে সম্পর্কে এখন অনুমান করা কঠিন। তবে এটা ঠিক, লোকশিল্পের সঙ্গে বিশ্বশিল্পের আধুনিকতার মিশেল ঘটিয়ে বাংলাদেশের চিত্রকলায় একটি বিরাট সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিলেন জয়নুল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শিল্পচর্চার এই ধারাটি নিয়ে তিনি বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল প্রতিভাশক্তির বিন্দুমাত্র অভাব যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা নয়; প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল তাঁর প্রতিষ্ঠানকে উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিপুল শ্রম ও সময় ব্যয়।
জয়নুল পঞ্চাশের দশকে দুবারে দু-বছরব্যাপী উন্নত বিশ্ব সফর করে তাদের সাম্প্রতিক চিত্রবৈশিষ্ট্য অনুধাবনের সুযোগ পান। কিন্তু এই অনুধাবনও তাঁকে ইউরো-মার্কিন শিল্পকেন্দ্রিকতায় আকৃষ্ট করতে পারেনি। উপনিবেশবাদী কেন্দ্রসমূহের বিশ্বযুদ্ধোত্তর হতাশাক্লিষ্ট চিত্রধারা তাঁকে কেন্দ্রমুখী না করে বরং আরও বেশি প্রান্তমুখী করেছে। দুবারই দেশে ফিরে তিনি আমাদের শিল্পের গতিমুখকে স্বদেশের লোকশিল্প ও লোকজ-ঐতিহ্যসংলগ্ন করার পরামর্শ দিয়েছেন। বিশ্বশিল্পভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এই বোধই ব্যক্ত করেছেন যে বিচ্ছিন্নতার মধ্যে নয়, দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে নিবিড় বন্ধনের মধ্যেই বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পের মুক্তি নিহিত।
জয়নুলের এই লোকজ-ঐতিহ্য সন্ধানের সঙ্গে জাতিসত্তা সন্ধানের বিষয়টি একাত্ম হয়ে পড়েছিল। পাকিস্তান-পর্বে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী তাঁর প্রতিবাদমূলক শিল্প-অভিজ্ঞান এবং আধুনিক শিল্পসম্পর্কিত চেতনা—উভয়ই লগ্ন হয়েছে একই স্রোতধারায়। গত কয়েক দশকে উত্তর-আধুনিক চিন্তাস্রোতে আমরা স্থানিক সংস্কৃতির প্রাধান্য লক্ষ করছি। উপনিবেশের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসন্ধানের আগ্রহকে উত্তর-আধুনিক চিন্তাবিদেরা সবিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। জয়নুলের ঐতিহ্যপ্রিয়তার মূলে ছিল ঔপনিবেশিক পশ্চিমা শাসকশক্তির কাছে পূর্ববাংলার সমৃদ্ধিকে তুলে ধরার মাধ্যমে নিজ সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করা। জয়নুলের এই ভাবনাস্রোত এদিক থেকে অনেকটা উত্তর-আধুনিক চিন্তনক্রিয়ার সহগামী।
‘নবান্ন’ (১৯৭০) ও ‘মনপুরা ৭০’ (১৯৭৩) শীর্ষক তাঁর দুটি দীর্ঘ স্ক্রোলচিত্রেও অভিব্যক্ত হয়েছে কেন্দ্রের অবহেলার শিকার প্রান্তবাসী মানুষের প্রতি শিল্পীর অন্তর্গত সহানুভূতি।
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে প্রথমবারের জন্য কেন্দ্রে পরিণত হলো। ঢাকার অধিবাসী জয়নুল স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রবাসী। কিন্তু এ পর্বেও তাঁর দৃষ্টি প্রান্তের দিকে; প্রান্তকে আলোকিত করার ব্যাপারেই তাঁর সমস্ত মনোযোগ। ১৯৭২—৭৬ কালপর্বে তিনি গড়ে তুললেন শিল্পসংশ্লিষ্ট দুটি প্রতিষ্ঠান। একটি জয়নুল চিত্রসংগ্রহশালা, ময়মনসিংহে; আরেকটি লোকশিল্প জাদুঘর, সোনারগাঁয়ে। ময়মনসিংহ যে তাঁর সত্তার পুরোটা অধিকার করেছিল, ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে, কৈশোরের ছবি আঁকার সেই প্রিয় জায়গাটিতে সংগ্রহশালা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে তিনি তার প্রমাণ রাখলেন। বিষয় ও স্থান নির্বাচনের দিক থেকে সোনারগাঁয়ের লোকশিল্প জাদুঘর হয়ে থাকল তাঁর প্রান্ত-অনুরাগের আরেক সুনিশ্চিত দৃষ্টান্ত।
আপন সত্তার সঙ্গে জয়নুলের এই নিবিড় সম্পর্কটি তাঁর জীবন ও শিল্পবোধকে করেছে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। শুধু শিল্পভাবনায় নয়, এ বিষয়টি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনাচরণেও লক্ষণীয়। আমৃত্যু তাঁর ভাষাভঙ্গিতে সচেতনভাবেই অনুসৃত হয়েছে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক কথ্যরীতিটি। এও তাঁর কেন্দ্র-মানসিকতার বিরুদ্ধে এক প্রকার নীরব প্রতিবাদ। প্রান্তিকতার প্রতি এসব মমত্ববোধের মধ্যেই নিহিত জয়নুলের আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক মনোভঙ্গির সকল বীজ।
তাঁর শিল্পীসত্তার পূর্ণ বিকাশের ফল থেকে বাংলাদেশের চিত্রকলা বঞ্চিত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের শিল্পকলার বিকাশের জন্য প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে তিনি যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তার সুফল ভোগ করছে সমগ্র জাতি। জন্মশতবর্ষে, বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে, তাঁর এই মহান আত্মত্যাগের মহিমাকে তাই আমরা প্রণতি জানাই। আমাদের সমগ্র জাতি এই মহান শিল্পীর প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।