Thank you for trying Sticky AMP!!

নানা আলোয় কাজী মোতাহার হোসেন

কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই ১৮৯৭—৯ অক্টোবর ১৯৮১)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

নিঃশঙ্ক সমাজভাবুক ও অনলস জ্ঞানতাপস কাজী মোতাহার হোসেনের (৩০ জুলাই ১৮৯৭—৯ অক্টোবর ১৯৮১) ১২০তম জন্মবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ্যরূপে গুণী গবেষক আবুল আহসান চৌধুরীর সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশ পেয়েছে প্রগতি মননের তপস্বী শীর্ষক স্মারক পুস্তক। এর আগেই তাঁরই সম্পাদনায় প্রবন্ধসংগ্রহ: কাজী মোতাহার হোসেন (২০০৭), কাজী মোতাহার হোসেন: জীবন ও সৃষ্টি (২০০৭) এবং কাজী মোতাহার হোসেন রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে। প্রগতি মননের তপস্বী

সম্বন্ধে সম্পাদক বলছেন, এটি কাজী মোতাহার হোসেন: জীবন ও সৃষ্টি স্মারকের পরিপূরক, তবে লেখক-সমাবেশে ও বিষয়বৈচিত্র্যে আলোচ্য বইটি একেবারেই অনন্য। সম্পাদক কাজী মোতাহার হোসেনকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন তাঁর বহুমাত্রিক জীবন ও সৃষ্টির পরিচয় ও পরিসরে:

আজীবন তিনি জ্ঞানের সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন, মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে এসেছেন, দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে পালন করেছেন বিবেকী ভূমিকা। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নের শিক্ষক, পূর্ববঙ্গে পরিসংখ্যানবিদ্যা পাঠনের জনক, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানশিক্ষার পথিকৃৎ, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেতৃপুরুষ। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাংলার পক্ষে দৃঢ় সমর্থন, আধুনিকমনা ও প্রগতিশীল তরুণ সাহিত্যসেবীদের নেতৃত্বদান, পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রবর্জনের বিরোধিতা ও অন্যান্য গণবিরোধী সাংস্কৃতিক নীতির প্রতিবাদ, বাংলা নববর্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণার দাবিসহ বাঙালি সংস্কৃতিচর্চায় সক্রিয় অংশগ্রহণ, মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সংহতি প্রকাশ, দাবা খেলায় নৈপুণ্য প্রদর্শন ও জাতীয় পর্যায়ে এই খেলাকে জনপ্রিয় করে তোলার ‘দাবাগুরু’ আখ্যালাভ—এসব কিছুই কাজী মোতাহার হোসেনের অর্জন ও অবদান এবং তাঁর মুক্ত মন-মনন-মানসের দ্যোতক।

চার পর্বে বিভাজিত স্মরণগ্রন্থের স্মৃতি-সান্নিধ্য অংশে কাজী মোতাহারের কন্যা-পুত্র সন্​জীদা খাতুন, কাজী আনোয়ার হোসেন, কাজী মাহবুব হোসেন, মাহ্​মুদা খাতুন যেমন লিখেছেন, তেমনি আবদুর রাজ্জাক, কবীর চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, নাসির আলী মামুনের মতো বিভিন্ন প্রজন্মের সান্নিধ্যপ্রাপ্ত মানুষের স্মৃতিকথন সমবেত হয়েছে। মফিজ ইমাম মিলনের অনুলিখনে এক দুর্লভ স্মৃতিভাষ্যে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মূল্যায়নবিন্দুতে উদ্ভাসিত মোতাহার মানসসিন্ধু:

বাইরে আর যাই থাকুক তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। তবে স্বাধীন বিচারবুদ্ধি দিয়া বিচার করতেন। গোঁড়ামি পছন্দ করতেন না। আরবি-ফারসি বেশ ভালো জানতেন। কোরআন শরিফ নিজে অনুবাদ করতেন। মুসলমান বলে মুসলিম লীগে বিশ্বাসী হতে হবে এটা মানতেন না। (পৃ. ১৯)।

‘আনন্দ ও মুসলমান গৃহ’ নামে খ্যাতকীর্তি প্রবন্ধের প্রসঙ্গ তুলে তাঁর পুত্র কাজী আনোয়ার হোসেন আপন গৃহের যে রসমধুর বৃত্তান্ত উপস্থাপন করেন, তা পাঠককে স্পর্শ করে:

আব্বুকে দেখা মাত্র আমরা একেকজন একেক দিকে সটকে পড়ার চেষ্টা করতাম। আব্বুকে দেখলেই আম্মু ঠাট্টা করে বলতেন, ‘এই যে এসেছেন গিরিহের আনন্দ! কে কোথায় পালিয়ে বাঁচবে দিশে পাচ্ছে না!’ (পৃ.৬৬)।

.

‘শিক্ষক পিতা’ লেখায় সন্​জীদা খাতুন অঙ্কন করেন সেই কাজী মোতাহারের প্রতিকৃতি, যে পিতা অনায়াসে তাঁর কন্যার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে ছাত্রীহলের মাঠে গিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলায় অংশ নিতে পারেন এবং যার ভেতর থাকে পিতার সংবেদন এবং শিক্ষকের কর্তব্যবোধ উভয়ের মিলিত রসায়ন।

‘নিরীক্ষণ’ এবং ‘মূল্যায়ন’ পর্বে আবদুল্লাহ আল-মুতী, হালিমা খাতুন, কন্যা ফাহ্​মিদা খাতুন, শামসুজ্জামান খান, আবদুল মান্নান সৈয়দ,                    শান্তনু কায়সার, জহুরুল হক ও আবুল আহসান চৌধুরীর লেখায় তাঁর সত্তার পূর্ণায়ত অবয়ব উঠে আসে।

মোবাশ্বের আলীর লেখায় নজরুল ও তাঁর ‘প্রিয় মোতিহার’-এর সম্পর্ক, সালেহ চৌধুরী ও রানী হামিদের লেখায় দাবাগুরুর আনুপূর্বিক পরিচিতি ও মূল্যায়ন; খোন্দকার সিরাজুল হক, এ. এম. হারুন অর রশীদ ও সুলতান আহমদের লেখায় বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রেক্ষাপটে কাজী মোতাহারের বিজ্ঞানরচনা ও বিজ্ঞানী-সত্তার বিশ্লেষণ; শিখা আরেফীনের লেখায় প্রবন্ধকার মোতাহার আর দুই প্রজন্মের লেখক সৈয়দ নুরুদ্দিন ও মোহাম্মদ আজমের পৃথক মূল্যায়নে তাঁর সঞ্চরণ গ্রন্থকে ফিরে দেখা সম্পন্ন হয়েছে। বইয়ের মূল্যবান পরিশিষ্টে সন্​জীদা খাতুনের সংগ্রহ ও গ্রন্থনায় কাজী মোতাহার হোসেনের বিশদ জীবনপঞ্জি বিধৃত হয়েছে, যেখান থেকে প্রকৃত এক রেনেসাঁ-মানবের স্বরূপ উন্মোচন সম্ভব, যিনি তাঁর সমকালে উচ্চারণ করেছেন এই চির-সমকালীন প্রগতিমননের দর্শন:

আমরা কল্পনা ও ভক্তির মোহ-আবরণে সত্যকে ঢাকিয়া রাখিতে চাই না। আমরা চাই জ্ঞান-শিখা দ্বারা অসার সংস্কারকে ভস্মীভূত করিতে এবং সনাতন সত্যকে কুহেলিকামুক্ত করিয়া ভাস্বর ও দীপ্তিমান করিতে। (শিখা, মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক মুখপত্র, ১৩৩৫)।

প্রগতি মননের তপস্বী
সংকলন ও সম্পাদনা: আবুল আহসান চৌধুরী
প্রচ্ছদ: সেলিম আহ্​মেদ, প্রকাশক: পাঠক সমাবেশ, ঢাকা
প্রকাশকাল: জুলাই ২০১৮, ২৭২ পৃষ্ঠা, ৬৯৫ টাকা।