গল্প

ভোর ও বাবা

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

বাবার কথা মনেই ছিল না। ভোরে যখন কাক আর একটা-দুটো ছুটে যাওয়া গাড়ি আলো নিয়ে আসছে, পেশাবের বেগের কারণে উঠতে হলো। টলতে টলতে টয়লেটে গেল বাপ্পী। কেননা শুয়েছে রাত আড়াইটায়।
পেশাব করতে করতে হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়ে। এ রকম ভোরেই উঠেছিলেন বাবা। উঠে পায়খানা করেছেন, বমি করেছেন, অনেকক্ষণ শ্বাসকষ্টে ভুগেছেন। ভোরের আলো আরেকটু বাড়ার পর মারা গেছেন হার্ট অ্যাটাকে। প্রথম অ্যাটাকের দুই বছর পর দ্বিতীয়বার অ্যাটাক। তাতেই জীবন শেষ।
সেও কি এখন মারা যাবে? প্রশ্নটা হঠাৎ উদয় হলো।
শুতে শুতে ভাবল, কাছে থাকা সত্ত্বেও বাবার মারা যাওয়ার সময়কার চেহারাটা দেখল না। জেঠাতো ভাই হারুনের কারণেই দেখেনি। তিনি তখন তাকে পাঠিয়েছিলেন আবুল ভাইকে ডেকে আনতে। এসে দেখে, বাবা নেই। সে কেমন থম মেরে গিয়েছিল। চোখে এক ফোঁটা পানিও আসেনি। ভেতরটা অদ্ভুত রকম শূন্য। সেই শূন্যতা কাউকে দেখাতে পারেনি।
পাশের ফ্ল্যাটে জোরে ফ্যান চলছে। মাঘের মাঝামাঝি। হঠাৎ করে শীতটা কোথায় পালিয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে, আরেকটা শৈত্যপ্রবাহ আসতে পারে।
দূরে একটা কুকুর ডাকল। মনে হলো নৃশংস কোনো মৃত্যুর শব্দ শুনছে। সিংহের মতো ভয় এসে ঘাড়ে কামড় দেয়। ভয়ের চাবি লাগানো একটা পুতুল কেঁদে কেঁদে এগিয়ে আসে। চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে। সে ভাবে, ভোরে কেন কুকুর ডাকে?
ছুটন্ত গাড়ির হর্ন তাকে ভয় থেকে সরিয়ে দেয়। শব্দ তো ভয়ের বিপরীত, শব্দ তো জীবনের সুর। সে ভাবতে চেষ্টা করে, তখনকার ঘর, সেই ভোর, অগ্রহায়ণের শীতে কাঁপা; এবং আরেকটি কথা।
বাবাকে হারানোর পর অনুভূতি কেমন হয়েছিল বাপ্পীর? এখন হয়তো ভাববে, কুয়াশার বিশাল একটা মাঠ, তার সীমা-পরিসীমা নেই। সেখানে কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কিন্তু পাচ্ছে না।
বাবা মারা গিয়েছিল গ্রামের বাড়িতে। এখন সে থাকে শহরে। ছয়তলা বিল্ডিংয়ের ছয় শ পাঁচে পনেরো বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো নিজেকে গোছাতে পারল না। বিয়ে তো আরও দূরের পথ। সুতার কারখানায় চাকরি করে। নাইট শিফটেও কাজ করতে হয়। গত রাতে অফিস থেকে বেরিয়েছিল দুইটার পর।
কোনো মানুষ নেই এমন রাস্তায় একা হাঁটতে ভালো লাগে। কিন্তু সেই সুযোগ আর নেই। সিটি করপোরেশন এখন রাতে ময়লা পরিষ্কার করে। ডাস্টবিনের পাশে থাকে ময়লার ট্রাক। মেথররা ময়লা তোলে। গলির দারোয়ানরা বসে বসে ঝিমায়।
একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছিল। ভাবনায় ছেদ পড়ে। ডিসি হিলের দিকে কয়েকটা কাক একনাগাড়ে ডাকছে। অগ্রহায়ণের সেই রাতের কথা মনে পড়ল।
তখন সে ডিগ্রিতে পড়ে। একটু একটু শীত আসছে, আবার দূরে সরে যাচ্ছে। পাতলা কাঁথাটা হাঁটুর নিচে। দলামোচড়া শুয়ে আছে। ভোরের কুয়াশার মতো দ্বিধাভরে এগিয়ে আসে এক তরুণী। পুকুরে পড়া ঢিলের মতো আস্তে করে ডুব দেয় তার মনে। মন থেকে শরীরের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে। ওটা যেন সোয়াচান পাখি। পাখিটাকে ধরতে সে-ও পাখি হয়ে উড়াল দেয়।
শরীর যেন এক মহাদেশ। মহাদেশের আনাচকানাচে উড়েও নাগাল পায় না তার। কিন্তু পেতেই হবে তাকে। তাই ডানা খুলে ফিরে আসে নিজের কাছে। তখনই জ্বলে ওঠে হাজার আলো। আকাশের আলো, সমুদ্রের ঢেউ মেশানো রং, গোলাপের পাপড়ি কিংবা পাপড়িতে লেগে থাকা জলবিন্দুর জন্য আশ্চর্য মায়া হয়, আকুতি জমে। একটু ইশারা বা মুহূর্তের ঝলকানি হয়ে হাসির মতো ছড়িয়ে পড়তে চায়।
সে কি ওই তরুণীর রং একটু করে খুঁজে পায়! রং ছুঁতে দুরন্ত গতির ঘোড়া হয়ে যায়। গোলাপি ঘোড়াটা ছোটে। ছুটতে ছুটতে কাছাকাছি এসে পড়েছে। আরেকটু এগোলেই পাবে। এ সময় গর্জে ওঠে আনন্দের মেঘ। গর্জনে গর্জনে সে বিদ্যুৎ হয়ে যায়। তখনই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ে।
এরপর মর্মর ধ্বনির মতো ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যুৎ তরঙ্গ। কাঁঠালপাতা ছিঁড়লে যেমন কষ বেরোয়, তেমন কষ কষ হয়ে সে কাঁপে। কোষে কোষে মিশে যায় কাঁপুনি।
মৈথুনের পর মন খারাপ হয়ে যায়। নিজেকে মনে হয় অপরাধী। পরদিন ভোরে বাবার মৃত্যুর পর আরও অপরাধী হয়। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে লুকিয়ে পুকুরের উত্তর-পশ্চিম কোণের ঘাটে নামে। হলুদ পাতা যেমন নিঃশব্দে পানিতে পড়ে, তেমনভাবে ডুব দিয়ে গোসল করে। সেদিন নিজের কাছে খুব লজ্জিত ছিল। শোক আর লজ্জা মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সেই লজ্জা তার মনের আকাশের গোধূলি হয়ে রয়ে গেছে।
ভোরে মানুষ নিজের দিকে তাকায়, পরিশুদ্ধ হওয়ার চিন্তা করে। আচ্ছা, যারা অপরাধ করে, মৃত্যুর আগে তাদের মনোভাব কেমন হয়? তারা কি মনে মনে কাঁদে? আফসোস করে? সম্ভবত করে। আর যারা ভালো মানুষ, তাদের কী হয়?
মৃত্যু মনে হয় কষ্টকর এক যাত্রা। কারও পক্ষে তা বলা, বোঝা বা অনুভব করা অসম্ভব। কার কাছে যেন শুনেছিল, মানুষের শরীরটা শুধু মারা যায়, আত্মা রয়ে যায় পৃথিবীতে।
বাবার হাসিমুখ মনে করতে চায়। মনে পড়ে না। বিষণ্ন, দুশ্চিন্তায় ভোগা একটি মুখ জানালা দিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। এই দৃশ্যটি শুধু চোখে ভাসে।
অফিসের সুপারভাইজার তাকে হেয় করে কথা বলেন। কলিগরা তা জানায়। সে নাকি জন্ডিস রোগী, মুরগির ব্যাপারী। কখনো বলেন, হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। তার চালচলনটা একটু নরমসরম। ভেতরে বাঘ থাকলেও বাইরে বিড়াল। তাই অনেকেই ভুল বোঝে।
তবে মাঝেমধ্যে মনে হয়, সে একদিন সুপারভাইজারের মাথা ফাটিয়ে দেবে। কেননা লোকটা অহংকারের শেষ সীমানায় আছে। কোনো মানুষের প্রতি তাঁর সম্মান নেই।
সে ভাবে গভীর দুখী বাবার কথা। বার্মায় প্রথম স্ত্রী, দুই ছেলে আর এক মেয়েকে ফেলে এসেছিলেন। ওই মা আর ভাইবোনদের নিয়ে সে অনেক ভাবত। কিন্তু তা নিয়ে কখনো কারও সঙ্গে কথা বলেনি। মাঝেমধ্যে মাকে ঠেস মারতে শুনত। বাবা চুপ মেরে থাকতেন।
বাপ্পীর মনে হতো, অন্যায় করা ঠিক না। অন্যায় মানুষকে সয় না। তার জন্য অনেক ভুগতে হয়। মানুষকে কেউ পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। তার অনেক ঋণ। ঋণ শোধ না করে যদি ঋণ বাড়ায়, তবে তার কী হবে? বুকে হাত রেখে এখন বিষয়টা অনুভব করতে চাইল।
এ সময় মনে হলো, কাক আর কুকুর তার ভেতরেই ডাকছে। শহরটা আসলে রুক্ষ, সুরহীন।
ভাবল, ছয়তলায় ওঠানামা করতে হয় একই সিঁড়ি দিয়ে। বিকল্প কোনো পথ নেই। মৃত্যুর পথটাও নির্দিষ্ট। কিন্তু জীবনের পথ তো অনেক। ভাবতে ভাবতে ঘুম আসে। গভীর ঘুম। স্বপ্ন দেখে, চুলায় ভাত ফুটছে। একেকটি ভাতে একেকটি মুখ। সেই বড়মা, দুই ভাই, বোন, আবছায়া এক দেশ বার্মা। ঘুমের মধ্যে সে দৌড়ায়। কিন্তু কদম পড়ে না। চিৎকার করে আর বাবাকে ডাকে। বাবা কোথায়?
বড় হতে হতে বুঝল, বাবা ভাগ হয়ে গেছেন। তাঁর মনের একটা অংশ থাকে বার্মায়। বার্মার কোথায় তারা থাকত তা জানা ছিল না। এ বিষয়ে বাবা কখনো কোনো কথা বলেননি, তারাও আলাপ করেনি। মনে মনে কথা হতো। সেই কথা শেষ পর্যন্ত কোনো রূপ ধারণ করত না।
রেঙ্গুন শব্দটাই মনে ভেসে বেড়াত। যারা বার্মা থেকে ফিরে আসত, এলাকায় তাদের বলা হতো, ‘হিতে রেঙ্গুন খায় আইস্যি’। তারা রেঙ্গুনকে রসে-রঙে মাখিয়ে রাখত।
বাবার মনের আরেক অংশ থাকত তাদের সঙ্গে। তাঁর চেহারায়, চোখে ফুটে থাকত দ্বিধা। তা বাপ্পীর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। বাবা কি তার মধ্যে বাস করতে শুরু করেছেন!
রেগে গেলেই মা ভেতরের অনেক ক্রোধ এক করে ফুঁসে উঠত, ‘হারা বছর ব’ গেয়ি’। এই ব’টা কী, সে বুঝতে পারত না। মায়ের প্রতিক্রিয়া দেখে ভয় পেত। ভাবত, বাবা খুবই খারাপ কোনো কাজ করেছেন, যার জবাব নেই। তাই চুপ মেরে আছেন।
তত দিনে বাবার ওই স্বভাবকে ভয় পেতে শুরু করেছে সে। বাবার স্বভাব তার মধ্যে ঢুকে পড়েছে ভেবে ভয়টা আরও বেড়ে গেল।
গতকাল একটা স্বপ্ন দেখেছিল। তিন পক্ষ গোলাগুলি করছে। কেউ কাউকে চেনে না। একটার পর একটা লাশ পড়ছে আর মানুষ কাঁদছে। তারা বাবার জন্য উৎকণ্ঠায় আছে। বাবা দোকান থেকে আসেননি। গভীর রাতে এলেন। তাঁর লুঙ্গি শতচ্ছিন্ন।
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়ি য্যা?’
বাবা বললেন, ‘রিকশে মারি দিয়ি’।
কোমল আলো মাখা এই ভোরে বাবার মুখ মনে করতে চায়। কিন্তু মুখটা জোড়া লাগে না। ছেঁড়া লুঙ্গির টুকরা হয়ে ঝুলে আর লাশগুলো মনে হয় বেলি ফুল হয়ে পুকুরে ভাসছে।
ঝিমুনি আসতে আসতে বিভ্রমে পড়ে সে। কে যেন বলে, ‘তোর বাবা বেলি ফুল হয়ে গেছে’। ছোট বোন টুম্পা জানে না, সে ছিঁড়ে পুকুরে ভাসিয়ে দেয়।
বাদামগাছের খয়েরি পাতা ঝরছে। সে মনে হয় পুকুরে পা ডুবিয়ে হাঁটছে। গভীর রাতের মালবাহী ট্রাকের শব্দ, কুকুরের ঘেউ ঘেউ, কাকের ডাকের মতো বাবা আসেন। আকাশের এক কোণে বসেন। বলতে চান একটা কথা। তারা বুঝতে পারে না।
হঠাৎ খেয়াল হলো, আজ মাঘের চৌদ্দ তারিখ। বাবা তো এই দিনেই মারা গেছেন। সে অবাক হলো।
কাউকে দুঃখ দিলে দীর্ঘ দিনের দুঃখ হয়ে নিজের কাছে তা ফিরে আসে। তা হয়তো তার সন্তান পর্যন্ত বিস্মৃত হয়। আজ মনে হলো, সে বুঝেছে, হ্যাঁ, সেই দুঃখে সে-ও ভুগেছে, ভুগছে। জীবনের কাছ থেকে খালি হাতে ফিরেছে বারবার।
অন্যায়, অন্যায়, বাবা অন্যায় করেছেন। এ কথা সে কাউকে বলতে পারে না। রোগে ধরা মুরগির মতো ঝিমায়।
ছোটকালে মামাকে অনেক বলতে শুনেছে, ‘তোর বাপ সুবিধাবাদী, নরম শয়তান। না হলে কেউ বউ-সন্তান ফেলে আসতে পারে? সেই কথা না জানিয়ে চুপি চুপি বিয়ে করতে পারে?’ নানি কিছু বলত না, মুখ কালো করে বসে থাকত।
কোনো মেয়ে যদি জানে, তার স্বামী ফিরবে না, তার সন্তানের বাবা ফিরবে না, তার কেমন লাগবে? তার ভেতর অবিরত কান্না চলবে? সেই কান্না থেকেই দুঃখ-নদীর জন্ম?
বাবার মধ্যে মৃত্যুর আগেই মরণ ছিল! চেহারায় তার ছায়া দেখা যেত। অসুখে ভুগেছেন দীর্ঘদিন। কালো মুখ দেখলে তার মনে অনেক কথা ফুটত। তবে সে মালা গাঁথতে পারত না।
শেষকালে দেখেছে, বাবা গুমরে মরতেন। গালি দিতেন নিজের দুর্ভাগ্যকে। মুখে গভীর অসুখের ছাপ। তখন ভাবত, সে বার্মায় যাবে। তাদের সঙ্গে তার দেখা হবে। তারাও বেড়াতে আসবে।
দোকানে বাবার ক্যাশবাক্সে একদিন একটা চিঠি পেয়েছিল। বড়মা পাঠিয়েছেন। একবার শুনেছিল, তার সৎ ভাই কাঠমিস্ত্রি। তিনিই মনে হয় বাটালি দিয়ে কাঠে ফুল আঁকার মতো এই চিঠি লিখে দিয়েছেন। চিঠির পরতে পরতে ছিল দুঃখ-নদীর পানি। বলেছিল, আপনার দুরবস্থার কথা শুনে চিন্তিত আছি। কীভাবে চশমার ব্যবস্থা করা যায় ভাবছি। সম্ভবত টাকা পাঠানোর কথাও বলেছিলেন।
মনে হয়েছিল, দুঃখ মেশানো মায়া সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে গেছে বাংলার এক গাঁয়ে। বার্মা নাকি খুব সুন্দর দেশ। তবে বর্তমানে সেখানে সামরিক শাসন। জাতিবিদ্বেষ বেড়েছে আর রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার চলছে।
চিঠি পড়ার আট-দশ বছর পর এক বিকেলে নদীর পাড় ধরে হেঁটে যখন টিউশনি করতে যাচ্ছিল, মনে হয়েছিল, বাবা একটা নির্লজ্জ মানুষ। বউ-সন্তানদের ফেলে এসে, তাদের অপমান করে, শূন্য করে দিয়ে তাদের কাছে হাত পেতেছিল। চিঠি পড়েই তো বোঝা গিয়েছিল, বাবা সহায়তা চেয়ে তাদের কাছে চিঠি লিখেছিলেন।
উনসত্তরের উত্তাল সময়ে দেশে এসেছিলেন। কেন বাবা তাদের ছেড়ে এসেছেন? কত প্রশ্ন লাটিমের মতো ঘুরেছে! এক প্রতিবেশীর কাছে সে জেনেছে, দাদির জন্যই ছেড়ে আসা। দাদি কষ্ট পাবে, তাই এই ত্যাগ। কিন্তু সেই কথা বাবাকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি।

ভোরের কুয়াশার মতো দ্বিধাভরে এগিয়ে আসে এক তরুণী। পুকুরে পড়া ঢিলের মতো আস্তে করে ডুব দেয় তার মনে। মন থেকে শরীরের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে। ওটা যেন সোয়াচান পাখি। পাখিটাকে ধরতে সে-ও পাখি হয়ে উড়াল দেয়

এ দেশ থেকে অনেকে তখন রেঙ্গুন গিয়েছিল। চাকরি আর ব্যবসায় উন্নতি করেছিল। বিয়েও করেছিল।
বার্মার কথা উঠলে তার এক কলিগ বলে, সময়ের পাল্টা মার দিল বার্মা। অনেক বছর পর রোহিঙ্গাদের মেরে-ধরে পাঠিয়ে দিল এদিকে। তোমাদের লোক এখান থেকে অনেক সম্পদ আহরণ করেছে। এবার কিছুটা শোধ নিলাম।
ঘুম আর আসে না। গল্পের মতো বয়ে চলে এই ভোর। সেখানে কর্ণফুলী, শিকলবাহা, শঙ্খ, মাতামুহুরীসহ কত নদী! চট্টগ্রাম শহর থেকে কর্ণফুলী পার হয়ে পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, চকরিয়া, উখিয়া পেরিয়ে সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়ে বার্মায়।
কিম্ভূত একটা দেশ। গাছগুলোর আগা কাটা। জলপাই রঙের রাজারা সেই দেশটাকে কানা-খোঁড়া লোকের মতো সাজিয়ে রেখেছে। সে বড়মাকে খোঁজে। তার দেখা যদি পায়, পায়ে পড়ে বলবে, আমার বাবাকে আপনি মাফ করে দেবেন। তার কোনো উপায় ছিল না।
আবার ভাবে, উপায় হয়তো ছিল। ভীতু সরল লোকটা মাথা তুলে একবার দাঁড়ালেই হতো।
ঘুরতে ঘুরতে অনেক জায়গায় যায়, তাদের পায় না। মুখ বাধা কতগুলো মানুষ রাস্তায় চলাচল করছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে হাতের ইশারায় কী দেখায়, বুঝতে পারে না।
ভাবে, বসন্তকাল আসবে। ভোরে ট্রেনের হুইসেল শোনা যাবে। ঘুঘু আর ডাহুকেরা তখন ডাকবে। শুনেই পান্তাভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়বে সে। আবার যাবে, বাবার কাছে, বড়মার কাছে আর তার নিজের শৈশবের কাছে। শৈশবের যে অনেকগুলো ভোর আছে, পাখির ডাক আছে। পাখির ডাক, ভোরের হাওয়া আর আলো দিয়ে সে মনের মতো আরেকটি বাবা গড়বে।
স্বপ্নে একটা গাছ দেখে। গাছটার নাম জানে না, পাতাও অচেনা। তবে সেই গাছ থেকে সুগন্ধ বের হয়। সুগন্ধ থেকে মায়া-মমতার মতো বেরিয়ে এসে বাবা তাকে ছুঁয়ে দেন।
তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। চাচাতো বোনের বিয়ে হবে। ঘাটায় কচুখেত আর আগাছার জঙ্গল সাফ করতে নেমেছে সে আর চাচাতো ভাইয়েরা।
মফিজের হাতে ছিল কিরিচ। কিরিচ দিয়ে শাঁ শাঁ করে কচুগাছ কাটছিল। তার হাতে কোদাল। লম্বা ঘাসগুলো মাটি থেকে উপড়ে নিচ্ছিল। হঠাৎ কিরিচের তেরছা কোপ এসে কোদালের ডাঁটে তার হাতে লাগে।
বিচ্ছু, পোকা অথবা রাস্তায় থেঁতলে যাওয়া ছুঁচো দেখেছিল। অকস্মাৎ এক পলক মনে হলো, একটু নরম, সাড়াহীন থেঁতলে কিংবা থ্যাবড়া হয়ে যাওয়াটা সে অনুভব করছে।
তারপর তো রক্তের ধারা। ডান হাতে তর্জনীর মাঝামাঝি অর্ধেক কেটে গেছে। আরেকটু জোরে কোপ পড়লে আঙুলটাই চলে যেত। কে যেন দৌড়ে গিয়ে তেনা আনল। আঙুলটা বেঁধে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে গেল হাসপাতালে।
এর কয়েক দিন পর ছিল প্রথম সাময়িক পরীক্ষা। সেবার সে বুড়ো আঙুল আর মধ্যমায় কলম ধরে পরীক্ষা দিয়েছিল। তর্জনী ছিল আকাশের দিকে।
প্রথম দিন দুই বেলা পরীক্ষা। প্রথম বেলার আগেই দেখে বাবা হাজির। তার জন্য নাশতা এনেছেন। জোর করে নাশতা খাওয়ালেন, সাহস দিলেন। সে ব্যথা ভুলে গিয়েছিল। বিকেলের পরীক্ষা দিয়েছিল উড়ে উড়ে।
আরেকবারের কথা। তখন সে ফাইভে পড়ে। ম্যালেরিয়া হয়েছিল তার। এক মাস ধরে বিছানায়। পৃথিবীটাকে মনে হতো একটা নিমগাছ। এখানে সবকিছু নিমের চেয়েও বেশি তিতা। কিচ্ছু ভালো লাগত না।
এক দিন ঘুম থেকে উঠেই বাপ্পী কান্নাকাটি শুরু করে দিল। হাতির পিঠে চড়বে। কেউ তাকে মানাতে পারে না। কাঁদছে তো কাঁদছেই—বাড়িঘর মাথায় তুলবে এমন অবস্থা।
সকালে বাবা অনেক রাগারাগি করলেন। বকা দিলেন, চড় মারতে চাইলেন। মায়ের জন্য পারেননি। মা বলল, ‘তোমার কি মাথা খারাপ? জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, কীভাবে গায়ে হাত তোলার কথা চিন্তা করো!’
পরদিন সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখল, তাদের উঠানে একটা হাতি। হাতি নিয়ে যে লোক এসেছিল, তাকে বলা হয় মাহূত। সে জানত না। তীব্র জ্বরের মধ্যেই দৌড়ে হাতির কাছে গেল।
লোকটা তাকে ফুলের তিনটা তোড়া দিল। বলল, ‘লালটা কৃষ্ণচূড়া, হলুদটা সোনালু আর বেগুনিটা জারুল। এগুলো হলো বৈশাখের রং। তোমার জন্য উপহার’।
ফুল পেয়ে সে হতবাক। সেদিন হাতির পিঠে চড়ে পুরো গ্রাম ঘুরেছে। হাতি যত সামনের দিকে এগোচ্ছিল, তার জ্বরটাও কমে যাচ্ছিল। ঘরে এলে মা কপালে হাত দেয়। মায়ের মুখে হাসি ফোটে। তার জ্বর হাওয়া হয়ে উড়ে গেছে।
পরে জেনেছে, ওই সময় তাদের বাড়ি থেকে প্রায় দশ মাইল দূরে কাজিরহাটে সার্কাস চলছিল। বাবা গিয়ে দেখেন সার্কাস শেষ হয়ে গেছে। অনেক অনুরোধ করে, বুঝিয়ে তাদের কাছ থেকে হাতিটা ভাড়া আনেন।
ভাবে, বাবা কি কোনো স্বপ্ন দেখেছিলেন? তার স্বপ্নগুলো কেমন ছিল? কোনো স্বপ্নের কথা তো জানা হলো না।
বাপ্পীর মনে হাতিটা এখনো রয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে সেই হাতির পিঠে চড়ে সে বাবাকে খুঁজতে বেরোয়।