কোলাজ

পৃথিবীর বয়স বাড়ছে, হয়তো

আলতাফ হোসেন
আলতাফ হোসেন

দুই হাজার এক থেকে বছর আড়াই লিখে গেছি এই ‘অন্য আলো’র পাতায় ঘুরে বেড়ানো, ছবি-নাটক ও নানা অনুষ্ঠানকে উপজীব্য করে। তারপর যখন মনে হয়েছে একসময় যে এবার থামা উচিত, বন্ধ করেছি লেখা। এত দিনও লিখেছি নানা বিষয়ে নানা কাগজে, নানা জায়গায়, আপন মনে। এখন আবার এখানে গদ্য লেখার আমন্ত্রণ পেয়ে ইচ্ছা হলো লেখার।

রাজনীতি আমার বিষয় নয়, কিন্তু শহর নিয়ে লিখতে পারি। সময় নিয়ে। পরিপার্শ্ব নিয়ে। রাজনীতিও তাতে ফেলতে পারে ছাপ। তবে স্বাধীনতাও চাই লেখার ব্যাপারে। আমার লেখা মেনে নেয় না, চাপিয়ে দেওয়া মতো। আমার আগের লেখার শিরোনাম ছিল, ‘শহর ঢাকার কথকতা’। সেখানেও স্বাধীনতা ছিল নিরঙ্কুশ। তখন নিজের তাগিদেই যেতাম নানান অনুষ্ঠানে, বিশেষত ফরাসি, জার্মান ও আরও নানান ভাষার ছবি দেখতে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, গ্যেটে ইনস্টিটিউটে ও রাশিয়ান কালচারাল ইনস্টিটিউটে। সেসব নিয়ে লিখতাম। নানান ভাবনা এসে ঠাঁই করে নিত।

খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল সময়। হয়ে পড়েছে। দিনে দিনে। ২০০১-০৩-এর কথা মনে পড়ছে। যাতায়াতের কথা বলি। পরের বছরগুলোর তুলনায় অনেক সহজ ছিল চলাচল। আজিমপুরের কর্মস্থল থেকে মিরপুরের বাসায় ফিরে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে চলে গেছি কোনো না-কোনো অনুষ্ঠানে, ফিল্ম শোতে। মূলত বাসই ছিল বাহন। কত রকমের বাস ছিল, কত রুটের বাস। এসি বাসও চলেছে কিছু দিন। সিটিং বাস ছিল। সেগুলো দু-তিন বছর আগেও নিয়ম মান্য করে চলেছে। সিট ভরে গেলে দরজা বন্ধ করা হয়েছে কী সুন্দর, সিট হিসাব করে যাত্রী বহন করা হতো! উঠতে-নামতে কতই স্বাচ্ছন্দ্য।

তারপর কী হতে লাগল শহরটিতে! দুঃস্বপ্নের মতো পাল্টে যেতে লাগল সবকিছু। শুধু কি ঢাকা শহর, চাটগাঁতে প্রায়ই যাওয়া পড়ত। বাসে কিংবা ট্রেনে। অন্য কয়েকটি শহরেও যাওয়া পড়ত অফিসের প্রোগ্রামে, বেড়ানোর ইচ্ছায়। শহরের তুলনায় আন্তনগর সড়কের অবস্থা কোনো কোনো পথে ভালোও হচ্ছিল, কিন্তু বাস, ট্রাক ও অন্য যানবাহনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছিল এবং রাস্তার অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হচ্ছিল বলেই নিশ্চয় চলাচল হয়ে পড়ছিল স্থবির, অস্বাস্থ্যকর। বই থাকত সঙ্গে, কিন্তু কতক্ষণ পড়া যায় নিশ্চল ও অনিশ্চিত অবস্থানে? বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের কয়েক বছর চাটগাঁ-ঢাকা করেছি অনেকবার, পাঁচ ঘণ্টায়, ক্বচিৎ ছয় ঘণ্টায়। বিশ্বাস হয়? আমি কেন এসব লিখছি, আমার চেয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কম? আমি জানি না, কিন্তু বিস্ময় মানি, এসব নিয়ে কাউকে বিশেষ লিখতে দেখিনি, বলতে শুনিনি।

বের্টোল্ট ব্রেশটের মাদার কারেজ নাটকের একটি দৃশ্য

ন্যাগিং কার ভালো লাগে? আমারও লাগে না। তবু ন্যাগিং কে না করেন, ন্যাগিংয়েরও জায়গা আছে জীবনে। একটি আধুনিক শহরে জীবন তোলপাড় করা নাটকের শো হচ্ছে না মাসের পর মাস, ভাবা যায়? আমরা এগিয়ে থাকা বা আভঁ-গার্দ ছবি কোনো আয়োজনের মাধ্যমে নিয়মিত দেখার সুযোগ পাওয়া থেকে বহুদিন, ছবিগুলোর নামও শুনতে পাচ্ছি না যেন দিনের পর দিন। কত কত বছর আগে ইয়েনেসকোর নাটক দেখেছি আমরা ঢাকায়, ব্রেশটের নাটক চলেছে এ শহরে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, পোলানিস্ক, কুরোশাওয়া, চুখরাই, বার্গম্যান, পাসোলিনি, বার্তোলুচ্চি, বুনুয়েল, ত্রুফো এসব নাম ক্রমেই ঝাপসা হতে শুরু করেছে, হারিয়ে যেতে বসেছে যেন। এটা ঠিক যে এখনকার দিনে এদের ছবি দেখতে পাওয়া অনেক সহজ হয়েছে ঘরে বসেই, আন্তর্জাল, ডিভিডির কল্যাণে। কিন্তু দেখা যে হচ্ছে সেভাবে তা কীভাবে বলি? ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতি সামাজিক নেটওয়ার্কেও কী পাওয়া যাচ্ছে তার ছাপ বা তেমন আভাস?

পৃথিবীর বয়স বাড়ছে। আমরা জেনেছি, এত দিনে কোনো কিছু দেখেই খুব উচ্ছ্বসিত হতে হয় না, কোনো কিছু ঘটলেই চরম হতাশ। এখনো জানছি একটু একটু...

বের্টোল্ট ব্রেশটের মাদার কারেজ নাটকের একটি বিখ্যাত কবিতা মনে পড়ে গেল। অকারণে। কিংবা চমকে দেওয়া কথা বলতেন, সে কারণে।

রাজা সলোমন একদিন উপলব্ধি করলেন সবই অসার। মানেটানে নেই। আহা, কী মহৎ এবং উদারই না ছিলেন তিনি! কিন্তু বিশ্বভুবন অপেক্ষা করল না। যা ঘটার তা ঘটে চলল। সলোমন তো জানতেনই সবকিছু, প্রাজ্ঞ যেমন তিনি। কিন্তু মহত্ত্ব ও প্রাজ্ঞতা? এসব না থাকলেই যেন ভালো। হাউ ফরচুনেট দ্য ম্যান উইথ নান। সম্রাট সিজারের ছিল সাহস। এটাও গুণবাচক। কিন্তু দেখা গেল তাঁরও জীবনে নেমে এসেছে দুর্ভাগ্য। স্তবকের শেষে এক উপসংহার: ভীরুই ভাগ্যবান। আচ্ছা, সক্রেটিস? সক্রেটিস বিষয়ে কী কথা এই কবিতায়?

তোমরা শুনেছ সৎ সক্রেটিসের কথা,

মিথ্যা যিনি বলতেন না কখনো,

শাসকেরা কি তাতে কৃতজ্ঞ থাকত, ভাবো?

বরং ওরা তাঁর বিচার করবে বলে

হাতে তুলে দিল বিষাক্ত শরবত,

জনতার প্রিয় মহৎ লোকটির হাতে।

বিশ্ব কিন্তু অপেক্ষা করল না,

দেখল তাকিয়ে কী হচ্ছে পরিণতি

সততাই মূলে এমন সমাপ্তির,

সৌভাগ্য তারই যার সততা বলতে নেই।