প্রেমের গল্প

ফেলে যাওয়া রুমালখানি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বিকেলবেলা বাঁশবাগানের ওদিকটায় গিয়েছিল মৌ। ফাল্গুন মাসের এই সময়টা ভারি সুন্দর। বসন্তকাল। গাছে গাছে ফুল, পাতার রং বদলে গেছে। হাওয়ায় তোলপাড় করে বাঁশবন। একটানা ডাকে কোকিল। মন উদাস হয়।
উদাস মনে বাগানে ঘুরে বাড়ির দিকে ফিরেছে মৌ। উঠোনের কোণে সন্ধ্যামালতির ঝাড়। পাপড়িগুলো সারা দিন ঘুমিয়ে থাকে। বিকেল শেষ হয় আর জাগে, সন্ধ্যা হয় আর গন্ধ ছড়ায়।
উঠোনে এসে সন্ধ্যামালতির গন্ধ পেল মৌ। বারান্দায় দেখতে পেল জরি বসে আছে। হাতে চায়ের কাপ। মা এ সময় চা খায়। জরি এসেছে দেখে তাকেও দিয়েছে এক কাপ।
মৌকে দেখে হাসল জরি। তুমি বাড়ি এসেছ শুনেই এলাম। অনেক দিন তোমার সঙ্গে দেখা হয় না। ভালো আছ?
মৌও হাসল। খুব ভালো আছি। বাড়ি এলেই আমার মন ভালো থাকে।
তাই তো থাকার কথা। মা-বাবাকে ছেড়ে দূরে থাকতে কার ভালো লাগে! তার ওপর পড়াশোনার চাপ, হলের খাওয়া-দাওয়া ভালো না। ছুটিছাটায় বাড়ি এলে ভালো তো লাগবেই।
দুহাতে কাপ ধরে চায়ে চুমুক দিল জরি। সেই ফাঁকে তাকে খেয়াল করে দেখল মৌ। পরনে হালকা সবুজ শাড়ি। সাদা লম্বা ওড়নায় গলা মাথা ঢাকা। জরির চোখ খুব সুন্দর। মুখটা বিষণ্ন। তবু চেহারা যে একসময় ভালো ছিল বোঝা যায়। গায়ের রংও ফরসার দিকেই ছিল। রোদে পুড়ে ম্লান হয়েছে।
তাই হওয়ার কথা। রোদে বৃষ্টিতে এই গ্রাম ওই গ্রাম ঘুরে গরিব মানুষের বাচ্চাকাচ্চা পড়ায়। সারা দিনই ওই কাজ। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়া মানুষ। বাচ্চাকাচ্চাদের অ আ পড়ায়। পয়সা পায় সামান্যই। কোথাও কোথাও পায়ও না। দুপুরবেলা হয়তো ভাতটা খাওয়াল কেউ। বিকেলবেলা চা-নাশতাটা। কোনো কোনো দিন বাড়িও ফেরে না। সন্ধ্যাবেলা বাচ্চা পড়িয়ে ওই গৃহস্থের বাড়িতেই থেকে গেল। তারা হয়তো রাতের খাবারটা দিল। পুরো নাম জরিনা। পরিচিত ছেলেমেয়েরা ডাকে জরিবু।
মৌও তাই ডাকে।
জরি কথা বলে খুব মিষ্টি করে। মুখে হাসিটা লেগেই আছে। গরিব গৃহস্থবাড়ির মেয়ে। বিয়েও হয়েছিল। কিন্তু...
মা-বাবা গত হয়েছে বহুদিন। ভাইবোন যে যার সংসারে। বাপের ভিটেয় একখানা কুঁড়েঘরও জরির আছে। জ্বরজ্বারি হলে, বাড়ি থেকে বেরোতে না পারলে ওই ঘরটায় থাকে। নিজে রান্না করে খায়। দুই ভাই ভাবিরা, তাদের বাচ্চাকাচ্চারা ফিরেও তাকায় না ওর দিকে।
মৌ বলল, তুমি এসে খুব ভালো করেছ জরিবু। আমিও বাড়ি এলাম, বাবা ঢাকায় গেলেন কলেজের কাজে। প্রিন্সিপাল সাহেবদের দৌড়াদৌড়ির অন্ত নেই। কলেজের চেয়ে শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়—ওসব জায়গায়ই থাকতে হয় বেশি। তুমি আজ আমাদের বাড়িতে থাকো। রাতভর গল্প করব দুজনে।
জরি হাসল। আচ্ছা বুবু, থাকব।
জরির কোলে বহুদিনের পুরোনো একটা ব্যাগ। গেরুয়া রঙের চটের ব্যাগটায় শাড়ি, গামছা, সায়া, ব্লাউজ এসব থাকে। একনাগাড়ে কয়েক দিন বাড়ি ফেরা না হলে কোনো বাড়িতে নাওয়া-ধোওয়া সেরে শাড়ি বদলায়। পরনের শাড়ি ধুয়ে ওই বাড়িতেই শুকাতে দেয়। ভবঘুরে নারীর জীবন।
এই বাড়িতে কাজের ঝি আছে একজন। মধ্যবয়সী মহিলা। বিলুর মা। সে এখন রান্নাঘরে। মা রান্নাঘরের দিকে গেলেন তদারক করতে। বিলুর মা রান্না করে ভালোই। তবু মেয়ে বাড়ি এলে মা তার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত হন। আজ রাতে পোলাও আর দেশি মুরগি রান্না হচ্ছে। ঢাকায় দেশি মুরগির বেশ দাম। তা-ও দেশি বলে পাকিস্তানি কক মুরগি চালিয়ে দেয়। আর বয়লার মুরগি তো আছেই। ওসব খেতে খেতে মুখ পচে গেছে মৌর। আজকাল গ্রাম এলাকায়ও দেশি মুরগির অভাব। তবু মেয়ে বাড়ি আসছে শুনলে বাবা তার পিয়ন মোয়াজ্জেমকে বলে মুরগি জোগাড় করে রাখে।
ফাল্গুন মাসের সন্ধ্যা হয় হয় সময়ের আলোটা অপূর্ব। সেই আলোয় মৌ যেমন দেখছিল জরিকে, জরিও দেখছিল মৌকে। কী সুন্দর মেয়েটি! পাঁচ ফুট সাত-আট ইঞ্চি লম্বা, উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং, টানা সুন্দর চোখ, মুখটা এমন, তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। হাসলে মনে হয় শিউলি ফুটেছে থরে-বিথরে। ফিগার ভারতীয় নায়িকাদের মতো। বেগুনি রঙের সালোয়ার-কামিজে দারুণ মানিয়েছে। একদম রাজবাড়ির মেয়েদের মতো।
সেই বাড়ির কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস পড়ল জরির। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপ হাতে উঠল।
মৌ বলল, কোথায় যাচ্ছ?
কাপটা ধুয়ে রাখি।
তোমার ধুতে হবে কেন? বুয়া ধোবে। রেখে দাও।
বুয়া রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত। আমিই ধুয়ে রাখি।
কলতলায় গিয়ে কাপটা ধুয়ে রান্নাঘরে রেখে এল জরি। তারপর ব্যাগ থেকে স্পঞ্জের এক জোড়া স্যান্ডেল আর গামছা বের করে আবার গেল কলতলায়। হাতমুখ ধুয়েমুছে, স্যান্ডেল পায়ে ফিরে এল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন চলো তোমার ঘরে গিয়ে বসি।
মৌ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ওই দেখো কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে। ঢাকায় এত সুন্দর চাঁদ দেখতেই পাই না। এ সময় ঘরে বসে থাকব?
তাহলে কী করবে?
চলো বাগানের দিকে যাই, ঘুরে বেড়াই।
জরি হাসল। বাঁশবাগানে ভূত-পেতনি থাকে। তোমার ভয় করবে না?
আরে ধুত। ভূতে আমার বিশ্বাসই নেই! তোমার আছে?
না। আমি গ্রামকে গ্রাম হেঁটে বেড়াই, রাত বিরাতেও চলাফেরা করি। কোনোদিন কিছু দেখিওনি, ভয়ও পাইনি। একটা বয়সে মানুষকেই ভয় পেতাম। মেয়েমানুষের কত রকমের ভয়! এখন প্রায় বুড়ি। কেউ ফিরেও তাকায় না। মানুষের ভয়ও কেটে গেছে।
ওরা দুজন হাঁটতে হাঁটতে বাগানের দিকে এল।
বাঁশবনের ওপাশে চাঁদ উঠেছে। তোলপাড় করা হাওয়াটা বইছে। উঠোনের দিক থেকে আসছে সন্ধ্যামালতির গন্ধ। অন্য পাখিদের কলকাকলি বন্ধ হয়েছে, ডাকছে শুধু কোকিল আর ঝিঁঝিপোকা। ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়েছে জোনাকিরা। টিপ টিপ করে জ্বলছে।
জরি বলল, ও মৌ, তুমি যে নাটক থিয়েটার করতে ওসব এখন আর করো না?
মৌ হাসল। নাটক থিয়েটার না, আমি করি আবৃত্তি। আমাদের একটা আবৃত্তির সংগঠন আছে। মাঝে মাঝে আবৃত্তির অনুষ্ঠান করি। অন্যরা অনেক কবির কবিতা আবৃত্তি করে, আমি করি শুধু রবীন্দ্রনাথের কবিতা। তা-ও একটু আনকমন কবিতা। যেসব কবিতা তেমন পড়া হয় না। যেসব কবিতায় একটু গল্প থাকে।
কোকিলের ডাক বুঝি বন্ধ ছিল কিছুক্ষণ। চাঁদের আলো দেখে আবার ডাকতে শুরু করেছে। এই ডাকে জরি ভুলে গেল কী কথা হচ্ছিল মৌর সঙ্গে। বলল, এই বসন্তকালটা বড় অদ্ভুত, কোকিলের ডাক, চাঁদের আলো সব মিলিয়ে মন খুব উদাস হয়। কত কথা যে মনে পড়ে!
মৌ ঠাট্টার গলায় বলল, কার কথা মনে পড়ে, জরিবু?
জরি উদাস গলায় বলল, পড়ে একজনের কথা। বাদ দাও ওসব। কবিতা শোনাও।
শুনতে পারি। তবে একটা শর্ত আছে।
কী শর্ত?
যার কথা মনে পড়ে তার কথা আমাকে বলতে হবে।
জরি অসহায় গলায় বলল, কোনোদিন যে কাউকে বলিনি!
এ জন্যই তো আমাকে বলবে!
একটু থেমে কী ভাবল জরি, তারপর বলল, আচ্ছা বলব।
ঠিক?
ঠিক।
এবার তাহলে কবিতা শোনো। কবিতার নাম ‘কুয়ার ধারে’:
তোমার কাছে চাইনি কিছু,
জানাইনি মোর নাম,
তুমি যখন বিদায় নিলে
নীরব রহিলাম।
একলা ছিলেম কুয়ার ধারে
নিমের ছায়াতলে,
কলস নিয়ে সবাই তখন
পাড়ায় গেছে চলে।
আমায় তারা ডেকে গেল,
‘আয় গো বেলা যায়।’
কোন্ আলসে রইনু বসে
কিসের ভাবনায়।
কবিতা শেষ না করে মৌ বলল, চলো পুকুরঘাটে গিয়ে বসি। তারপর বাকিটা শোনাই।
জরি কথা বলল না, মৌর সঙ্গে পুকুরঘাটে এল।
বাঁধানো ঘাটলার বিশাল পুকুর। পুকুরজলে চাঁদের আলো পড়ে ঝিলমিল ঝিলমিল করছে। চারপাশে গাছপালা, ঝোপঝাড়। হাওয়া বইছে আগের মতো। কোকিলের ডাক আরও তীব্র হয়েছে। বুনোফুলের মিষ্টি গন্ধ আসছে।
ওরা দুজন সিঁড়িতে বসল।
জরি গম্ভীর গলায় বলল, এবার বাকিটা শোনাও।
মৌ তার মিষ্টি কণ্ঠে আবৃত্তি করতে লাগল...
পদধ্বনি শুনি নাইকো
কখন তুমি এলে।
কইলে কথা ক্লান্তকণ্ঠে—
করুণ চক্ষু মেলে—
‘তৃষাকাতর পান্থ আমি।’
শুনে চমকে উঠে
জলের ধারা দিলেম ঢেলে
তোমার করপুটে।
মর্মরিয়া কাঁপে পাতা,
কোকিল কোথা ডাকে—
বাবলা ফুলের গন্ধ
ওঠে পিল্লপথের বাঁকে।
জরি দিশেহারা গলায় বলল, এ কী! এ কোন কবিতা? এ তো আমার কবিতা! আমাকে নিয়ে লেখা...
মৌ অবাক। কী বলছ জরিবু? তোমাকে নিয়ে লেখা মানে?
আমাকে নিয়ে লেখা, সত্যি আমাকে নিয়ে লেখা। একদম আমার কাহিনি। আমার জীবনেও এমনই ঘটেছিল...। বাকিটা শোনাও, বাকিটা। জরির অস্থিরতা দেখে মৌ একটু দমে গেছে। সেই কিশোরী বয়স থেকে দেখছে জরিকে, কত দিন কত কথা হয়েছে তার সঙ্গে, কত সময় কেটেছে দুজনে গল্প করে, কত রাত ভোর হয়ে গেছে গল্পে কথায়, কোনো দিন এমন অস্থির হতে দেখিনি তাকে, এমন দিশেহারা হতে দেখেনি। আজ এই কবিতা শুনে এমন করছে কেন?
জরি তেমনই অস্থির। বলল, শোনাও মৌ, বাকিটা শোনাও।
মৌ একবার আকাশের দিকে তাকাল, পুকুরজল আর ওপারের গাছপালার দিকে তাকাল। তারপর কবিতার বাকি অংশটুকু আবৃত্তি করল।
যখন তুমি শুধালে নাম
পেলেম বড় লাজ—
তোমার মনে থাকার মতো
করেছি কোন্ কাজ!
তোমায় দিতে পেরেছিলেম
একটু তৃষার জল,
এই কথাটি আমার মনে
রইল সম্বল।
কুয়ার ধারে দুপুরবেলা
তেমনি ডাকে পাখি,
তেমনি কাঁপে নিমের পাতা—
আমি বসেই থাকি।
কবিতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে মৌকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদতে লাগল জরি। এ তুমি কোন কবিতা আমাকে শোনালে মৌ? এ তো আমাকে নিয়ে লেখা! সত্যি আমাকে নিয়ে লেখা। হুবুহু আমার জীবন, আমার ঘটনা...এমনই তো ঘটেছিল আমার জীবনে। আমি তো সারা জীবন তার জন্য অমন করে বসে থাকলাম। সেও তো আমার কাছে পানি খেতেই এসেছিল...
মৌ ঠিক বুঝতে পারছে না তার এখন কী করা উচিত। কীভাবে থামাবে জরির কান্না, কীভাবে সামলাবে তাকে?
এ ধরনের পরিস্থিতিতে কি যতক্ষণ ইচ্ছা কাঁদতে দেওয়া ভালো? ধীরে ধীরে কান্না একসময় থেমে আসবে, আপনা-আপনিই স্বাভাবিক হবে মানুষটি। তখন জানা যাবে ঘটনা।
ঠিক আছে, কাঁদুক জরি। যতক্ষণ ইচ্ছা কাঁদুক। কেঁদে কেঁদে হালকা করুক বুকের ভেতর চেপে রাখা বহু বছরের দুঃখবেদনা।
অনেকক্ষণ কেঁদে থামল জরি। আঁচলে চোখ মুছল। গভীর করে একটা

দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তোমাকে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিলাম। কিছু মনে করো না। মাফ করে দিয়ো আমাকে।
জরির পিঠে হাত বুলিয়ে মৌ বলল, না না ঠিক আছে। এমন তো হতেই পারে। এটাই তো সাহিত্যের কাজ। মানুষের মনের গোপনে লুকিয়ে থাকা বেদনাবোধ কিংবা আনন্দ জাগিয়ে দেওয়া। রবীন্দ্রনাথের এই কবিতার সঙ্গে তোমার জীবনের ঘটনা মিলে গেছে। এ জন্যই তুমি কাঁদলে।
জরি কথা বলল না।
মৌ বলল, তুমি কি আমাকে ঘটনাটা বলবে?
বলব। না বলে আমার আর উপায় নেই। জীবন শেষ হয়ে এল। একজন কাউকে অন্তত বলে যাই, আমার আজকের এই জীবন কেন! কোন বেদনায়!
চাঁদ উঠে এসেছে বাঁশবনের মাথার ওপর। হা হা করা হাওয়াটা বইছেই। ঝিঁঝি ডাকছে, থোকায় থোকায় উড়ছে জোনাক পোকা, একটানা ডেকে যাচ্ছে দুরন্ত কোকিলটা। পুকুরের স্বচ্ছজলে চাঁদের আলো আর হাওয়ার খেলা।
অনেকক্ষণ কাঁদলে মানুষের গলা ভারী হয়। সে রকম গলায় জরি বলল, সেও এক ফাল্গুন মাসের কথা। শেষ বিকেল। কত বয়স আমার তখন! তেরো-চৌদ্দ বছর হবে। স্কুলে পড়ি। আমাদের মতো গরিব গৃহস্থবাড়ির মেয়েরা তখনকার দিনে স্কুলে বলতে গেলে যায়ই না। আমি যেতাম। আমাদের পাড়ার ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই যেত। রাজা সাহেবের আদেশ। স্কুলে যেতেই হবে। তিনি স্কুল করে দিয়েছেন দেশগ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্য...
একটা কথা জরিবু, চৌধুরী সাহেবকে তোমরা রাজা সাহেব বলতে কেন?
এখানকার সবাই তাই বলত। তিনি তো রাজাই ছিলেন। এলাকার জমিদার। বিল মাঠ গ্রামের পর গ্রাম সব চৌধুরীদের। পদ্মার চরের ওদিককার পুরোটাই তাঁদের। এ ধরনের মানুষদেরকেই তো রাজা বলে! আর চৌধুরী বাড়ি মানে রাজার বাড়ি, রাজবাড়ি। দোতলা বিশাল বিশাল বিল্ডিং, কাছারিঘর, বাড়ির সামনে পাকা রাস্তা, বিশাল মাঠ, পেছনে গাছপালাভর্তি বাগান, দিঘির মতো বিশাল বিশাল পুকুর, কবরখানা। চার-পাঁচ শ লাঠিয়াল, তাদের জন্য আলাদা গ্রাম। ভিতরবাড়িতে বিশ-তিরিশজন কাজের লোক, সকাল থেকে রাত একপ্রহর অবধি রান্নাবান্না চলছে। এক-দেড় শ লোক খাচ্ছে প্রতিদিন। কাছারিঘরে কাজ করছে কুড়ি-পঁচিশজন লোক। পাহারাদার, জমাদার, পাইক ভুঁইমালি—কত কত লোক। এসব তো রাজাদেরই থাকে! চৌধুরী সাহেবকে তাহলে রাজা বলবে না কেন? আর কী দরাজদিল মানুষ। তাঁর এলাকায় কেউ অনাহারে থাকে না। কত ভূমিহীনকে জমি দিয়েছেন, যা চাষ করে খা গিয়ে। নিজ এলাকায় রেলস্টেশন করিয়েছেন, পোস্ট অফিস, সাবরেজিস্ট্রি অফিস, স্কুল, কলেজ। তিনি তো রাজাই! রাজা যখন বাড়ি থেকে বেরোতেন, বিশ-পঞ্চাশজন লোক সঙ্গে। আর কী সুন্দর, কী সুপুরুষ দেখতে। পোশাক-আশাক রাজকীয়। আরবদেশ থেকে দামি আতর আনাতেন ব্যবহারের জন্য। বিলাত থেকে স্যুট-টাই। তিনি বাড়ি থেকে বেরোলে এলাকায় সাড়া পড়ে যেত। সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে যেত চারদিক। তাঁর কাছে গিয়ে ন্যায়বিচার পায়নি এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। এই মানুষকে রাজা বলবে না তো কী বলবে!
মৌ মাথা নাড়ল। তা ঠিক।
জরি বলল, আর রাজবাড়ির ছেলেমেয়েরা, মাগো, কী সুন্দর একেকজন! তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। মেয়েরা প্রত্যেকে তোমার মতো লম্বা, কাটা কাটা চেহারা, পটোলচেরা চোখ। হাসিতে মুক্তো ঝরে একেকজনের। কী পোশাক-আশাক, কী চালচলন তাঁদের! গানবাজনা আনন্দ-উৎসব লেগেই আছে বাড়িতে। ছেলেমেয়েদের মাকে সবাই বলত মহারানি। রাজা সাহেবের সঙ্গে তিনিও দেশ-বিদেশে ঘুরতেন। দুই রানির ঘরে চৌদ্দ-পনেরোজন ছেলেমেয়ে। রাজা সাহেব মহারানিকেই মর্যাদা দেন বেশি। ছেলেমেয়েরা, সবাই গানবাজনা করে। নাটক-থিয়েটার করে। ভারি আমুদে পরিবেশ বাড়ির।
একটু থামল জরি। তারপর বলল, তবে মেজ রাজকুমার ছিল সবচেয়ে সুন্দর। তাকালে সত্যি সত্যি চোখ ফেরানো যায় না। এলাকার বউঝি থেকে শুরু করে যুবতী মেয়েরা তাঁকে দেখলে পাগল হয়ে যেত।
জরি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমিও হয়েছিলাম।
মৌ চমকাল। বলো কী?
হ্যাঁ। হয়েছিলাম বলছি কেন, এখনো হয়ে আছি। মরণ পর্যন্ত থাকব।
জরির মুখের দিকে তাকাল মৌ। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না জরিবু। তুমি, মানে তুমি গরিব গৃহস্থবাড়ির মেয়ে আর তিনি হচ্ছেন, মানে তোমার ভাষায় রাজকুমার...
হ্যাঁ, রাজকুমারই তো! বলছি, শোনো ঘটনা। এ রকম ফাল্গুন মাস। তখনকার দিনে শীতকালগুলো একটু লম্বা হতো। বসন্ত এসে গেছে তারপরও যেন শীত যাচ্ছে না। পদ্মার ওদিকে বিশাল চর। শীতের শুরুতে হাজার হাজার পাখি আসত চরে। শীত শেষ হতো, বসন্তকাল চলছে তাও পাখিগুলো ফিরে যাচ্ছে না। রাজকুমাররা পদ্মার চরে, ওদিককার বিলে যেতেন পাখি শিকারে। শীতের শুরু থেকেই শুরু হতো তাঁদের শিকার। কখনো তিন রাজকুমার একসঙ্গে, কখনো দুজন, কাঁধে দোনলা বন্দুক, পরনে বিদেশি শিকারিদের মতো পোশাক, পায়ে রাবারের লম্বা বুট জুতা, সঙ্গে দুচারজন লোকও থাকত। তারা খাবার বহন করছে, সন্ধ্যাবেলা ফেরার সময় শিকার করা পাখি বহন করছে। বালিহাঁস, চখা, সারস, কত রকমের পাখি। সব পাখির নামও জানি না। আর রাজবাড়ির কথা, রাজকুমার আর রাজকন্যাদের কথা বাড়ির লোকের মুখে শুনেছি। রাজবাড়িতে যাইনি কোনো দিন, তাঁদের কাউকে চোখেও দেখিনি। শুধু শুনি আর কল্পনা করি তাঁদের কথা।
একদিন শেষ বিকেলে আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন একজন। ও রকম শিকারির পোশাক পরা, বুটজুতোয় কাদাবালি লেগে আছে। এক কাঁধে বন্দুক আরেক হাতে ঝুলছে অনেকগুলো শিকার করা পাখি। রোদে ক্লান্তিতে শুকনো মুখ। কিন্তু কী অসম্ভব সুন্দর যুবক। তাঁর আলোয় যেন শেষ বিকেলের আলো হঠাৎ করেই বেশি উজ্জ্বল হয়ে গেছে।
আমাদের গরিব মানুষের বাড়ি। বাবা একেবারেই হতদরিদ্র কৃষক। বড় দুই ভাই বাবার সঙ্গে খেতখোলায় কাজ করে। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ভাইরা কেউ বিয়ে করেনি। ছোট বোনটা মাটিতে মাত্র হামাগুড়ি দিচ্ছে। আমার পর আরও দুটো ভাইবোন হয়ে মারা গেছে। বাড়িতে তিনটা কুঁড়েঘর। পথের ধারে বাড়ি। বাঁশের ভাঙাচোরা বেড়া আছে। ওই বেড়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন মানুষটা। আমিই তাঁকে প্রথম দেখলাম। দেখে আর চোখ ফেরাতে পারি না। স্বপ্ন দেখার মতো চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছি। তিনি একপলক আমার দিকে তাকালেন। পানি দাও তো। আমার খুব পিপাসা পেয়েছে।
আমি যেন কথাটা শুনতেই পেলাম না। তাকিয়ে আছি তো তাকিয়েই আছি। এ সময় বাবা বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। কে এল রে? কে কথা বলে?
তারপরই তাঁকে দেখে দিশেহারা। সর্বনাশ! মেজ রাজকুমার আমার বাড়িতে?
আমার ভাইরাও বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে, মা-বোনরা বেরিয়ে এসেছে। সবাই তটস্থ। তিনি শুধু বললেন, পানি খাব। পানি দাও।
আমার ঘোর একটু যেন কেটেছে। দৌড়ে ঘরে ঢুকলাম। পিতলের বড় একটা গ্লাস ছিল বাড়িতে সেই গ্লাস ভরে পানি এনে দিলাম তাঁর হাতে। তিনি ঢক ঢক করে পুরো পানিটা খেলেন। গ্লাস আমার হাতে ফেরত দিলেন কিন্তু একবারও আমার দিকে তাকিয়ে দেখলেন না।
বাড়ির সবাই জড়সড়ো। বাবা কাঁচুমাচু গলায় বললেন, একটু বসবেন সাহেব? একটু জিরিয়ে নেবেন? বন্দুক আর পাখিগুলো না হয় আমাকে দিন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
তিনি হাসিমুখে বললেন, দরকার নেই। আমি আজ একাই শিকারে বেরিয়েছিলাম। কোনো অসুবিধা নেই। একাই যেতে পারব।
পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন তিনি। ততক্ষণে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি উঠোনের কোণে। তিনি একবারও আমার দিকে তাকালেন না, চলে গেলেন। আমার বাবা আর ভাইয়েরা কিছুদূর গেল তাঁর সঙ্গে। আমি দাঁড়িয়েই আছি। হঠাৎ দেখি বেড়ার ধারে তাঁর রুমালটা পড়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে তুলেছি। অন্ধকারে তিনি অনেক দূর চলে গেছেন। দৌড়ে গিয়ে যে রুমালটা দিয়ে আসব তা আর সম্ভব না। দুহাতে রুমাল ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখজুড়ে রাজকুমার আর রুমাল থেকে আসছে রাজকুমারের গন্ধ। বাড়ির কেউ কিছু টের পেল না, রুমালটা আমি ফ্রকের ভেতর, বুকের কাছে গুঁজে রাখলাম। তারপর থেকে আমার ধ্যানজ্ঞান, স্বপ্ন, প্রেম সব ওই মানুষটা। ওই যে তাঁকে একটু পানি খাওয়ালাম, ওই যে তাঁকে একটু দেখলাম, চোখ থেকে মুহূর্তের জন্য সরাতে পারি না তাঁকে। মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারি না। কাউকে কিছু বলি না, কাউকে কিছু বুঝতে দিই না, অতিযত্নে, অতিগোপনে রুমালটা রেখে দিয়েছি বুকের কাছে। যেন তিনি আমার বুকে আছেন। আমার শরীরে মিশে আছেন। গভীর রাতে, নির্জন একাকী দুপুরে, বিকেল কিংবা সন্ধ্যায় কখনো কখনো বের করি রুমালটা। নাকের কাছে ধরি। তাঁর গন্ধ পাই। সেই গন্ধে আমার বুক ভরে যায়, মন ভরে যায়। এত সুন্দর হয় পুরুষ মানুষ? এই মানুষকে ছাড়া আমি বাঁচব কেমন করে? তাঁকে পাওয়ার তো কোনো উপায় আমার নেই! তিনি রাজকুমার আর আমি ভিখিরিনি। কোথাকার কোন হতদরিদ্র গৃহস্থঘরের কুরূপা না হলেও রূপবতীও তেমন নই। অতিসাধারণ, সামান্য এক কিশোরী মেয়ে। কোথায় তিনি, কোথায় আমি!
ধীরে ধীরে বড় হচ্ছি। যৌবনে সবাই একটু সুন্দরী হয়। তেমন হয়েছি। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে বাড়িতে বসে আছি। স্বাভাবিক কারণেই বিয়ের চেষ্টা চলছে। এ ধরনের পরিবারের যুবতী মেয়ে, যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে তাকে দিতে হবে। কিন্তু আমার মনজুড়ে রাজকুমার, শরীরজুড়ে রাজকুমার। বুকে লুকিয়ে রেখেছি তাঁর সেই রুমাল। অন্য কোনো পুরুষের কথা আমি ভাবতে পারি না। বিয়ের কথা উঠলেই বলি, বিয়ে করব না। মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনেরা অবাক। বিয়ে করবি না মানে? বিয়ে না করলে জীবন কাটবে কেমন করে? খাওয়াবে-পরাবে কে?
আমার ওই এক কথা। বিয়ে করব না। গৃহস্থবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে খাব। না হয় না খেয়ে থাকব।
সবাই হতবাক। এ কেমন কথা? গৃহস্থবাড়ির মেয়ে বিয়ে না করে জীবন কাটায় কেমন করে?
তারপর শুরু হলো সন্দেহ। আমি কাউকে পছন্দ করি কি না, প্রেম-পিরিতি হয়েছে কি না, ইত্যাদি। কিন্তু যাঁর সঙ্গে প্রেম হয়েছে, যাঁকে মন দিয়ে ফেলেছি, শরীরে জড়িয়ে রেখেছি যাঁর গায়ের গন্ধ তাঁর কথা তো কাউকে বলতে পারব না। বললে ভাববে এই মেয়ে পাগল হয়ে গেছে। এই মেয়ের মাথা খারাপ।
মৌর দিকে তাকাল জরি। মৌ, সত্যি আমি তখন পাগল, আমার সত্যি তখন মাথা খারাপ। সেই মানুষ ছাড়া কারও কথা আমি ভাবতে পারি না। এ অবস্থায় জোর করে আমাকে বিয়ে দেওয়া হলো। বুকে তাঁর ফেলে যাওয়া রুমালখানি, পালকিতে করে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো শ্বশুরবাড়ি। বাসররাত। বর ঢুকল ঘরে। বললাম, শরীর খারাপ। মেয়েলি ব্যাপার। সামনে আসবেন না। লোকটা মন খারাপ করে ঘুমিয়ে পড়ল। আর সেই ফাঁকে আমি দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত, দু-আড়াই মাইল পথ, মাঠ-জঙ্গল ভেঙে ভোরবেলা বাড়িতে। সেই আসাই আসা। শ্বশুরবাড়ি থেকে চেষ্টা করল ফিরিয়ে নিতে, মা-বাবা, ভাইবোনেরা চেষ্টা করল, নানা রকমভাবে বোঝাল, আমার কথা একটাই, আমি যাব না। এই নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে গলায় দড়ি দেব।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জরি। দিনে দিনে দিন গেল। বাপ মরল, মা মরল। ভাইবোনেরা যে যার সংসারে। আমার জীবন হয়ে উঠল আজকের এই জীবন। এখনো সেই মানুষ আমার মনে, সেই বিকেলের ছবি আমার চোখে, তাঁর ফেলে যাওয়া রুমালখানি আমার বুকে। সেই রুমালের স্পর্শে মনে হয় তাঁকে আমি বুকে জড়িয়ে রেখেছি। অথবা তিনি একটুখানি ছুঁয়ে আছেন আমাকে।
অনেকক্ষণ পর কথা বলল মৌ। তারপর আর কোনো দিন রাজকুমারের সঙ্গে তোমার দেখা হয়নি?
আমি তাঁকে দেখেছি। তাঁদের বাড়িতে গিয়েছি। যখন সবাই আমার আশা ছেড়ে দিয়েছে, যখন সবাই ভেবেছে আমি পাগল, আমার মানসিক সমস্যা আছে, আমি এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াই, তখন প্রায়ই যাই রাজবাড়িতে। উৎসব আনন্দে, বিয়েশাদিতে। ওই বাড়ি তো সবার জন্য খোলা। যাই। গিয়ে ভিখিরির মতো একপাশে দাঁড়িয়ে থাকি। যদি তাঁকে একটু দেখা যায়! কখনো কখনো দেখি তাঁকে। তিনি তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত, স্ত্রী-ছেলেমেয়ে, ভাইবোন, আত্মীয়, বন্ধু, কত মানুষ চারপাশে। এলাকার নারী-পুরুষ কতজন বারবাড়িতে, ভেতর বাড়িতে। তিনি কেন আমার মতো ভিখিরিনির দিকে তাকাবেন? কোনো দিন তাকিয়েও দেখেননি। আমি অপলক চোখে তাকিয়ে থেকেছি। বুকে জড়ানো তাঁর সেই রুমালখানি।
এখনো কি সেই রুমাল তোমার কাছে?
হ্যাঁ। এই যে আমার বুকে।
জরি তার ব্লাউজের ভেতর থেকে অতিযত্নে, অতিমায়ায় রুমালটা বের করল। চাঁদের আলোয় রং বোঝা যায় না। এক টুকরো কাপড় মনে হয়। সেই কাপড়ের টুকরো দুহাতে গভীর মমতায় মৌর সামনে মেলে ধরল জরি। এই রুমাল বুকে নিয়ে বেঁচে আছি আমি, এই রুমাল বুকে নিয়ে মরে যাব।
ফাগুন রাতের চাঁদ তখন আরেকটু প্রখর হয়েছে।