প্রজাপতি প্রজাপতি
কোথায় পেলে ভাই
এমন রঙিন পাখা?
প্রজাপতির রঙিন পাখা নিয়ে যিনি প্রশ্ন করেছেন ‘কোথায় পেলে এমন রঙিন পাখা’, সেই কবি একজন রঙিন মানুষ। মনের রং দিয়ে রচনা করেছেন কত কত গান। গল্প, কবিতা, ছড়া—কোথায় দেননি রঙের ছোঁয়া? উপন্যাস-নাটক-আত্মকথা-স্মৃতিকথা—সবকিছুই রং ছড়ানো, প্রাণ জুড়ানো অনুভূতি দিয়ে সাজিয়েছেন। এই কবি আমাদের বিদ্রোহী কবি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ বছরের ২৫ মে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৪তম জয়ন্তী।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ সন (খ্রিষ্টীয় ১৮৯৯ সাল)। তাঁর ডাকনাম দুখু মিয়া। গরিব পরিবারে জন্ম নেওয়া নজরুল ভারতের আসানসোলের মাথরুন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীর পাট চুকিয়ে কিছুদিন প্রসাদপুরের এক বাঙালি খ্রিষ্টান পরিবারে বাবুর্চির কাজ করেন। আবারও আসানসোলে এসে যখন তিনি একটি রুটির দোকানে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করছিলেন তখন ঘটনাচক্রে তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার পরিচয় পেয়ে কাজী রফিজউল্লাহ নামের পুলিশের এক কর্মকর্তা তাঁকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেন। কিছুদিন পরই তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানায় দারোগা হিসেবে বদলি হলে নজরুলকেও সঙ্গে নিয়ে কাজীর সিমলা গ্রামে আসেন। ১৯১৪ সালের জানুয়ারি মাসে ত্রিশালের দরিরামপুর হাইস্কুলে নজরুলকে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেওয়া হয়। নিজ গুণেই নজরুল বিনা বেতনে লেখাপড়ার সুযোগ পান। কিন্তু সেখানে তাঁর মন টেকেনি। দুরন্ত নজরুল ত্রিশাল ছেড়ে চলে আসেন চুরুলিয়ায়।
বাঙালির কবি নজরুলের প্রথম কবিতা ছাপা হয় ১৯১৯ সালে। তখন তাঁর বয়স ২০। কবিতাটির নাম ছিল ‘মুক্তি’। রবীন্দ্রনাথ নবীন বয়সী নজরুলকে ‘কবি’ বলেই সম্বোধন করতেন। মজার একটা বিষয় খেয়াল করো–রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল দুজনেই কবি। দুজনের জন্ম মে মাসে। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে নজরুল ৩৮ বছরের ছোট ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি। নজরুল বিদ্রোহী কবি। রবীন্দ্রনাথ বেঁচেছিলেন ৮০ বছর। নজরুল বেঁচে ছিলেন ৭৭ বছর। দুজনেরই মৃত্যু হয় আগস্ট মাসে। রবীন্দ্রনাথ অনেক স্নেহ করতেন নজরুলকে । রবীন্দ্রনাথ যেমন ছিলেন নজরুলের ভক্ত, তেমনি নজরুলও ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভক্ত।
কবি বিদ্রোহ করেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। লিখেছেন বিদ্রোহী কবিতা। এই কবিতা আমাদের সবার জানা।
বল বীর—
বল উন্নত মম শির।
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর—
এই বিদ্রোহী কবিতাটি কবি লিখেছেন ১৯২১ সালে। কবি শান্তির জন্য যুদ্ধ করেছেন। নজরুল বাংলা ভাষার প্রথম কবি, যাঁকে কবিতার জন্য জেলে যেতে হয়েছে। আমাদের জাতীয় রণসংগীত ‘চল্ চল্ চল্’ নজরুলের রচনা থেকে নেওয়া। তিনি চেয়েছেন শান্তিময় নতুন ভোর। তাই তো তিনি লেখেন, ‘ভোর হোলো দোর খোলো/ খুকুমণি ওঠ রে/ঐ ডাকে জুঁই-শাখে ফুলখুকী ছোট রে।’ এ কবিতাটির নাম ‘প্রভাতী’। ‘প্রভাতী’ কবিতাটা স্কুলের বইতে পড়তে পড়তে অনেকের মুখস্থ হয়েছে, তাই না? অথচ দেখো, কবির কিন্তু দেওয়া হয়নি স্কুলের শেষ পরীক্ষা। কিন্তু নজরুলের লেখা ছাড়া আমরা কি পরীক্ষায় পাস করতে পারব? পড়তেই হবে আমাদের। ছোট থেকে বড়—সব বয়সীদের জন্য আছে তাঁর লেখা।
নজরুলের স্মৃতিতে ময়মনসিংহের কাজীর সিমলা গ্রাম, দরিরামপুর স্কুল দারুণভাবে জড়িয়ে আছে। তাই তো বড় হয়ে লিখেছেন—‘ময়মনসিংহ জেলার কাছে আমি অশেষ ঋণে ঋণী। আমার বাল্যকালের অনেকগুলি দিন ইহারই বুকে কাটিয়া গিয়াছে... আজও আমার মনে সেই সব প্রিয় স্মৃতি উজ্জ্বল ভাস্বর হইয়া জ্বলিতেছে।’
নজরুলের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ত্রিশালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে নজরুলের নামে জাদুঘরও আছে।
ময়মনসিংহ ছাড়াও কবি নজরুল এই বাংলাদেশে এসেছেন ঢাকায়, চট্টগ্রামে। থেকেছেন বরিশাল, কুমিল্লা, ফরিদপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, বগুড়া, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুরে। ছোটদের জন্য নজরুল অনেক মজার মজার গল্প ও কবিতা রচনা করেছেন।
নজরুল মাত্র ২২ বছর লেখালেখি করেছেন। তারপর থেমে যায় তাঁর লেখনী। তিনি আর লিখতে পারেননি। কথাও বলতে পারেননি। কিন্তু ওই ২২ বছর বয়সের মধ্যে নজরুল আমাদের যা দিয়েছেন, আমরা সেই পথ ধরে এগোতে চাই। সেটাই আমাদের অহংকার।
আমাদের সাহসের প্রেরণা হয়ে আছেন তিনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় বোধশক্তিহীন নির্বাক কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় ১৯৭২ সালের ২৪ মে। ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কে অবস্থিত যে বাড়িতে নজরুল থাকতেন সে বাড়িটির নাম ‘কবিভবন’। এ বাড়িতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান নজরুল ইনস্টিটিউট। সমপ্রতি কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র। এখানে তাঁর আনন্দ ও বেদনার বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এখানকার প্রকৃতি, মাটি ও মানুষকে গভীরভাবে ভালোবেসেছেন তিনি। রচনা করেছেন অনেক কালজয়ী গান, কবিতা, ছড়া। সবার প্রিয় ‘খুকু ও কাঠবিড়ালী’ কবিতাটি তিনি কুমিল্লাতেই লিখেছেন।
নজরুল বাংলা ও বাঙালির প্রিয় কবি। তাঁর কবিতার প্রতিটি পঙিক্ত যেন জল তরঙ্গে ঝিলিমিলি। তাই তো বাঙালির জন্য বিদ্রোহী নজরুল লিখেছেন—
“এই পবিত্র বাংলাদেশ
বাঙালির—আমাদের।
বাংলা বাঙালির হোক।
বাংলার জয় হোক।
বাঙালির জয় হোক।
আমাদের জাতীয় কবি নজরুল চেয়েছিলেন বাংলা ও বাঙালির জয় হোক। আজ যারা শিশু, একদিন বড় হয়ে বাংলা ও বাঙালির বিজয়ের গৌরবে-সৌরভে গড়ে তুলবে আমাদের এই দেশ বাংলাদেশ। আমরা নজরুলের মতো হব সাহসী। নজরুলের মতো বিদ্রোহী।