
কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রয়াণ দিবস আজ। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার স্মৃতিচারণা থাকল এই লেখায়।
১৯৭২ সাল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সম্মানে গণসংবর্ধনার আয়োজন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর। আমি ও আমার বন্ধু, নারায়ণগঞ্জের খানসাহেব ওসমান আলীর পুত্র সফিউদ্দিন সারওয়ারের সঙ্গে ওই সংবর্ধনায় দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুসহ মঞ্চে আরোহণ করেন। মনে আছে, দীর্ঘদেহী সুপুরুষ বঙ্গবন্ধুকে দেখে তখন খুব গর্বিত অনুভব করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময় তোমারি হউক জয়’—সমবেত কণ্ঠে এই গান দিয়ে উপস্থিত লাখো দর্শক–শ্রোতার গগণবিদারী কণ্ঠে অনুষ্ঠানটি শুরু হলো।
অনুষ্ঠান শেষে আমাদের পূর্বপরিচিত ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র এক আলোকচিত্রশিল্পীকে কবি নজরুল ইসলামের বাসায় নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলাম। কলকাতায় কবির বাড়িতে পৌঁছে দেখি, সাধারণ পুরোনো ফ্ল্যাট বাড়ির নিচতলায় একটি জরাজীর্ণ কক্ষে চৌকিতে নির্বাক বসে আছেন নজরুল। আমার মানসপটে অনেক দিনের লালিত বিদ্রোহী কবিকে এহেন অবস্থায় দেখে খুবই মর্মাহত হলাম। কম্পিত হাতে অতি সংকোচে মালা পরিয়ে তাঁর পাশে বসলাম। আলোকচিত্রশিল্পী আমার অনুরোধে এ সময় দুটি ছবি তুললেন। আমার সারা শরীর শিহরিত হচ্ছিল, কবির পাশে বসে আছি! কবি ফ্যালফ্যাল চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। একেবারেই অনুভূতিহীন।
ফেরার পথে অনেক কিছু আছড়ে পড়ল মনের মধ্যে। মনে হলো, যাঁকে আজ দেখলাম, এই তো সেই নজরুল, যিনি ব্রিটিশরাজকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের সাহিত্যে বিস্ময়কর প্রতিভাবান এই মানুষটি আনলেন চির বিদ্রোহের বাণী। বলা বাহুল্য, নজরুলের লেখনী অত্যাচারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে হয়ে দাঁড়িয়েছিল ক্ষুরধার তরবারি। ফলে শাসকেরা কবিকে বারবার কারাগারে নিক্ষেপ করল। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস বলেছিলেন, ‘কারাগারে আমরা অনেকেই যাই, কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে সেই জেল জীবনের প্রভাব খুব কম দেখতে পাই। তার কারণ অনুভূতি কম, কিন্তু নজরুল যে জেলে গিয়েছিলেন, তার প্রভাব তাঁর লেখার অনেক স্থলেই পাওয়া যায়। এতেই বোঝা যায় যে তিনি একটি জ্যান্ত মানুষ। আমি সারা পৃথিবীতে ঘুরেছি। বহু দেশের জাতীয় সংগীত, দেশাত্মবোধক গান শুনেছি। কিন্তু ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’ এই রকম রক্তজাগানিয়া গান কোথাও শুনিনি, জেলখানায় বসে আমার মতো বেরসিক লোকও গুনগুন এই গান গেয়েছি, এই গান গেয়েই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি।’
‘আপনারে ছাড়া কাহারে করি না কুর্নিশ’ অত্যাচারীর বিরুদ্ধে এমন ভাষায় আর কোনো বাঙালি কবি চ্যালেঞ্জ জানাননি। সমাজের উৎপীড়নে এমন শপথ আর কারও মুখে শুনিনি, ‘শক্রকে শেষ না করা পর্যন্ত যুদ্ধ করব’।
একক লেখক হিসেবে সমসাময়িক কালে নজরুল ইসলামের রচনাই সবচেয়ে বেশি শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছিল। ‘শনিবারের চিঠি’র সজনীকান্ত সেন লিখেছিলেন, ‘স্বদেশ আন্দোলনের মুখে রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ কবিগণ যেভাবে বহুবিধ সংগীত ও কবিতার সাহায্যে বাঙালির দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলেন, অসহযোগ আন্দোলনের বৃহত্তর বিপ্লবে যে কারণেই হউক তাঁহারা ঠিক সেভাবে সাড়া দেন নাই, একমাত্র নজরুলই ছন্দে–গানে এই আন্দোলনকে জয়যুক্ত করিয়াছিলেন। পরবর্তী আন্দোলনের চারণ-কবি তাঁহাকেই বলা যাইতে পারে।’
সেদিন প্রিয় কবি কাজী নজরুলের বর্তমান অবস্থা দেখে খুউব অস্বস্তি বোধ করছিলাম। তাঁকে দেখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কথা মনে হলো। বিদ্রোহী নজরুল যেমন বারবার ব্রিটিশের কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন, তেমনি আমাদের শেখ মুজিবও পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসক দ্বারা দীর্ঘ সময় কারা–অন্তরীণ ছিলেন। পরবর্তীকালে এই বঙ্গবন্ধুই নিজ প্রচেষ্টায় অবহেলিত নজরুলকে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে এনে ধানমন্ডিতে কবিভবনে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কবি নজরুলকে জাতীয় কবির আসনে সমাসীন করেন।
নজরুল–প্রসঙ্গে অনেক কিছুই তো মনে পড়ছে এখন। মনে পড়ছে, ১৯২৩ সালে ‘ধূমকেতু’র সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলামকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে কোমরে দড়ি ও হাতকড়া দিয়ে কলকাতায় আনা হয়। কলকাতার তদানীন্তন চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে বিচার হয় (সুইনহো নিজেও কবি ছিলেন) ওই বছরের ১৭ জানুয়ারি মামলার রায় দেন সুইনহো। রাজদ্রোহের অভিযোগে কবিকে সাধারণ কয়েদির পর্যায়ে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন তিনি।
এখানে খানিকটা ক্ষোভ নিয়েই বলি, নিজে কবি হয়েও সুইনহো কবি নজরুলকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত কয়েদি করেনি। তবে এই মামলায় আদালতে নজরুল যে সাক্ষ্য দেন, সেটিও এক অনন্য সৃষ্টি: ‘আমার উপর অভিযোগ আমি রাজবিদ্রোহী...একাধারে-রাজার মুকুট, আর ধারে ধূমকেতুর শিখা, একজন রাজা, হাতে রাজদণ্ড; আর একজন সত্য, হাতে ন্যায়দণ্ড। শুনেছি, আমার বিচারক একজন কবি, শুনে আনন্দিত হয়েছি। বিদ্রোহীর কবির বিচার, বিচারক কবির নিকট। কিন্তু বেলাশেষের শেষের খেয়া এ প্রবীণ বিচারককে হাতছানি দিচ্ছে, আর রক্ত উষার নবশঙ্খ আমার অনাগত বিপুলতাকে অভ্যর্থনা করছে; তাকে ডাকছে মরণ, আমায় ডাকছে জীবন;...আমার অসমাপ্ত কর্তব্য অন্যের দ্বারা সমাপ্ত হবে। সত্যের প্রকাশ পীড়া নিরুদ্ধ হবে না...তারপর মাভৌঃ। ভয় নাই।’
না, নজরুল ভয় পাননি। কখনোই পাননি। সেই ’৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সংবর্ধনা সভায় গিয়ে এক ফাঁকে কবিকে দেখার পর এ কথাটি মনে হয়েছিল আমার। মনে হয় এখনো। তবে এখনো খারাপ লাগে এই ভেবে যে ভারতের স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে কলকাতায় বালিগঞ্জ আবাসিক এলাকায় নজরুলকে শাস্তি দেওয়া সেই ব্রিটিশ বিচারক সুইনহোর নামে ‘সুইনহো রোড’টি আজও সদর্পে বিরাজমান।
অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com