মস্কো অভিজ্ঞতার ছিটেফোঁটা

মস্কো
মস্কো

উড়োজাহাজে জানালার পাশের সিটে বসেছিলাম, যাতে বাইরেটা দেখতে দেখতে যেতে পারি। নানা রকমের মেঘ পাশ দিয়ে শাঁ শাঁ করে উড়ে যাচ্ছে। একসময় বিমান নিম্নমুখী হলো। দেখি যে অবাক কাণ্ড, হলুদ ফুলে ছাওয়া গাছপালা, অরণ্যভূমি। বিমানবন্দরে নামার পরে বুঝতে পারি—হলুদ ফুল তো নয়, হলদে হয়ে যাওয়া গাছের পাতা। সময়টা ছিল হেমন্তকাল। এর পরেই শীত আসবে। এখনই শুরু হবে, যাকে হিন্দিতে বলে ‘পজ্ঝড়’, অর্থাৎ পাতা ঝরার কাল। বৃক্ষরাজি নিষ্পত্র হতে শুরু করবে। ক্রমে ন্যাড়া হয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকবে পুরোটা শীতের মৌসুম। পরে অভিজ্ঞতা জানিয়ে দেবে, প্রায় ছয়-সাত মাস—সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে এপ্রিলের গোড়া পর্যন্ত রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে: মস্কো, লেনিনগ্রাদ (এখন নাম হয়েছে সাংক্ৎ পিতেবুর্গ, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় সেন্ট পিটার্সবার্গ), কিয়েভ ইত্যাদি জায়গায় শীতের দাপট মৌরসিপাট্টা চালায়। শীতে তো সব পত্রশূন্য হয়ে যাবে। তার আগে হৈমন্তী সৌন্দর্যকে মহিমা দানের জন্য ভারি এক কাব্যিক নামও দিয়েছে রুশ ভাষা: জালাতায়া ওসেন্। অর্থাৎ, স্বর্ণাভ হেমন্ত। হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাসহ ছোট্ট সরু ডাল ভেঙে অনেকে নিজেদের ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দেয়। বসন্ত পর্যন্ত থাকবে, যত দিন না প্রকৃতির সুদিন আসে।আমি রুশ দেশে (তখন তো সোভিয়েত ইউনিয়ন) গিয়েছি দুবার। প্রথমে রুশ ভাষার অ-আ-ক-খ শিখতে, লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরেরবার মস্কো (রুশিতে মস্কভা) শহরে অনুবাদকের চাকরি করতে; প্রগ্রেস পাবলিশার্স বা প্রগতি প্রকাশনে। প্রথমবারে ছিলাম এক বছর তিন মাস। দ্বিতীয়বারে তিন বছরের একটু বেশি।

রাশিয়ায় পা দিয়েই যা আমাকে মুগ্ধ করে, তা হলো সাধারণ লোকজনের মিশুকে ব্যবহার। আচার-আচরণের ধরন বিলেত বা পশ্চিম ইউরোপের মানুষের মতো নয়, বরং অনেকটাই আমাদের মতো। আড্ডাবাজ, গপ্পিশ। রাশিয়ায় পড়াশোনার মাধ্যম সর্বত্রই রুশ ভাষায়। সে কারণে বিদেশ থেকে আসা ভিন্নভাষী ছাত্রছাত্রীদের জন্য রুশ ভাষা জানা বাধ্যতামূলক। সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক ফ্যাকাল্টি বা অনুষদ থাকে, যার নাম পদ্গাতোভিতিয়েলিন ফাকুলিতয়েৎ বা প্রস্তুতি ফ্যাকাল্টি। সেখানে সপ্তাহের মধ্যে পাঁচটি দিন (অন্য দুদিন শনি ও রোববার তো সাপ্তাহিক ছুটি) কেবল রুশ ভাষা শিক্ষা ও পঠনপাঠন চলে। পৃথিবীতে কঠিনতম গুটি কয়েক ভাষার মধ্যে রুশিকেও ধরা হয়। বাংলার সঙ্গে কিছু কিছু ব্যাপারে মিলও আছে, যেমন: কারক, বিভক্তি, লিঙ্গ (রুশিতে অবশ্য ক্লীব লিঙ্গও রয়েছে); যেমন বাংলার মতো সম্বোধনে তুই, তুমি বা আপনি। রুশি বর্ণমালা সড়গড় হতে অবশ্য দিন কয়েক সময় নেয়, লাতিন বর্ণমালা (যেমন: ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, হিস্পানি ইত্যাদি ভাষায় চালু রয়েছে) থেকে একেবারেই পৃথক, বরং কিছু সাদৃশ্য আছে গ্রিক বর্ণমালার সঙ্গে। সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের সঙ্গে রুশি ব্যাকরণের অনেক বিষয়ে মিল থাকায় একটা সময় ছিল যখন রুশ ভাষাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কিঞ্চিৎ সংস্কৃত ব্যাকরণ পড়তে হতো—সে অবশ্য ৬০-৭০ বছর আগে। যেহেতু অন্য কোনো ইউরোপীয় ভাষার ব্যবহারই নেই, তাই ভুলভাল যেমনই হোক, রুশ না বলে তো উপায় নেই। মাস্টারনীরা (মাস্টারদের তুলনায় এঁরাই সংখ্যায় বেশি) সব সময়েই বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের প্ররোচিত করতেন ঘুরে বেড়াতে, স্থানীয় রুশদের সঙ্গে দোকানে কি পথেঘাটে গল্প জমানোর চেষ্টা করতে। বলা দরকার, বর্তমান কালের কেতাবি রুশ আর লোকজনের মুখের কথ্য রুশ ভাষার ভেতরে তফাত বড় একটা নেই। ভাষাশিক্ষার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও তো এটাই: কানে শোনো এবং নিজে ঠিক সেই উচ্চারণে বলার চেষ্টা করো। ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাবরেটরি এ কাজটাই তো করে। ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ কিংবা জার্মান কালচারাল ইনস্টিটিউটে ভাষা যাঁরা শেখেন, তাঁরাই এ পদ্ধতির মুখোমুখি হয়েছেন।

এক কথা থেকে অন্য কথায় চলে এসেছি। যা বলছিলাম, রুশ ভাষা শিক্ষার প্রস্তুতি অনুষদে শিক্ষিকারা আমাদের দিকে যে কী মনোযোগ দিতেন, কী পরিমাণ স্নেহ ও প্রশ্রয় দিতেন, বলে বোঝানো যাবে না, এককথায় তা অবিশ্বাস্য। তাঁরা সর্বদাই সম্ভবত মনে রাখতেন—এই ছেলেমেয়েগুলো নিজেদের বাবা-মা-আত্মীয়স্বজন সবাইকে ফেলে কী মনঃকষ্টে ও দুঃখের ভেতর দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। তাঁরা তাঁদের মমতা ও সহানুভূতি দিয়ে সেই কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করতেন। রুশি মানুষজন বকুনতুড়ে ও গপ্পোবাজ—সে তো আগেই বলেছি। এর ফলে রুশি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খুবই অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠা সম্ভব হতো। এর ফলে বিদেশবাস অনেক সহনীয় হয়ে উঠত।

মস্কোর নাগরিক জীবন যে নিরুপদ্রব, স্বস্তিদায়ক ও টেনশন ফ্রি ছিল, তা সোভিয়েত আমলে যাঁরা সেখানে গেছেন, তাঁরাই প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাক্ষ্য দেবেন।

আরেকটি ব্যাপার একেবারেই চোখ এড়িয়ে যাওয়ার মতো ছিল না। সেটি হলো—প্রতিটি রুশির বই পড়ার অভ্যাস। ট্রেনে, ট্রামে, বাসে, ট্রলিবাসে প্রত্যেক যাত্রীর হাতে বই বা পত্রিকা কিছু একটা থাকবেই এবং সে সেটা পড়তে পড়তে যাবে। বইপত্রের দামও তো অকল্পনীয় সস্তা ছিল। এখন কেমন জানি না।

আমার রাশিয়া-বাস এ জীবনের এক পরম অভিজ্ঞতা। আমার জীবনে এক সুখের পর্ব ছিল সেটি।